গত ৩০শে জানুয়ারি রাতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যকার বাক-বিতণ্ডার পরে “এই শালা আমি কে!’ কুবিতে ছাত্রলীগকে সহকারী প্রক্টর” শিরোনামসহ বেশ কয়েকটি শিরোনামে একই দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করে দেশের বেশকয়েকটি সংবাদমাধ্যম।
এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে মূলধারার গণমাধ্যম দৈনিক কালের কণ্ঠ, দেশ রূপান্তর এবং দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস।
এছাড়া একই দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করেছে অনলাইন পোর্টাল ‘একুশে সংবাদ‘।
তবে একই ঘটনার ক্ষেত্রে শিক্ষক (সহকারী প্রক্টর) কর্তৃক ছাত্রকে আলোচিত সম্বোধন করা হয়নি দাবিতে-ও “শালা নয়, ছেলেই বলেছেন হেনস্তার শিকার হওয়া সেই কুবি শিক্ষক” শীর্ষক শিরোনামসহ সমজাতীয় বেশকিছু শিরোনামে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়।
এজাতীয় কিছু সংবাদ প্রকাশ করেছে বায়ান্ন নিউজ, আজকের শতাব্দী, জি-নিউজ২৪ এবং প্রতিদিনের চিত্র।
এছাড়াও, এই ঘটনায় কয়েকটি গণমাধ্যমের কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে “কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে সহকারী প্রক্টর লাঞ্ছিত” শীর্ষক শিরোনামসহ বিভিন্ন শিরোনামে প্রকাশিত সমজাতীয় সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনগুলো দেখুন; প্রথমআলো, যুগান্তর ও জাগোনিউজ২৪।
এখানে উল্লেখ্য যে এই সংবাদগুলোতে “শালা” সম্বোধনের বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই। বরং শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষক (অভিযুক্ত) লাঞ্চিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থাৎ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনায় পুরোপুরি ভিন্ন আঙ্গিকের দুটি দাবি পাওয়া গেছে গণমাধ্যমে।
গণমাধ্যমে কেন এই বিভ্রান্তি?
গণমাধ্যমের বিভ্রান্তির বিষয়ে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে উভয় দাবির সংবাদ পড়ে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। দৈনিক কালের কণ্ঠ এর একটি বাক্য থেকে জানা যায় ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করা হয়েছে।
হুবহু একই বাক্যটি দেশ রুপান্তর ও দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস এর প্রতিবেদনেও খুঁজে পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে ফেসবুকে “কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব” নামের একটি পেজ থেকে আলোচিত ঘটনা ও সম্বোধনের বিষয় নিয়ে গত ৩০ জানুয়ারি(আর্কাইভ), ৩১ জানুয়ারি(আর্কাইভ) এবং ১ ফেব্রুয়ারি(আর্কাইভ) প্রচারিত সর্বমোট তিনটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
এছাড়া, একই ঘটনায় গত ৩১ জানুয়ারি মূলধারার অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘জাগোনিউজ২৪‘(আর্কাইভ) এর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল(আর্কাইভ) থেকে প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষণ করে ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেস ক্লাব’ এর পেজ থেকে ৩১ জানুয়ারি প্রকাশিত ভিডিওতে ২:৩৪ মিনিট হতে আলোচিত সম্বোধনের মুহূর্তটি খুঁজে পাওয়া যায়। তবে ঘটনাস্থল অতিরিক্ত শোরগোলের কারণে উভয় ধরণের দাবি’র সেই আলোচিত সম্বোধনের শব্দটি উচ্চারণের সময়ে অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায়”।
এই অস্পষ্টতা থেকেই গণমাধ্যমের সংবাদে বিভ্রান্তির সূত্রপাত হতে পারে।
আরো উল্লেখ্য যে, প্রতিনিধি ভিন্নতায় সংবাদের তথ্য পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন শিক্ষকসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, ‘ক্যাম্পাসের কতিপয় সাংবাদিক একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও বিভিন্ন দল-মত ও বিভক্তর সাথে সংশ্লিষ্ট।’
অভিযোগের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
এরকম আরো একটি প্রতিক্রিয়ার চিত্র (স্ক্রিনশট) দেখুন নিচে
উল্লেখ্য, “সময় জার্নাল” নামক একটি পোর্টালে “শিক্ষককে হেয় করে পোস্ট দিতে কুবি শাখা ছাত্রলীগের চাপ প্রয়োগের অভিযোগ” শীর্ষক সংবাদ পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়,
প্রতিবেদনে উল্লিখিত দাবির সত্যতা যাচাইয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে অবস্থানরত বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের তিনটি আবাসিক হলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশকয়েকজন শিক্ষার্থী উক্ত বিষয়টি সত্য বলে রিউমর স্ক্যানার টিমকে নিশ্চিত করেছে।
কেন এমন হয়? (অডিও প্যারেডোলিয়া)
প্রায় সমজাতীয় উচ্চারণের শব্দ অস্পষ্টতা, শোরগোল কিংবা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে পরিবর্তিত অবস্থায় শোনাতে পারে। এটি “অডিও/অডিটরি প্যারেডোলিয়া” নামে পরিচিত।
শিক্ষা বিষয়ক সাইট “টেন মিনিট স্কুল” এর ব্লগে’র এক লেখা অনুযায়ী, “অডিও প্যারেডোলিয়া’কে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেন ‘Musical Ear Syndrome’। এটিও একটি ভ্রম যাকে বলা হয় ‘শব্দের ভ্রম’।
বাস্তব জীবনে আমরা সকলেই কখনো না কখনো এই অডিও প্যারেডোলিয়ার ফাঁদে পা দিয়েছি। অসংখ্য শব্দ বা কথার মাঝে কিছু নির্দিষ্ট শব্দ বা আওয়াজ যা আমাদের মস্তিষ্ককে কিছু সময়ের জন্য ঐ শব্দ বা আওয়াজের কাছাকাছি পরিচিত কোনো আওয়াজকে ধারণ করে এবং শব্দটি পরিচিত হওয়ায় আমরাও বেশ কৌতূহলী হয়ে যাই, একেই বলে অডিও প্যারেডোলিয়া। এটিও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একটি ঘটনা এবং ক্ষণস্থায়ী মনোবৈকল্য।
বিষয়টি নিয়ে আর বিস্তারিত জানা যাবে hearinglosshelp সাইট থেকে।
অনুসন্ধান যেভাবে এগিয়েছে
আলোচিত বিষয়টি অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে প্রধানত তিনটি পদ্ধতি ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। প্রথমত, অডিও এনালাইসিস। দ্বিতীয়ত সংবাদ সংগ্রাহকদের কাছে থাকা সংবাদের সূত্র এবং তৃতীয়ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা অন্যান্য শিক্ষক এবং ছাত্রদের (প্রত্যক্ষদর্শী ও শ্রোতা) বক্তব্য।
অডিও (ভিডিওর) এনালাইসিস
উক্ত ঘটনায় প্রাথমিকভাবে রিউমর স্ক্যানার টিমের হাতে আসা ভিন্ন ভিন্ন এঙ্গেল থেকে ধারণকৃত চারটি ভিডিও ক্লিপই ছিল সল্প সময়ের এবং অধিকাংশ ভিডিওই নয়েজ সম্পন্ন। যার মাধ্যমে আলোচিত এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান সম্ভব ছিল না।
পরবর্তীতে উক্ত ভিডিওগুলোর সূত্র ধরে এই ঘটনায় দৈনিক জনকণ্ঠের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ইকবাল হাসান কর্তৃক ধারণ করা ১০ মিনিট ০৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সংগ্রহ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
অধিকতর অনুসন্ধানের প্রয়োজনে ১০ মিনিট ০৮ সেকেন্ডের এই ভিডিও অসংখ্যবার পর্যবেক্ষণ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
ভিডিওর শুরুতেই রুমের মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের মাঝে বেশ উত্তেজনাকর মুহূর্ত দেখা যায়।
হট্টগোল থামাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সহকারী প্রক্টর অমিত দত্তের বের তৎপরতা লক্ষণীয়।
ভিডিওর ৩ সেকেন্ড হতে থেকে ৭ সেকেন্ড পর্যন্ত শিক্ষক অমিত দত্তকে ছাত্রলীগ নেতা এনায়েতের দিকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, “এই কি হয়েছে, এই কি হয়েছে, আমরা শিক্ষক।”
এইসময় ছাত্রলীগ নেতা এনায়েতকে শিক্ষক অমিত দত্তের দিকে উদ্দেশ্য করে “আপনি চিল্লাইয়া কথা বলছেন কেন?” এই শব্দটি বারংবার বলতে শোনা যায়।
ভিডিওর ১৭ সেকেন্ড ২৭ সেকেন্ড পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেতা মো. সালমান চৌধুরীকে “এই, এই, এই” সম্বোধন করে শিক্ষক অমিত দত্তের দিকে আঙুল উঁচিয়ে তেড়ে যেতে দেখা যায়।
ভিডিওর ২:১৮ মিনিট থেকে ২:৩৫ মিনিট পর্যন্ত শিক্ষক অমিত দত্তকে ছাত্রলীগ নেতা এনায়েতের দিকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, “এই এনায়েত এই, তুমি আমারে চিনো না? তুমি আমাকে চিনো কিনা? চিনো? আমি কে? আমি কে? এই ……..(অস্পষ্ট), আমি কে? আমি কে?”
তখন ছাত্রলীগ নেতা এনায়েতকে প্রতিউত্তরে বলতে শোনা যায়, “স্যার আপনি আমাদের শিক্ষক।” পরবর্তীতে শিক্ষক অমিত দত্তকে আবারো বলতে শোনা যায়, “আমি কে? আমি কে?”, তখন প্রতিউত্তরে এনায়তকে আবারো “আপনি আমাদের শিক্ষক” বলে সম্বোধন করতে শোনা যায়। ২:৩৬ মিনিট থেকে ২:৪০ মিনিট পর্যন্ত শিক্ষকের প্রশ্নের জবাবে ওই একই শিক্ষার্থীকে(এনায়েত) বলতে শোনা যায় “আমি তো স্যার আপনাকে বলিনি।”
এইসময় ঘটনাস্থলে প্রচণ্ড হট্টগোল থাকায় শিক্ষক অমিত দত্ত ছাত্রলীগ নেতা এনায়েতকে এই শব্দের পর প্রকৃতপক্ষে কি বলেছেন তা স্পষ্টভাবে শোনা বা বোঝা যাচ্ছে না। আর এই অস্পষ্ট বিষয়টি নিয়েই ঘটনা পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ নেতা এনায়েত শিক্ষক অমিত দত্তের বিরুদ্ধে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজের(এই শালা) অভিযোগ তুলেন।
পরবর্তীতে উক্ত সম্বোধনটি সম্পর্কে স্পষ্ট হতে ভিডিওর বাকি অংশে অভিযুক্ত শিক্ষক এবং অভিযোগকারী ছাত্রলীগ নেতার শব্দচয়ন ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
ভিডিওর ২:৪৪ মিনিট থেকে ২:৫৫ মিনিট পর্যন্ত শিক্ষক অমিত দত্তকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দিকে উদ্দেশ্য করে “আমরা এখানে তোমাদের জন্য আসছি” এই কথাটি বারংবার বলতে শোনা যায়। ২:৫৬ মিনিট থেকে ২:৫৮ মিনিট পর্যন্ত শিক্ষক অমিত দত্তকে শিক্ষার্থীকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, “এই ছেলে আমরা এখানে কি জন্য আসছি?”
ভিডিওর ৩:২১ মিনিট হতে ৩:২৮ মিনিট পর্যন্ত শিক্ষক অমিত দত্ত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়, “আমরা এখানে আসছি তোমাদের জন্যই তো বাবা।” আমরা এখানে তোমাদের জন্য আসছি। তোমরা আমাদের নিকট উত্তেজিত হও।”
ভিডিওর ৬:০০ মিনিট থেকে ৬:০৫ মিনিট পর্যন্ত শিক্ষক অমিত দত্তকে ছাত্রলীগ নেতা এনায়েতের দিকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, “তুমি আমাকে পারসোনালি চিনো, বাট তুমি আচরণটা করছো ইটস নট স্টুডেন্ট ফ্রেন্ডলি, ওকে।”
ভিডিওর ৬:০৭ মিনিট থেকে ৬:১১ মিনিট পর্যন্ত শিক্ষক অমিত দত্তকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা এখানে আসছি তোমাদের শৃঙ্খলার জন্য।’ এবং এর প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ নেতা এনায়েতকে শিক্ষক অমিত দত্তের দিকে উদ্দেশ্য বলতে শোনা যায় “স্যার আপনি যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমি সরি স্যার।”
উক্ত ভিডিও পর্যবেক্ষণে এই ঘটনায় আলোচিত সম্বোধনের বিষয়টি কি ছিলো তা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা প্রসঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার।
প্রথম ফ্যাক্ট
ঘটনাস্থলে হট্টগোলের কারণে প্রথম দফায় অভিযুক্ত শিক্ষক অমিত দত্ত কর্তৃক শিক্ষার্থীকে সম্বোধনটি(এই ……… (অস্পষ্ট) আমি কে? অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো না।
দ্বিতীয় ফ্যাক্ট
আলোচিত এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে অর্থাৎ অশ্রাব্য ভাষায় গালির অভিযোগ না তুলে(শালা সম্বোধনের) ছাত্রলীগ নেতা এনায়েতের উত্তর (“স্যার আপনি আমাদের শিক্ষক।”)
ছিল অনেকটাই সাবলীল। এছাড়া ভিডিওতে এক পর্যায়ে নিজের আচরণের জন্য ছাত্রলীগ নেতাকে শিক্ষক অমিত দত্তকে উদ্দেশ্য করে সরি বলতেও (“স্যার আপনি যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমি সরি স্যার।”) দেখা ও শোনা যায়।
তৃতীয় ফ্যাক্ট
অতিরিক্ত হট্টগোলের কারণে প্রথম দফায় ‘এই’ এর পর সম্বোধনকৃত শব্দটি নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও দ্বিতীয় দফায় প্রায় একই জাতীয় শব্দ সম্বোধনের (“এই ছেলে আমরা এখানে কি জন্য আসছি?”) বিষয়টি স্পষ্টভাবেই শোনা যায়।
চতুর্থ ফ্যাক্ট
ভিডিওতে বিভিন্ন অংশে শিক্ষক অমিত দত্তকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দিকে উদ্দেশ্য করে “আমরা এখানে তোমাদের জন্য আসছি” এই কথাটি বারংবার বলে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে দেখা যায়। এছাড়া ভিডিওতে এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বাবা (“আমরা এখানে আসছি তোমাদের জন্যই তো বাবা।”) বলে সম্বোধন করতে শোনা যায়।
অর্থাৎ, ভিডিওর মধ্যে থাকা কথোপকথন পর্যবেক্ষণ করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। আমরা সর্বোচ্চ সংখ্যক বার কথোপকথনগুলো ম্যানুয়ালি শুনে (স্লো স্পিড পদ্ধতি ব্যবহার করা সহ) বোঝার চেষ্টা করেছি শিক্ষক অমিত দত্ত আসলে কোন শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ছেলে নাকি শালা? সেক্ষেত্রে ভিডিওটি নয়েজ সম্পন্ন হওয়ায় স্পষ্ট কোনো শব্দের পক্ষে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। তবে শ্যালে, ছ্যালে এবং সালে এই শব্দগুলো বেশি পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীতে ওই সম্বোধনের আগে পরে শিক্ষকের আচরণ বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। এছাড়া বিষয়টি অধিকতর নিশ্চিতের জন্য ঘটনা সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল পক্ষের মতামত নেয় রিউমর স্ক্যানার।
আলোচিত সংবাদগুলোর সংগ্রাহক সাংবাদিকদের (বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি) কাছে সংবাদের সূত্রের খোঁজ
এই ধাপে আমরা এই ঘটনায় “শালা” সম্বোধন করা হয়েছে দাবিতে প্রকাশিত সংবাদগুলোর সূত্র খোঁজার চেষ্টা করি।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, এই দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করেছে দৈনিক কালের কণ্ঠ, দেশ রূপান্তর এবং দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় উল্লিখিত গণমাধ্যমগুলোর সংবাদ সংগ্রাহক (বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি) দের সাথে।
দৈনিক কালের কণ্ঠের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি চৌধুরী মাসাবি জানান, “তিনি অভিযোগের ভিত্তিতে সংবাদটি লিখেছেন।”
কিন্তু সংবাদটি যাচাই করে দেখা যায়,
উল্লেখ্য যেঃ অভিযোগ পত্রে “অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ” করেন বলে উল্লেখ করা হলেও নির্দিষ্ট করে “শালা” শব্দটি উল্লেখ করা হয়নি।
এই বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি (ক্যাম্পাস প্রতিনিধি) জানান, “এখানে কালের কণ্ঠের দুজন প্রতিনিধি রয়েছে”।
তাকে সংবাদের লিংক দেওয়ার পর নিউজটি কার লেখা তা জানতে চেয়ে ফোন করা হলে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
দৈনিক দেশ রূপান্তর এর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নাইমুর রহমান রিজভী জানান, “তিনি নিজে নিজ কানে স্পষ্ঠভাবে শুনেছেন এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে সংবাদ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রতিবেদনে অভিযোগকারী ব্যতীত তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট সূত্রের বিষয়ে উল্লেখ নেই।”
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস এর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হাসান আল মাহমুদ জানান, “আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম আমিও নিজ কানে শুনেছি।”
নিজের স্টেটমেন্ট নিজের সংবাদে ব্যবহার করতে পারেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন “আমি অভিযোগের ভিত্তিতে সংবাদ লিখেছি”।
তবে তার করা প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণ করেও দৈনিক কালেরকণ্ঠের মতোই প্রায় সিদ্ধান্তমূলক তথ্য পাওয়া যায়।
এছাড়া অনুসন্ধানে দেখা গেছে এই তিন সংবাদ মাধ্যমে তাদের পাঠানো সংবাদগুলোর প্রথম অংশ (অনুচ্ছেদ) একদম হুবহু মিলে যায়। কালের কণ্ঠ ও দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদনের প্রথম অংশ একদম হুবহু মিলে যায়। ডেইলি ক্যাম্পাস-এর প্রতিবেদনে মাত্র একটি শব্দ পরিবর্তন ব্যতীত বাকি সব অংশ হুবহু মিলে যায়। ডেইলি ক্যম্পাসে “এই সহকারী প্রক্টর” শব্দের বদলে “তিনি” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও এই তিন গণমাধ্যমের সংবাদের অধিকাংশ অংশেই হুবহু এক শব্দ ও গঠন ব্যবহার করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ঘটনাস্থলে ছিলেন কিনা এই বিষয়টি জানতে চাইলে ঘটনার ভিডিও ধারণা করা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিনিধি ইকবাল হাসান বলেন, “না তিনি ছিলেন না। থাকলেও রুমের বাইরে ছিল। রুমের ভেতর উনাকে দেখা যায়নি।”
এছাড়া ঘটনাস্থলের ভিডিও ধারণ করা দৈনিক আজকের পত্রিকার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সাজ্জাদ বাশারও ঘটনাস্থলে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের প্রতিনিধিকে দেখেননি বলে জানান।
অভিযোগ পত্রের ভিত্তিতে প্রকাশিত সংবাদকে কি সিদ্ধান্তমূলক শিরোনামে প্রকাশ করা যায়?
অভিযোগের ভিত্তিতে প্রকাশিত সংবাদ সিদ্ধান্তমূলক ভঙ্গিমায় প্রকাশের সুযোগ আছে কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আল-জামান রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “অভিযোগের ভিত্তিতে করা সংবাদের শিরোনামে অনেক গণমাধ্যম সচেতনভাবে “অভিযোগ” শব্দটি রাখে না। এই অভ্যাস পাঠকদের জন্য বিভ্রান্তিকর এবং এটি ভুল বোঝাবুঝির তৈরি করার জন্য সহায়ক। এ ধরনের চর্চার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে।
মানুষ নিশ্চয়তা ভালোবাসে, দোদুল্যমানতা মনে অসন্তোষ তৈরি করে। অনেক গণমাধ্যমই তাদের শিরোনাম থেকে “অভিযোগ” শব্দটা তুলে দিয়ে আপাতভাবে সেই মানসিক নিশ্চয়তা তাদের পাঠকদেরকে দিতে চায়। এটি এই চর্চার একটি দিক হতে পারে।
আবার, কোনো গণমাধ্যম নিজেকে অন্য প্রতিযোগী গণমাধ্যমের চাইতে অধিক গ্রহণযোগ্য করে দেখাতে চাইলেও এমনটি করতে পারে। প্রতিটি গণ্যমাধ্যমেরই নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান থাকে। সেই অবস্থানও এই চর্চাকে উৎসাহিত করতে পারে।
সংবাদের কাটতি বাড়ানোও গণমাধ্যমের ইমেজ এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। “অভিযোগ” শব্দটা সংবাদের উত্তেজনাকে ক্ষুণ্ণ করে। আর একটি সত্য সংবাদের তুলনায় একটি উত্তেজক সংবাদ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপভোগ্য হয়।
এসব ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, পাঠকেরা কি তাহলে গণমাধ্যমের এইসকল কারসাজি ধরতে পারে না? আমার মনে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠকদের সচেতন চোখ-মন এড়িয়ে যায় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। এর কারণ হতে পারে পাঠকদের যথাযথ মনোনিবেশের অভাব, নির্দিষ্ট গণমাধ্যমের প্রতি আনুগত্য, সংবাদের সত্যতা ও গণমাধ্যমের রাজনীতি যাচাইকরণের সময়, মানসিকতা, বা যোগ্যতা না থাকা, এবং নিশ্চয়তা পেয়ে তৃপ্ত হয়ে যাওয়া যেটির কথা প্রথমেই বললাম।”
একই বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মো. শরিফুল ইসলাম রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “সাংবাদিকতায় একটি প্রবাদতুল্য বাক্য আছে- When in doubt, leave it out. সংবাদ লেখার ক্ষেত্রে কোন শব্দ, বাক্য বা তথ্য নিয়ে সন্দেহ হলে, ঐ শব্দটি যেখানে বাদ দেয়ার কথা বলা হয়, সেখানে এমন একটি শব্দ হেডলাইনে নিয়ে আসাটা বিভ্রান্তিকর। এমন ক্লিকবেইট রিপোর্টিং সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের দীর্ঘমেয়াদী বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে। শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে এ ধরনের মানহানিকর হেডলাইন করা সাংবাদিকতার নীতিবিরোধী। সংবাদের বডিতে শব্দটি নিয়ে দুইপক্ষের দাবি/ অভিযোগ তুলে ধরা যেতো। কিন্তু হেডলাইনে এমন একপাক্ষিক অভিযোগ তুলে ধরাটা মিডিয়া ট্রায়ালের পর্যায়ে পড়ে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মো. মশিহুর রহমান জানান, “অভিযোগ বা অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে সংবাদে সিদ্ধান্তমূলক শিরোনাম বা মন্তব্য করা উচিত নয়। সাংবাদিকদের উচিত চেক-ক্রসচেকের মাধ্যমে ঘটনার সব দিক সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা। কেবল অভিযোগের উপর ভিত্তি করে তথ্যউপস্থাপন করলে তা মতামত ও পক্ষপাত হিসাবে দেখা যেতে পারে।”
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা অন্যান্য শিক্ষক, সাংবাদিক এবং ছাত্ররা কি বলছেন?
অভিযুক্ত শিক্ষক কি শব্দ ব্যবহার করেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী প্রক্টর কাজী এম আনিছুল ইসলাম বেশকিছু পয়েন্ট উল্লেখ করে জানান,
- “ছেলে-ই বলেছে।” তিনি আরো যোগ করেন, “কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অমিত দত্ত স্ল্যাং (এ জাতীয় বাজে শব্দ) ব্যবহার করেন না। “এই ছেলে” এটা ওনার একটা কমন ডায়লগ। উনি সাধারণত সকল শিক্ষার্থীদেরকে (ছেলে) “এই ছেলে” বলে সম্বোধন করেন। “
- ভিডিওতে শব্দটি উচ্চারণের ক্ষেত্রে শেষে এ কার’টা মোটামুটি স্পষ্ট বোঝা যায় বা শোনা যায় নিমিত্তে তিনি আরো যুক্ত করেন, “মানুষ কিন্তু শালে বলে না ছেলে বলে (অর্থাৎ এই দুই শব্দের মধ্যে শেষে এ কার হয় ছেলে শব্দের)।
- এছাড়াও (শিক্ষক অমিত দত্তের) এই বাক্যের পরে ছাত্রদের মধ্যে থেকে উত্তর এসেছে ‘আপনি আমাদের শিক্ষক’, যদি অমিত দত্ত শালা শব্দ ব্যবহার করতেন তাহলে শিক্ষার্থী এরকম সাবলীল উত্তর দেওয়ার কথা না। বরং আরো রেগে যাওয়ার কথা।
- এই অভিযোগটা প্রথমে কিন্তু আসেনি। যখন শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সহকারী প্রক্টরের দিকে তেড়ে আসার অভিযোগ আসলো তার পরই হঠাৎ করে সহকারী প্রক্টরের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদেরকে শালা ডাকার অভিযোগ ছড়ানো হয়েছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী জানান, “ছেলে-ই বলেছেন।”
কুবির নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী হলের প্রাধ্যক্ষ ও গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান জানান, “আমার স্পষ্টতই মনে আছে ‘এই ছেলে’ শব্দ ব্যবহার করেছে”।
কুবির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ ও বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোকাদ্দেস-উল-ইসলাম জানান, “ঘটনাস্থলে অনেক লোকজন ছিলো। আমি একটু দূরে চেয়ারে বসা ছিলাম এবং এত শোরগোল ছিল যে শব্দটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়নি।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহণ প্রশাসক ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপণ চন্দ্র মজুমদার জানান, “তিনি (অমিত দত্ত) বলেছেন ‘এই ছেলে’ ।”
ঘটনাস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি এম এম হাশমি জানান,
“আমি সেদিন বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট রুমে ছিলাম। ঐ দিন ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে অনেক তর্কবিতর্ক হচ্ছিলো এবং প্রচুর আওয়াজ হচ্ছিলো। একপর্যায়ে গিয়ে তর্কবিতর্ক থামে এবং সমস্যাটি সমাধান হয়। কিন্তু ঘটনা থামার প্রায় ১৬ ঘন্টা পর কিছু শিক্ষার্থী দাবি তোলে যে সহকারী প্রক্টর অমিত পলাশ তাদের একজনকে ‘শালা’ বলে সম্বোধন করেছে। ব্যাপারটি একদম বানোয়াট। সেদিন সহকারী প্রক্টর অমিত দত্ত এমন কোনো কথা বলেননি।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও দৈনিক জনকণ্ঠের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ইকবাল হাসান জানান, “আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম। যাকে সম্বোধন নিয়ে সমস্যা হচ্ছে তার দুই তিনজনের পিছনেই আমি ছিলাম। আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত অবস্থায় ‘এই ছেলে’ সম্বোধনই শুনেছি।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী তাসফিক আবদুল্লাহ জানান, “সেদিনের ঘটনায় অমিত স্যার ‘ওই শালা’ জাতীয় কোনো অপ্রীতিকর শব্দ উচ্চারণ করেননি। যদি তিনি অপ্রীতিকর শব্দ উচ্চারণ করেই থাকতো তাহলে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করতো। আমি ওনাকে অপ্রীতিকর শব্দ (ওই শালা) উচ্চারণ করতে শুনিনি।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আল আমিন জানান, “ঘটনার দিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুইটি গ্রুপের একটি রেজা-এলাহী গ্রুপ বঙ্গবন্ধু হলে প্রবেশ করে। ঘটনার এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ সভাপতি ইলিয়াস ভাই তাদেরকে নিয়ে প্রভোস্ট স্যারের রুমে যান। ঐখানে কিছু উত্তপ্ত কথাবার্তা হয়। সেখানে প্রক্টর রানা স্যার, সহকারী প্রক্টর অমিত স্যারসহ প্রক্টরিয়াল বডির বাকি সদস্য এবং শিক্ষকরা ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরা স্যারদের কথায় কর্ণপাত না করায় সহকারী প্রক্টর অমিত স্যার রেগে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতা এনায়েত ভাইকে বলছিলেন, ‘এই ছেলে, আমি কে?’ তখন এনায়েত ভাই বলছিলো, আপনি আমাদের শিক্ষক। তার এই কথার উত্তরে অমিত স্যার বলেন, তাহলে আমাদের মানো না কেন? আমরা তো তোমাদের জন্যই এখানেই আসছি।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং দ্য বাংলাদেশ টুডে এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নাজমুস সাকিব জানান, “সেদিন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাথে স্যারদের এক পর্যায়ে কথা কাটাকাটি হয়। তারপর স্যার এর সাথে ছাত্রলীগের নেতাদের আচরণ একটু উগ্রতার পর্যায়ে চলে গেলে স্যার ছাত্রদেরকে শান্ত করার জন্য ‘এই ছেলে’ সম্বোধন করে ধমক দেন। স্যারের বিরুদ্ধে ছাত্রকে শালা বলার যে অভিযোগ এসেছে তা মিথ্যা। স্যার যদি ‘এই শালা’ বলতো তাহলে সেই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের থেকে একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা যেতো, আমি সেখানে উপস্থিত থেকে এমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ও আজকের পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সাজ্জাদ বাসার জানান, “উনি(অমিত দত্ত) ছেলে বলে সম্বোধন করেছেন। বলেছেন এই ছেলে আমি কে? এসব কথার মাঝে একটা ভিডিও নয়েজ সম্পন্ন। সেটা দিয়েই বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে।”
অভিযোগকারী কী বলছেন?
“শালা” সম্বোধনের অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলেছি অভিযোগকারী ছাত্র এবং অভিযুক্ত শিক্ষকের সাথেও।
অভিযোগপত্রে “শালা” শব্দটি উল্লেখ না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগকারী ছাত্র জানিয়েছেন, “শালা শব্দটা লেখা যায় না তাই আমি অশ্রাব্য গালিগালাজ লিখেছি”
“ঘটনাস্থলে উপস্থিত অন্যান্য শিক্ষকেরা শালা শব্দ বলা হয়নি হিসেবে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, কিন্তু আপনি বলছেন শালা বলেছে” শীর্ষক তথ্য উল্লেখ করে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, “শিক্ষকেরা প্রক্টরিয়াল বডির সাথে সংশ্লিষ্ট, যেহেতু প্রক্টরিয়াল বডি থেকে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে সেহেতু তারা তো এরকমটা-ই বলবে”
“অভিযুক্ত শিক্ষক যদি আপনাকে শালা বলে থাকে তাহলে তো আপনি রিয়্যাকশন দেখাতেন, প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে আপনার কাছ থেকে তো সেরকম কোনো প্রতিক্রিয়া আসতে দেখা যায়নি” শীর্ষক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, “স্যারের সাথে তো আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি না, কেননা তিনি আমাদের শিক্ষক”।
পরে আর একবার বলেন (অভিযোগকারী) “উনি আমাকে শালা বলেছেন এটাই শিউর।”
অভিযুক্ত শিক্ষক কী বলছেন?
অভিযুক্ত সহকারী প্রক্টর অমিত দত্ত জানিয়েছেন, “আমি ছেলে বলেছি। সচেতন ভাবেই ছেলে বলেছি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এই অভিযোগ করা হয়েছে। ‘এই ছেলে’ বলে সম্বোধন করা আমার সহজাত।”
তিনি আরো যুক্ত করেন, “আমার সম্বোধনের পরিপ্রেক্ষিতে তারা কিন্তু উত্তর দিয়েছে ‘আপনি আমাদের শিক্ষক’। যদি আমি গালি জাতীয় শব্দ ব্যবহার করতাম তাহলে তো স্বাভাবিকভাবে তাদের এরকম উত্তর দেওয়ার কথা নয়”।
উল্লেখ্য, সহকারী প্রক্টর ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অমিত দত্তকে লাঞ্ছনার অভিযোগে দুই ছাত্রলীগ নেতাকে শোকজ নোটিশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত ৩১শে জানুয়ারি সন্ধ্যায় উপাচার্যের সঙ্গে প্রক্টরিয়াল বডির এক জরুরি বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে পরবর্তী দুই কার্যদিবসের মধ্যে সহকারী প্রক্টরকে লাঞ্ছিত করার বিষয়ে দুই ছাত্রলীগ নেতাকে যৌক্তিক কারণ দর্শাতে বলা হয়। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে অভিযুক্ত দুই ছাত্রলীগ নেতা শোকজের উত্তর দিয়েছেন।
অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বা সিদ্ধান্ত
ঘটনার ভিডিও পর্যবেক্ষণ, ঘটনা সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলোর তথ্য উপস্থাপন পর্যবেক্ষণ, ঘটনা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মতামত বিশ্লেষণ এবং রিউমর স্ক্যানার টিমের নিজস্ব অনুসন্ধান শেষে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে সেদিন অভিযুক্ত শিক্ষক অভিযোগকারী ছাত্রলীগ নেতা এনায়েত উল্লাহকে ‘শালা’ নয় বরং ‘ছেলে’ বলেই সম্বোধন করেছেন। কিন্তু উক্ত ঘটনায় ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত শোরগোল এবং ঘটনার সাথে যুক্ত একাধিক পক্ষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত থাকার কারণে বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তির অবতারণা হয়ে থাকতে পারে।
মূলত, গত ৩০ জানুয়ারি রাতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের রেজা ই এলাহী সমর্থিত গ্রুপের কর্মী এবং মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আমিনুর বিশ্বাসের হলে প্রবেশে ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস সমর্থিত গ্রুপের নেতাকর্মীদের বাঁধা দানকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের বিবাদমান দুই পক্ষের মাঝে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর শিক্ষক অমিত দত্তের সঙ্গে ছাত্রলীগের ইলিয়াস সমর্থিত গ্রুপের নেতাকর্মীদের বাক বিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে শিক্ষক অমিত দত্ত ছাত্রলীগ নেতা এনায়েতকে এই ……..(অস্পষ্ট) আমি কে? বলে সম্বোধন করেন। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত শোরগোলের কারণে উক্ত ঘটনায় ধারণকৃত ভিডিওতে ‘এই’ এর পর আলোচিত সম্বোধনটি অস্পষ্টভাবে শোনা যায়। ঘটনা পরবর্তী উক্ত অস্পষ্ট সম্বোধনকে ‘শালা’ হিসেবে দাবি করে শিক্ষক অমিত দত্তের বিরুদ্ধে অশ্রাব্য গালিগালাজের অভিযোগ তুলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ। উক্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তমূলক শিরোনাম(‘এই শালা আমি কে!’ কুবিতে ছাত্রলীগকে সহকারী প্রক্টর) এবং বিস্তারিত সংবাদের শেষের অংশে মাত্র একবার অভিযোগ শব্দটি উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের বিস্তর অনুসন্ধান শেষে জানা যায়, ছাত্রলীগ নেতা এনায়েত উল্লাহকে শালা নয় বরং ছেলে বলেই সম্বোধন করেছেন শিক্ষক অমিত দত্ত।
সুতরাং, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর অমিত দত্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা এনায়েতকে ‘শালা’ নয় বরং ছেলে বলেই সম্বোধন করেছেন বলে রিউমর স্ক্যানারের দীর্ঘ অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তথ্যসূত্র
- Manabzamin- কুবি শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা সেই দুই ছাত্রলীগ নেতাকে শোকজ
- 10minuteschool blog- প্যারেডোলিয়ার খপ্পরে: যে ধোঁকায় আমরা সবাই বোকা
- Somoyjournal- শিক্ষককে হেয় করে পোস্ট দিতে কুবি শাখা ছাত্রলীগের চাপ প্রয়োগের অভিযোগ
- Amadersomoy- শোকজের উত্তর দিলেন কুবির দুই ছাত্রলীগ নেতা
- Rumor Scanner Own Analysis
- Rumor Scanner to Accused (Statement)
- Rumor Scanner to Complainant (Statement)
- Rumor Scanner to Eyewitness teachers and students (Statement)
- Rumor Scanner to Campus Journalists(Statement)