সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহার করে, “আমি দেশের সবাইকে ৫০০০ টাকা উপহার দিচ্ছি টাকা পেতে এখানে ক্লিক করুন” শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা দেশের সবাইকে ৫ হাজার করে টাকা উপহার দেওয়ার কোনো ঘোষণা দেননি বরং ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে প্রতারণার উদ্দেশ্যে উপহার প্রদানের এই প্রলোভন দেখানো হচ্ছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত পোস্টগুলোতে থাকা ওয়েবসাইট লিংকে প্রবেশ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
ওয়েবসাইটটিতে প্রবেশ করে একটু নিচে স্ক্রল করলেই টাকা পাওয়ার জন্য একটি ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে বলা হয়। ফর্মটিতে নাম, জেলা, কতদিন যাবৎ বিকাশ ব্যবহারকারী, এই মূহুর্তে (ফর্ম পূরণ করার মুহূর্তে) বিকাশ অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে এসব তথ্য জানতে চাওয়া হয়।
রিউমর স্ক্যানার টিমের একজন অনুসন্ধানকারী নিরাপত্তাজনিত কারণে ভুল তথ্য দিয়ে উক্ত ফর্ম পূরণ করে জমা দিলে এটি আরেকটি নতুন পেজে নিয়ে যায়। উক্ত নতুন পেজটিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করে রিউমর স্ক্যানার টিম। নতুন পেজের ইন্টারফেসটি হুবহু বিকাশে পেমেন্ট করার ইন্টারফেসের মতো। তাছাড়া, দাবি অনুসারে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানকারীর ৫ হাজার টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও নতুন ইন্টারফেসটি হচ্ছে কাউকে টাকা পেমেন্ট করার ইন্টারফেস। অধিকন্তু, এখানে পেমেন্ট গেটওয়ের জায়গায় শেখ হাসিনা বা সরকারি কোনো কিছুর বদলে “Bd Online Shop” নামটি দেখা যায়৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পূর্ববর্তী ফর্মে নিজের বিকাশ অ্যাকাউন্টে আছে হিসেবে উল্লেখ করা ২০,০০০ টাকাই এখানে পেমেন্টের পরিমাণ। এরপর বিকাশ অ্যাকাউন্ট নাম্বার চাওয়া হয়।
এ পর্যায়ে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানকারী বিকাশহীন নিজের একটি নাম্বার দিলে “Not a customer Wallet” লেখাটি প্রদর্শন করে, যা প্রমাণ করে এটি বিকাশের আসল পেমেন্ট পেজেই নিয়ে এসেছে৷ তাছাড়া এ বিষয়ে বিকাশের ডোমেইন নাম দেখেও নিশ্চিত হওয়া যায়৷
তবে, উক্ত একই ফর্ম একটু পর পুনরায় পূরণ করলে এবার পেমেন্ট গেটওয়ের জায়গায় “Amar Shop” নামে ভিন্ন আরেকটি নাম দেখা যায়। তবে আগের বারের মতো এবারও বিকাশ অ্যাকাউন্টে সর্বমোট উল্লেখ করা টাকার পরিমাণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেমেন্টের পরিমাণে চলে আসে।
তারপর সঠিক বিকাশ নাম্বার দিলে ওটিপি এবং পরবর্তীতে পাসওয়ার্ড চাওয়া হয়৷ অর্থাৎ, বিকাশ নাম্বার এবং পাসওয়ার্ড ঠিকভাবে বসালে অ্যাকাউন্টে থাকা তথা ফর্মে উল্লেখ করা টাকা প্রতারকের অ্যাকাউন্টে চলে যাবে। কিন্তু, নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানকারী এর পরবর্তী ধাপগুলো সম্পন্ন করেন নি।
উক্ত ফর্মের উপর আরেকটি তথ্য দেখতে পাওয়া যায় যেখানে লেখা রয়েছে, “সতর্কতা: যদি আপনার বিকাশে 30 হাজার টাকা এর বেশি থাকে তাহলে এখানে ক্লিক করুন।” ”এখানে ক্লিক করুন” শব্দগুচ্ছ অন্য আরেকটি পেজের লিঙ্কের সাথে হাইপারলিঙ্ক করা অবস্থায় লক্ষ্য করা যায়৷
“এখানে ক্লিক করুন” লিঙ্কে ক্লিক করলে এটি বিকাশের শপ পেজে নিয়ে যায়। তারপর সেখানে নিজের নাম লিখে Pay Now বাটনে ক্লিক করতে বলা হয়।
খালি স্থানে মনগড়া একটি শব্দ বসিয়ে Pay Now এ ক্লিক করলে এটি আগের মতোই পেমেন্ট পেজে নিয়ে যায়। তারপর আগের মতোই বিকাশ নাম্বার চাওয়া হয়। তবে, এবার টাকার পরিমাণ ৩০,০০০ এবং নাম হিসেবে দেখা যায় “BABLI SHOP”। অর্থাৎ, বিকাশ নাম্বার এবং পাসওয়ার্ড ঠিকভাবে দিলে অ্যাকাউন্টে থাকা ৩০,০০০ টাকা প্রতারকের অ্যাকাউন্টে চলে যাবে।
পরবর্তীতে, প্রধানমন্ত্রী এমন কোনো উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান করতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে গণমাধ্যম ও বিশ্বস্ত সূত্রে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইট এবং প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিলের ওয়েবসাইটেও এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে, কিওয়ার্ড সার্চ করে ২০২১ সালের ১৫ জানুয়ারি তারিখে প্রকাশিত দৈনিক ভোরের পাতার ওয়েবসাইটে “৬৬ হাজার পরিবার পাবে প্রধানমন্ত্রীর উপহার”, ২০২৩ সালের ২১ মার্চ তারিখে প্রকাশিত ভোরের কাগজের ওয়েবসাইটে “প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাবে আরও ৪০ হাজার পরিবার” শিরোনামে প্রধানমন্ত্রীর উপহার মর্মে একাধিক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রথম প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে পর্যায়ক্রমে দেশের প্রায় ৯ লাখ ভূমি ও গৃহহীন অসহায় পরিবার বসবাসের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাচ্ছেন পাকা ঘর। এরই ধারাবাহিকতায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় চলতি মাসেই ৬৬ হাজার পরিবার পাবে প্রধানমন্ত্রীর এ উপহার।”
দ্বিতীয় প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় চতুর্থ পর্যায়ে ৩৯ হাজার ৩৬৫টি ঘর হস্তান্তর করা হবে। তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের তিনটি উপজেলায় যুক্ত হয়ে চতুর্থ পর্যায়ের ঘর ও জমি হস্তান্তর করবেন।”
অতঃপর, প্রচারিত দাবিতে ব্যবহৃত News 24 এর লোগোসমৃদ্ধ ছবিটির উৎসের সন্ধান করলে News 24 এ গত ১লা মে তারিখে “শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত করলে ছাড় নেই: প্রধানমন্ত্রী | News24” শিরোনামে প্রচারিত একটি সংবাদ পাওয়া যায়৷
প্রচারিত দাবিতে ব্যবহৃত ছবির সাথে News 24 এর সংবাদের থাম্বনেইলের তুলনা করলে দেখা যায়, প্রতারণার উদ্দেশ্য মূল থাম্বনেইলকে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে বিকৃত করে দেশের সবাইকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫ হাজার টাকা দেওয়ার দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
মূলত, গত ০১ মে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল
News 24 এর ইউটিউব চ্যানেলে “শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত করলে ছাড় নেই: প্রধানমন্ত্রী” শিরোনামে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উক্ত ভিডিওর থাম্বনেইলের শিরোনাম ছিল- ‘খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ’। পরবর্তীতে এই ভিডিওর থাম্বনেইলের শিরোনাম ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সবাইকে ৫ হাজার টাকা করে দিবেন দাবিতে একটি থাম্বনেইল একটি লিঙ্কের ফিচার ছবি আকারে প্রচার করা হয়৷ উক্ত দাবিতে ব্যবহৃত লিঙ্কে ক্লিক করলে এটি টাকা দেওয়ার বদলে বরং অ্যাকাউন্টে থাকা সব টাকা পেমেন্ট হিসেবে নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন কোনো ঘোষণা দেননি।
সুতরাং, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে ৫ হাজার টাকা করে দিবেন দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও প্রতারণামূলক।
তথ্যসূত্র
- Prime Minister’s Office – Website
- Prime Minister’s National Relief Fund – Website
- Daily Vorer Pata – ৬৬ হাজার পরিবার পাবে প্রধানমন্ত্রীর উপহার
- Vorer Kagoj – প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাবে আরও ৪০ হাজার পরিবার
- News 24 – শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত করলে ছাড় নেই: প্রধানমন্ত্রী | News24
- Rumor Scanner’s own analysis