প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাকিবকে এমপি পদ থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেননি 

সম্প্রতি, হবিগঞ্জ- ৪ আসনের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে মারতে যাওয়ায় মাগুরা-১ আসনের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে  এমপি থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শীর্ষক দাবিতে ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম ইউটিউবে Sports Channel নামের একটি অ্যাকাউন্ট হতে একটি ভিডিও (আর্কাইভ) প্রচার করা হয়েছে।

 সাকিব

ভিডিওটি এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি প্রায় ১১ লক্ষ ৭৮ হাজারবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির কমেন্ট বক্সে প্রায় ২ হাজার ৮ শতবার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নেটিজেনরা। এর মধ্যে অধিকাংশই ভিডিওর সংবাদ সত্য ধরে নিয়ে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন।

উক্ত ভিডিওটি ডাউনলোড করে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত আরও ভিডিও পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যারিস্টার সুমনকে মারতে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সাকিব আল হাসানকে এমপি থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেওয়ার দাবিটি মিথ্যা বরং ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনার মাধ্যমে ভিন্ন দুইটি ঘটনার ভিডিও ক্লিপ এবং ছবি যুক্ত করে আলোচিত দাবিতে ভিডিওটি প্রচার করা হয়েছে। 

আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ভিডিও ক্লিপ রয়েছে। পরবর্তীতে ব্যারিস্টার সুমনের বক্তব্য দেওয়া একটি ভিডিও ক্লিপ প্রচার করতে দেখা যায়। এরপর সাকিব আল হাসান এবং ব্যারিস্টার সুমনের বেশ কয়েকটি ছবি যুক্ত করে কোনো তথ্যপ্রমাণ ব্যতীত উপস্থাপককে কিছু কথা বলতে শোনা যায়। 

ভিডিওটিতে উপস্থাপক বলেন, এবার ব্যারিস্টার সুমনকে মারতে যাওয়ার কারণে সাকিবকে এমপি থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মাগুর-১ এবং হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে নব নির্বাচিত এমপি হয়েছের সাকিব আল হাসান এবং ব্যারিস্টার সুমন। এরপর তাদের দুজনের মধ্যে পুরোনো শত্রুতা জেগে উঠেছে। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ এবং ভারতের ওয়ান-ডে সিরিজ চলাকালীন এক হোটেলে বিসিবি কর্মকর্তা এবং পুলিশদের সামনে ব্যারিস্টার সুমনকে মারতে গিয়েছিল সাকিব আল হাসান। সেখান থেকেই তাদের মধ্যে একটি শত্রুতা তৈরি হয়েছে। এছাড়াও মাঠের ক্রিকেটে নানা ঘটনা এবং নির্বাচনে ভোটের দিন এক ভোটারকে পিটিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সাকিব আল হাসান। আর এই খবর ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছেছে। আরেকবার সাকিবকে কঠিন এক হুশিয়ারী দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেন, সেলিব্রিটি বলেই রাজনীতির মাঠে ভোটারকে পেটানো এবং ব্যারিস্টার সুমনকে মারতে যাওয়া এটা চরম ধরনের বেয়াদবি। পরবর্তীতে এধরনের ঘটনা ঘটালে সাকিবের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

ভিডিও যাচাই-১ 

এই অংশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, “এবং এই ঘটনার পরে…”

উক্ত ভিডিওর কিছু কি ফ্রেম কেটে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে এখন টিভি’র ইউটিউব চ্যানেলে গতবছরের ৩১ অক্টোবর “খুনিদের সঙ্গে সংলাপ নয়: প্রধানমন্ত্রী” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত শেখ হাসিনার একটি সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। 

উক্ত ভিডিওটির সাথে আলোচিত ভিডিওটির হুবহু মিল রয়েছে। 

Video Comparison: Rumor Scanner 

উক্ত ভিডিও ক্লিপটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ১৬ মিনিটে এক সাংবাদিক বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে করা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,.. ২৮ তারিখে তাদের যে ঘটনা, বিএনপি যেসমস্ত ঘটনা ঘটালো। বিশেষকরে যেভাবে পুলিশ হত্যা করেছ মানে মাটিতে ফেলে যেভাবে কুপালো, সাংবাদিকদের উপর হামলা, সাংবাদিকদের ধরে পিটানো, মারা, তাদের উপর হামলা করা এবং এই ঘটনার পরে জনগণের ধিক্কার ছাড়া বিএনপির আর কিছুই জুটবে না। 

অর্থাৎ, উক্ত অনুষ্ঠানে বিএনপিকে সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া দীর্ঘ একটি বক্তব্যের কিছু অংশ কেটে আলোচিত ভিডিওতে যুক্ত করা হয়েছে। 

ভিডিও যাচাই-২ 

উক্ত ভিডিওতে ব্যারিস্টার সুমনকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। গুগলে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানে কালবেলা’র ইউটিউব চ্যানেলে গতবছরের ১৬ মার্চ “ব্যারিস্টার সুমনকে মারতে গিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। 

উক্ত ভিডিওটির সাথে আলোচিত ভিডিওটির হুবহু মিল রয়েছে। 

Video Comparison: Rumor Scanner 

কালবেলার উক্ত ভিডিওটিতে ব্যারিস্টার সুমনকে বলতে শোনা যায়, সাকিব আল হাসানের ব্যাপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে সে বাংলাদেশের একজন সেলিব্রিটি। তার নিজেরই তো একটা বিবেক থাকা দরকার যে কোন জায়গায় উনি যাবেন, কোন জায়গায় উনি যাবেননা। উনি যদি তারপরও মনে করে এরকম একজন হত্যাকারী বা হত্যাকাণ্ডের আসামি তার এখানে যাবেন, আর যদি এতে উনি লজ্জাবোধ না করেন, তাহলে আমার আসলে কিছু বলার নাই। কারণ হচ্ছে যে সাকিব আল হাসানেরও অনেক বড় ফ্যান ফলোয়ার আছে। কিছু বললেই হয়তো ফ্যান ফলোয়াররা খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠে যে এরকম একজন ভালো প্লেয়ার। কিন্তু একজন ভালো প্লেয়ারের সাথে একজন ভালো মানুষ হওয়াও কিন্তু জরুরি। সাকিব আল হাসান কিন্তু কোনো সমালোচনা নিতে পারেনা। তারে কোনো সমালোচনা করলে সে মারতে আসে। সে এ ধরণের মানসিকতার লোক। আর আমিতো ভাই নিরীহ লোক। আমি এরকম কেউ যদি মারতে আসতে আসে এরকম লোকের ব্যাপারে কথা বলতে চাইনা। কারণ আমার আপনারা জানেন কিছুদিন আগে আমি তার জুয়াতে ইনভলভ হওয়া নিয়ে একটা বক্তব্য দিছিলাম। এই কারণে হোটেল সোনারগাঁওতে সে আমারে মারতে আসছিল। আমাকে দেখেই পুলিশ টুলিশের সামনে মারতে আসছে। তখন আমিতো আশ্চর্য হয়ে গেছি একজন সেলিব্রিটি যিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ক্রিকেটে উনি একজন সামান্য সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। এখন সমস্যা হচ্ছে ঢ়ে আল্লাহ তারে ক্ষমতা দিছেন সে সেলিব্রিটি হইছে, অনেক মানুষের জনপ্রিয়তা। এখন সে মারলেও তো মানুষ আমার বিচার নিবে না। বলবে যে সে সেলিব্রিটি সে মারতেই পারে সে। এজন্য ভাই এখান থেকে আমি একটু বিরত থাকতে চাই।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ১৫ মার্চ ডুবাইয়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশে পুলিশ সদস্য হত্যা মামলার পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানের জুয়েলারি দোকান উদ্বোধন করেন সাকিব। এর প্রেক্ষিতে পরদিন ১৬ মার্চ সাকিবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। যেখানে তিনি কিছুদিন পূর্বে ভারত-বাংলাদেশ সিরিজ চলাকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে সাকিব কর্তৃক হামলা চেষ্টার শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলেন।

এই ভিডিও বার্তার বিষয়ে তার মতামত নিয়ে কালবেলা তাদের ইউটিউবে ভিডিও প্রকাশ করে। অর্থাৎ এই ভিডিওটি ২০২৩ সালের এবং ভিডিওতে বর্নিত ঘটনাটিও সেসময়কার। অন্যদিকে সালে সাকিব আল হাসান এমপি নির্বাচিত হয়েছেন এ বছরের ৭ জানুয়ারি। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে কালবেলায় প্রকাশিত ৩ মিনিট ৭ সেকেন্ডের ভিডিওটির শুরুর কয়েকটি সেকেন্ডে ব্যারিস্টার সুমনের দেওয়া বক্তব্য কেটে আলোচিত ভিডিওটিতে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আলোচিত দাবির সাথে সুমনের এই বক্তব্যের কোনো সম্পর্ক নেই। 

এছাড়া, আলোচিত বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে গণমাধ্যম এবং বিশ্বস্ত সামাজিক মাধ্যমে এসংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

মূলত, গত ০৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনের জয়লাভ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এবং মাগুরা-১ (শ্রীপুর ও সদরের একাংশ) আসন থেকে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। এরপর গত ১০ জানুয়ারি সংসদে ২৯৮ জন সংসদ সদস্যকে শপথ বাক্য পাঠ করান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। এরইমধ্যে ব্যারিস্টার সুমনকে মারতে যাওয়ায় সাকিবকে এমপি থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেন প্রধানমন্ত্রী– শীর্ষক ক্যাপশনে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলোচিত দাবিটি মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে, পুরোনো ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার ভিডিও ক্লিপ এবং ছবি যুক্ত করে আলোচিত দাবিরভিডিওটি প্রচার করা হয়েছে। 

সুতরাং, ব্যারিস্টার সুমনকে মারতে যাওয়ায় সাকিবকে এমপি থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেন প্রধানমন্ত্রী- শীর্ষক দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img