উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনার ‘সঠিক তথ্য’ প্রকাশ ও মঙ্গলবারের (২১ জুলাই) এইচএসসি পরীক্ষা দেরিতে স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে গতকাল (২২ জুলাই) শিক্ষার্থীরা সচিবালয় এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবের পদত্যাগ দাবি করেন। আন্দোলনে এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরাও খাতা পুনর্মূল্যায়নের দাবিতে যোগ দেয়। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলে পুলিশ লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে; পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সংঘর্ষ গুলিস্তান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
এসময় এক ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাকে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে দাবি করা হয়। পরে ভিডিওর একটি স্থিরচিত্র দেখিয়ে এসএ টিভিও একই দাবি প্রচার করে এবং তার কাছ থেকে বোমা উদ্ধার হয়েছে বলেও দাবি করে গণমাধ্যমটি।

এই দাবিতে এসএ টিভির ফেসবুক পেজে প্রচারিত পোস্ট দেখুন: এখানে।
একই দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন: এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।
ইন্সটাগ্রামে প্রচারিত দাবি দেখুন: এখানে, এখানে।
ইউটিউবে প্রচারিত দাবি দেখুন: এখানে, এখানে।
এক্সে প্রচারিত দাবি দেখুন: এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সচিবালয়ের সামনে থেকে আটক এই ব্যক্তি ছাত্রলীগের নেতা নন; তার নাম জাকির মাহমুদ। ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইল পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। এছাড়া, তাকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে বলেও জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক মোহাম্মদ রাকিব।
এই বিষয়ে অনুসন্ধানে ‘K.Z. Oualid Pradhan’ নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইলে গতকাল প্রকাশিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। সেখানে আলোচিত ব্যক্তিকে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার মুহূর্তের একটি ছবি যুক্ত করে দাবি করা হয়, তিনি পোস্টকারীর বন্ধু জাকির মাহমুদ এবং তারা একসময় দারুর রাশাদ মাদ্রাসায় একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। পোস্টকারী আরও দাবি করেন, জাকির একজন গুলিবিদ্ধ জুলাই যোদ্ধা, যার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই; বরং তিনি কট্টর আওয়ামী লীগবিরোধী।

‘Mujammil Haq Siam’ নামের আরেকটি ফেসবুক প্রোফাইলে প্রচারিত একটি পোস্টেও আটক ব্যক্তিকে জাকির মাহমুদ ও পোস্টকারীর বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেখানে দাবি করা হয়, জাকির ৮ জুলাই থেকেই জুলাই আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় ছিলেন।
এসব পোস্টের সূত্র ধরে আটক জাকির মাহমুদের ফেসবুক প্রোফাইল শনাক্ত করা সম্ভব হয়। প্রোফাইলটি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তিনিই সচিবালয়ের সামনে আটক হওয়া ব্যক্তি। পরবর্তীতে রিউমর স্ক্যানার টিম তার প্রোফাইল পর্যালোচনা করে।
গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ৪ আগস্ট তিনি নিজের একটি ছবি প্রোফাইল পিকচারে ব্যবহার করে ক্যাপশনে লেখেন, “বাবা-মায়ের বাধাও মেনে নেয়া হবেনা, এক দফার অসহযোগের পক্ষে নামার সময়!”
সেদিনই আন্দোলনের সময় রাজু ভাস্কর্যের সামনে তোলা একটি ছবি কভার ফটো হিসেবে ব্যবহার করে ক্যাপশনে লেখেন, “আবু সাঈদের রক্ত বৃথা যেতে দিবো না! মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু।”
জাকির মাহমুদের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে জানা যায়, তিনি গত বছরের ১৮ নভেম্বর ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নোটিশ বোর্ড (National University Notice Board BD)’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে একটি পোস্টে ছাত্রজনতার গণআন্দোলনে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, পেশাজীবী লীগ ও আওয়ামী লীগসহ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে ‘গুন্ডা বাহিনী’ আখ্যা দিয়ে দাবি করেন, তারা ছাত্রজনতার ওপর হামলা চালিয়ে আহত হয়েও নিজেদের আন্দোলনের ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে প্রচার করছে এবং অন্য আহতদের উসকানি দিচ্ছে। ওই পোস্টে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বানও জানান তিনি।
চলতি বছরের ২০ মার্চ তিনি নিজের ফেসবুকে ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ অথবা মৃত্যু’ লেখা একটি ব্যানার পোস্ট করেন এবং ক্যাপশনে লেখেন, “রক্ত লাগলে রক্ত নে, আওয়ামী লীগের কবর দে।”

তার ফেসবুক প্রোফাইল পর্যবেক্ষণ করে ছাত্রলীগের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম। বরং তাকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
এছাড়া, জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক মোহাম্মদ রাকিব গতকাল ফেসবুকে আটক জাকিরের ছবি পোস্ট করে জানান, তিনি মুক্তি পেয়েছেন।

বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার টিম সরাসরি জাকির মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি জানান, তিনি হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের কোনো সদস্য নন। তিনি আরও জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে তিনি আহত হয়েছিলেন এবং প্রমাণ হিসেবে আহত অবস্থার কিছু ছবিও সরবরাহ করেন।
তাছাড়া, আটক হওয়ার সময় জাকির মাহমুদের কাছ থেকে বোমা উদ্ধারের বিষয়ে কোনো বিশ্বস্ত সূত্রে তথ্য পাওয়া যায়নি। এসএ টিভি ছাড়া মূলধারার কোনো গণমাধ্যম কিংবা পুলিশও এ ধরনের দাবি করেনি।
সুতরাং, গতকাল (২২ জুলাই) সচিবালয়ের সামনে থেকে আটক ব্যক্তি ছাত্রলীগের নেতা দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s analysis.
- Zakir Mahmud: Facebook Profile
- Statement of Zakir Mahmud
- K.Z. Oualid Pradhan: Facebook Post
- Mujammil Haq Siam: Facebook Post
- Muhammad Rakib: Facebook Post