সম্প্রতি, মৃত মানুষের হাড্ডি দিয়ে সুস্বাদু হালিম ও নেহারি তৈরি করা হচ্ছে দাবিতে একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে প্রচার করা হয়েছে।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
এ বিষয়ে ফেসবুকে সর্বাধিক ভাইরাল ভিডিওটি প্রায় ৭০ লাখ বার দেখা হয়েছে। ভিডিওটি ১ লাখ ১৬ হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে৷ ভিডিওটিতে প্রায় ৭ হাজার টি মন্তব্য করা হয়েছে, যার অধিকাংশই নেতিবাচক।
উক্ত দাবিতে প্রচারিত সমজাতীয় ইউটিউব ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মৃত মানুষের হাড্ডি দিয়ে হালিম ও নেহারি তৈরির বিষয়টি সঠিক নয় বরং কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ভিন্ন ঘটনার ভিডিও ব্যবহার করে ভিত্তিহীনভাবে উক্ত বিষয়টি প্রচার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। এ বিষয়ে ফেসবুকে এবং ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দুটিতে প্রায় একই ধরনের তথ্য প্রচার করা হলেও ফেসবুকের ভিডিওটিতে লাশ চুরি বিষয়ক একটি ভিন্ন ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করা হয়েছে।
ভিডিওগুলোতে বলা হয়, রাজধানীতে মৃত মানুষের তথা লাশের হাড্ডি দিয়ে হালিম বিক্রেতারা পায়া, নেহারি এবং নলী বিক্রি করছে গ্রাহকদের কাছে। সম্প্রতি কয়েকজন হালিম বিক্রেতাদের ওপর গোয়েন্দারা নজর রাখে এবং রাতের আধারে তাদের অনুসরণ করে নির্জন গ্রামাঞ্চলে ঢুকে তাদেরকে সদ্য কবর দেওয়া মানুষদের লাশ তুলে আনতে দেখে। সেই লাশের মাংস কেটে হালিম তৈরি করা হয় এবং হাড় দিয়ে পায়া, নলি ও নেহারি তৈরি করে মানুষের কাছে বিক্রি করে। তাছাড়া উক্ত ভিডিওগুলোতে বিভিন্ন সময়ে রেস্তোরাঁয় হালিম বিক্রির ভিডিও ক্লিপ ও এ সম্পর্কিত বিভিন্ন স্থিরচিত্র বা ছবি দেখানো হয়।
ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিওটিতে মৃত মানুষের হাড্ডি দিয়ে হালিম তৈরির প্রমাণ হিসেবে লাশ চুরি বিষয়ক একটি ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। বলা হয়, এই ব্যক্তি লাশ চুরি করে তা দিয়ে হালিম তৈরি করতো। তবে উক্ত ভিডিও ক্লিপটি পর্যবেক্ষণ করে সেরকম কোনো বিষয় পাওয়া যায়নি। সেখানে শুধুমাত্র লাশ চুরির দায়ে অভিযুক্ত এক ব্যক্তিকে দেখা যায়।
বিষয়টি যাচাইয়ে এই ভিডিওটি থেকে কিছু স্থিরচিত্র নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে IFAT MAHBUB নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২০২১ সালের ১২ আগস্ট ‘লাশ চুরি করতে গিয়ে চোর হাতেনাতে ধরা’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত ভিডিওটির একটি অংশের সাথে আলোচিত ভিডিওটির উক্ত অংশের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
উক্ত ভিডিও থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের ১০ আগস্ট গাজীপুরে কবরস্থান থেকে কঙ্কাল চুরি করতে গিয়ে এক তরুণ আটক হন। তবে সেখানে হালিম তৈরির উদ্দেশ্যে লাশ চুরি করা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে সে সময় মূলধারার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
অর্থাৎ, এই ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় বরং প্রায় আড়াই বছর পূর্বের এবং এর সাথে মৃত মানুষের হাড্ডি দিয়ে হালিম তৈরির দাবির কোনো সম্পর্ক নেই। তাছাড়া সে সময়ে ইন্টারনেটে এমন কোনো দাবি প্রচার হতে দেখা যায়নি।
এছাড়াও, গণমাধ্যম কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্যকোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে এখন পর্যন্ত মানুষের লাশ চুরি করে তা দিয়ে হালিম বা নেহারি তৈরির বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তাছাড়া, আলোচিত ভিডিওতে কুকুরের মাংস হালিমে মিশিয়ে দেওয়া হয় বলে দাবি করা হলেও গণমাধ্যম কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্যকোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে সাম্প্রতিক সময়ে উক্ত দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এধরণের প্রচারণা পরবর্তী সময়ে মিথ্যা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা যায়।
২০২৩ সালের মার্চে রাজধানীর গুলশানে সুলতান’স ডাইন রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে কাচ্চিতে খাসির মাংসের বদলে অন্য প্রাণির মাংস দেওয়ার অভিযোগ ওঠে৷ এরপর বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হলে এ নিয়ে যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই নেতিবাচক তথ্য প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে ভোক্তা অধিদপ্তর রেস্টুরেন্টটিতে অভিযোগ চালায়। সে সময় সেখানে অন্য প্রাণির মাংস ব্যবহারের প্রমাণ পায়নি ভোক্তা অধিদপ্তর। পরবর্তীতে পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে খাশির মাংসই ছিল, কুকুর-বিড়ালের মাংস ছিল না।
এর আগেও সাভারের আশুলিয়ায় কুকুরের মাংস দিয়ে কাচ্চি বিক্রির অভিযোগ ওঠে এক হোটেল মালিকের বিরুদ্ধে। তখন ল্যাব রিপোর্ট প্রকাশের আগেই হোটেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ল্যাব রিপোর্টে জানা যায়, সেই মাংস কুকুরের ছিল না।
মূলত, মৃত মানুষের মানুষের হাড্ডি দিয়ে সুস্বাদু হালিম ও নেহারি তৈরি করা হচ্ছে দাবিতে একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত বিষয়টি সঠিক নয়। ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিওটিতে মৃত মানুষের হাড্ডি দিয়ে হালিম তৈরির প্রমাণ হিসেবে লাশ চুরি বিষয়ক একটি ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। ভিডিওতে এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে বলা হয়, এই ব্যক্তি লাশ চুরি করে তা দিয়ে হালিম তৈরি করতো। তবে উক্ত ভিডিও ক্লিপটি পর্যবেক্ষণ করে সেরকম কোনো বিষয় পাওয়া যায়নি। সেখানে ২০২১ সালের আগস্টে গাজীপুরে লাশ চুরির দায়ে অভিযুক্ত এক ব্যক্তিকে দেখা যায়, যার সাথে মৃত মানুষের হাড্ডি দিয়ে হালিম বিক্রির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এছাড়া, গণমাধ্যম বা অন্যকোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে মৃত মানুষের হাড্ডি দিয়ে হালিম ও নেহারি তৈরির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, মৃত মানুষের হাড্ডি দিয়ে হালিম ও নেহারি তৈরি করা হচ্ছে দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- IFAT MAHBUB YouTube: লাশ চুরি করতে গিয়ে চোর হাতেনাতে ধরা
- Jugantor: কবর খুঁড়ে কঙ্কাল চুরি করতে গিয়ে যুবক ধরা
- Desh Rupantor: সুলতান’স ডাইনের কাচ্চিতে কুকুর-বিড়াল নয়, খাসিই ছিল
- Jagonews24: আশুলিয়ার সেই হোটেলে বিরিয়ানিতে দেওয়া মাংস কুকুরের ছিল না
- Rumor Scanner’s Own Analysis