সম্প্রতি, “ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত কর্মীদের হাতে গণপিটুনি খেয়েছে মেয়রের পিএস” শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত হয়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ছয় দফা দাবির মানববন্ধনে বাঁধা দেওয়ার অভিযোগে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হাতে গণপিটুনির শিকার ব্যক্তি মেয়র তাপসের পিএস নয় বরং ঐ ব্যক্তি পেশায় একজন সার্জিক্যাল ব্যবসায়ী এবং তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক। তার নাম মো. তৌহিদ।
রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে মূলধারার জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক এর ফেসবুক পেজে গত ২১ অক্টোবর “সাংবাদিক এর ভুয়া পরিচয় দেবার পর যা হলো” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সাথে আলোচিত ভিডিওর বেশকিছু অংশের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।

আলোচিত ভিডিওটি পর্যালোচনা করা দেখা যায়, কিছু বিক্ষুদ্ধ লোক এক ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করছেন।

ইত্তেফাকের ভিডিও প্রতিবেদনে ১:০০ মিনিট হতে ১:০৭ মিনিট পর্যন্ত বিক্ষুদ্ধ এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়,
‘আমরা সিটি কর্পোরেশনের স্টাফ, আমরা আসছি এখানে আন্দোলন করে আমাদের দাবি পূরণ করতে।’ কিন্তু উনি এসে আমাদের ধরেছে’।
ভিডিওতে একই ব্যক্তিকে ১:২৯ মিনিট হতে ১:৩৫ মিনিট পর্যন্ত বলতে শোনা যায়,
‘উনি এসে আমাদের পরিচয় চাচ্ছে। উনি সাংবাদিক পরিচয় দিচ্ছে আমাদেরকে। কিন্তু উনি আসলে সাংবাদিক না, উনি হলো ভুয়া সাংবাদিক’।
প্রতিবেদনের ২:০৭ হতে ২:২০ মিনিট হতে পর্যন্ত বলতে শোনা যায়,
‘আমাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে আমরা এখানে এসেছি। কিন্তু উনি এসে বলতেছে আমাদের কোনো চাকরি নেই। আমরা নাকি এখানে ভাড়া হিসেবে এসেছি। তাই ওখানে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে। সবাই মিলেই দিয়েছে যারা ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে লোকগুলো, যাদের বলছে যে চাকরি নাই আমরা এখানে দালাল হিসেবে আসছি।’

তাছাড়া প্রতিবেদনে ১:৩৬ মিনিট হতে ২:০০ মিনিট পর্যন্ত অন্য একজন বিক্ষুব্ধ শ্রমিককে বলতে শোনা যায়,
‘সে আমাদেরকে বলছে আমরা নাকি চাকরি পাইলে বদলি দিয়ে খাই। আমরা কাজ করি না। সে কী কারণে বলবে। আমার ২০ বছরের সার্ভিসিং, সেই সার্ভিসিং মেয়রেরও নেই। সে বলে, আমরা বলে সব বদলি মাল। আমরা নাকি কাজ করে খাই না। আমরা কাজ করে খাই। আজ ৪ মাস ধরে আমাদের বেতন …..(বকেয়া)। সে এসে কীভাবে আমাদের বুকে থাপ্পড় দেয়? আমাদের চ্যালেঞ্জ করে।’

অন্যদিকে, ভিডিও প্রতিবেদনটির ১:২৫ মিনিট থেকে ১:২৫ পর্যন্ত অংশে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে হেনস্তার শিকার হওয়া ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়,
‘ওরা বিএনপির লোকরা এসেছে। ওরা সব বিএনপির লোকরা এসেছে। ওরা মেয়রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে।’
পরবর্তীতে, ইত্তেফাকের প্রতিবেদন হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে মূলধারার জাতীয় দৈনিক সমকালের অনলাইন সংস্করণে গত ২০ অক্টোবর “চাকরিচ্যুত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ওপর মেয়রপন্থীদের হামলার অভিযোগ” শীর্ষক দাবিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

সমকালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ২০ অক্টোবর ছয় দফা দাবিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চাকরিচ্যুত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মানববন্ধন চলাকালে মেয়র তাপসপন্থী লোকজন কর্তৃক আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা অভিযোগ উঠে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মানববন্ধনে বাঁধা দানকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা দুই পক্ষকে দুই দিকে সরিয়ে দেয়।

একই দাবিতে মূলধারার অনলাইন গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন ও জাগোনিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
এদিকে, আলোচিত ভিডিওতে দৃশ্যমান মারধরের শিকার ব্যক্তিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের পিএস দাবি করে ফেসবুকে প্রচার করা হলেও রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে উক্ত দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মেয়র তাপসের একান্ত সচিব অর্থাৎ পিএস হিসেবে কর্মরত আছেন মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান(উপসচিব)। মেয়রের সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন নাছিরুল হাসান সজীব এবং মেয়ের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কর্মরত আছেন মনিরুল ইসলাম কবির। ওয়েবসাইটে এই তিন ব্যক্তির নামের পাশে সংযুক্ত ছবির সাথেও আলোচিত ভিডিওতে দৃশ্যমান মারধরের শিকার ব্যক্তির ছবির বা চেহেরার মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে উক্ত ব্যক্তির পরিচয় খুঁজতে গিয়ে মূলধারার গণমাধ্যম বাংলা ভিশন এর ওয়েবসাইটে “জানা গেল পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ধাওয়া খেয়ে পালানো ব্যক্তির পরিচয়” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হাতে লাঞ্চিত হওয়া ওই ব্যক্তির নাম মো. তৌহিদ। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক। পেশায় একজন সার্জিক্যাল ব্যবসায়ী।

প্রতিবেদনটি থেকে আরো জানা যায়, আলোচিত ঘটনায় গত রবিবার (২৩ অক্টোবর) ৫০-৬০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে শাহবাগ থানায় হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেছেন লাঞ্চনার শিকার মোহাম্মদ তৌহিদ। মামলায় নগদ ৪৮ হাজার টাকা এবং ১৮শ’ টাকা মূল্যের একটি সিম্পনি মোবাইল চুরির অভিযোগও করা হয়েছে।

একই ঘটনা নিয়ে ‘বাংলা ভিশন’ এর ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদন হতেও আলোচিত ভিডিও সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়।
মূলত, গত ২০ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’-এর ব্যানারে চাকরিচ্যুতির আদেশ বাতিল করে পুনর্বহালসহ ছয় দফা দাবিতে মানববন্ধন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চাকরিচ্যুত পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। উক্ত মানববন্ধনে বাঁধা দেওয়ার অভিযোগে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কর্তৃক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের পিএসকে গণধোলাই দেওয়া হয়েছে দাবিতে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনির একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, গণপিটুনির শিকার ব্যক্তি মেয়রের পিএস নয়। তার নাম মো. তৌহিদ। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের নেতা এবং তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। অন্যদিকে বর্তমানে মেয়র তাপসের পিএস হিসেবে কর্মরত আছেন উপসচিব মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান।

প্রসঙ্গত, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চাকরিচ্যুত পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা চাকরি পুনর্বহালসহ ছয়দফা দাবিতে মানববন্ধন করেছেন। তাদের ছয়দফা দাবিগুলো নিম্নরুপ-
১. ১৯৯২ সালের ১০ জুন জারিকৃত ৯৭৯ আদেশ পুনর্বহাল করতে হবে।
২. পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অবসরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পোষ্য কোটায় চাকরি এবং অবসরে যাওয়া কর্মীদের এককালীন ১০ লাখ টাকা দিতে হবে।
৩. কর্মরত অবস্থায় কোনো কর্মী মৃত্যুবরণ করলে সরকারি বিধি মোতাবেক ৮ লাখ টাকা দিতে হবে।
৪. ঠিকাভিত্তিক পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে এবং স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড ওয়াকার্স ইউনিয়নের নেতাকর্মী ও অন্যান্য পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে কর্মচ্যুত আদেশ বাতিলপূর্বক পুনর্বহাল করতে হবে।
৫. কয়েকশ বছর ধরে বসবাসকারি কোনো পরিবারকে বাসস্থানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
৬. পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।

উল্লেখ্য, শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর কয়েকদফায় বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে বেশকিছু সংখ্যক পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও মালীকে চাকরিচ্যুত করেছেন।

সুতরাং, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের ছয়দফা দাবির আন্দোলনে কর্মীদের হাতে গণপিটুনি খাওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতাকে মেয়র তাপসের পিএস দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে; যা সঠিক নয়।
তথ্যসূত্র
- ইত্তেফাক: সাংবাদিক এর ভুয়া পরিচয় দেবার পর যা হলো
- সমকাল: চাকরিচ্যুত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ওপর মেয়রপন্থীদের হামলার অভিযোগ
- বাংলা ট্রিবিউন: চাকরিচ্যুত পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ওপর মেয়রপন্থীদের হামলার অভিযোগ
- জাগোনিউজ২৪: চাকরিচ্যুত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আন্দোলনে মেয়রপন্থিদের বাধা
- বাংলা ভিশন: জানা গেল পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ধাওয়া খেয়ে পালানো ব্যক্তির পরিচয়
- বাংলা ভিশন: পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ধাওয়া খেয়ে পালাচ্ছিলেন কে এই তৌহিদ?
- বাংলা ট্রিবিউন: বেতনের দাবিতে ডিএসসিসির হিসাবরক্ষণ দফতরে কর্মীদের ‘হামলা’: ৪ শ্রমিক কর্মচ্যুত
- সারাবাংলা: বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ায় ডিএসসিসি’র ৭ কর্মী কর্মচ্যুত
- ইত্তেফাক: বিভিন্ন অপরাধে পাঁচ মাসে ডিএনসিসির পাঁচ শ্রমিক চাকরিচ্যুত