সম্প্রতি অনলাইনে একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, এবার ধর্ষিতার (তনু) কারণে চাকরি গেল সেনাপ্রধানের, নতুন সেনাপ্রধান হলেন গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।
এরূপ দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি উক্ত ভিডিওটি ৬১ হাজারেরও অধিক বার দেখা হয়েছে এবং ২ হাজারেরও অধিক পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওটিতে লাইক দেওয়া হয়েছে।

এরূপ দাবিতে টিকটকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি উক্ত ভিডিওটি ২ লক্ষ ৮৫ হাজারেরও অধিক বার দেখা হয়েছে এবং ১১ হাজারেরও অধিক পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওটিতে লাইক দেওয়া হয়েছে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আজমের ছেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী নতুন সেনাপ্রধান হয়েছেন শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে সেনাপ্রধান হিসেবে এখনও জেনারেল ওয়াকার উজ জামান দায়িত্বরত আছেন।
অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করলে তাতে আলোচিত দাবিটির সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভিডিওটিতে সাংবাদিক, গায়িকা ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর নবনীতা চৌধুরীর একটি ভিডিওর সংযুক্তি পাওয়া যায় যেখানে নবনীতা চৌধুরীকে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী ও বাংলাদেশের বিষয়ে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায়। এছাড়াও, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে আলোচিত তনু হত্যার বিষয়েও উল্লেখ করা হয়।
সংযুক্ত নবনীতা চৌধুরীর ভিডিওর বিষয়ে অনুসন্ধান করলে নবনীতা চৌধুরীর ইউটিউব চ্যানেলে ‘সেনাপ্রধান হচ্ছেন গোলাম আজমের ছেলে?’ শিরোনামে গত ২০ আগস্টে প্রচারিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। নবনীতা চৌধুরীর উক্ত ভিডিওটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে সংযুক্ত নবনীতার ভিডিওটির সাথে তুলনা করলে মিল পাওয়া যায় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে নবনীতা চৌধুরীর উক্ত ভিডিও আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে সংযুক্ত করা হয়েছে।

তবে নবনীতা চৌধুরী তার ভিডিওতে বলেননি যে, আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বরং এ বিষয়ে দাবি করেন, পাকিস্তান ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ক্যাচলাইন’ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যাতে আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং এক্ষেত্রে তিনি নিজের প্রশ্ন উল্লেখ করেন।
পরবর্তী অনুসন্ধানে কথিত পাকিস্তান ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ক্যাচলাইন’ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত উল্লিখিত প্রতিবেদনটি ‘East Pakistan Must Return: Pakistan’s Hour of Reckoning After 54 Years’ শিরোনামে গত ১৬ আগস্টে প্রকাশ হতে দেখা যায়। প্রতিবেদনটির এক পর্যায়ে বলা হয়, “ভারতের আধিপত্য থেকে মুক্ত বাংলাদেশে প্রফেসর ড. ইউনুস পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। ২০২৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার আজমির বিরুদ্ধে জারিকৃত বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয় এবং তাকে পূর্ণ সুযোগ-সুবিধাসহ অবসর প্রদান করা হয়। তবে এটিকে প্রকৃত ন্যায়বিচার বলা যায় না। আজমির মতো যোগ্য ব্যক্তির উচিত পুনর্বহাল হওয়া, চার তারকা জেনারেল পদে পদোন্নতি পাওয়া এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ লাভ করা। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে ড. ইউনুসের উচিত তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা—উভয় পদে নিয়োগ দেওয়া, যেখানে তার কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য অমূল্য হবে।” (অনূদিত)
আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির থাম্বনেল ও শুরুর অংশ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর পাশে বসে কোনো একটা নথিতে স্বাক্ষর করছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। ছবিটি পর্যবেক্ষণ করলে তাতে রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানের অবস্থানে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া, পেছনে থাকা রাষ্ট্রপতির পতাকায় ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দের বদলে ‘রাজৃপতি’ শব্দ দেখা যায় যা সাধারণত এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি বা পরিমার্জিত কনটেন্টে পরিলক্ষিত হয়।

এছাড়া, থাম্বনেল ও ভিডিওর শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাশে ফুলের মালা গলায় আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থার একটি ছবিও সংযুক্ত করা হয়। উক্ত ছবিটি পর্যবেক্ষণ করলেও তাতে মুহাম্মদ ইউনূসের ত্বক, অঙ্গভঙ্গিতে অস্বাভাবিকতা ও আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর বুকে লেখা বিকৃত অক্ষর দেখা যায় যা সাধারণত এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি বা পরিমার্জিত কনটেন্টে পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীতে উক্ত ছবিগুলো নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে কোনো মূলধারার গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য সূত্রে আলোচিত ছবিগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে থাম্বনেল ও ভিডিওর শুরুতে সংযুক্ত প্রচারিত ছবিগুলো মূলত এআই প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি।
এছাড়াও, প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলেও সেনাপ্রধান পদ থেকে জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের পদত্যাগ বা নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর নিয়োগের বিষয়ে মূলধারার গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে এরূপ কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে তা মূলধারার গণমাধ্যমে প্রচার করা হতো।
এছাড়া, আলোচিত দাবিটি মূলত গত ২২ আগস্টে প্রচার করা হয়েছে। এদিকে গত ২১ আগস্টে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এর ফেসবুক পেজে প্রচারিত এক পোস্টে জানানো হয়, “সরকারী সফরে আজ ২১ আগস্ট ২০২৫ চীন গমন করলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, এসবিপি, ওএসপি, এসজিপি, পিএসসি। সফরকালে, তিনি চীনের সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্ট দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা উন্নয়নের লক্ষ্যে মতবিনিময় করবেন। সফর শেষে সেনাবাহিনী প্রধান আগামী ২৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন।”
সুতরাং, সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী নতুন সেনাপ্রধান হয়েছেন শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Nobonita Chowdhury – সেনাপ্রধান হচ্ছেন গোলাম আজমের ছেলে? ।। Nobonita Chowdhury
- ISPR Bangladesh – Facebook Post
- Rumor Scanner’s analysis