প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদানের ভাইরাল ক্যাম্পেইনটি ভুয়া

সম্প্রতি “PMYP প্রধানমন্ত্রী ল্যাপটপ স্কিম 2024 আবেদনপত্র গ্রহণ করা শুরু করেছে” শীর্ষক আর্থিক সীমাবদ্ধতায় থাকা মানুষদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদানের একটি ক্যাম্পেইন লিংক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। 

বিনামূল্যে ল্যাপটপ

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর নাম জড়িয়ে আর্থিক সীমাবদ্ধতায় থাকা মানুষদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদানের ক্যাম্পেইনটি আসল নয় বরং প্রতারণার উদ্দেশ্য এই ক্যাম্পেইনটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ক্যাম্পেইনের লিংকটিতে (আর্কাইভ) ঢুকলে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, বিনামূল্যে ল্যাপটপ পেতে হলে বয়স সীমা ১০ থেকে ৫০ এর মধ্যে হতে হবে এবং লিখতে ও পড়তে জানা একজন শিক্ষার্থী হতে হবে।

Screenshot: Scam Website

পরবর্তী ধাপে গেলে আবেদন গৃহীত হওয়ার একটি বার্তা সামনে আসে এবং ল্যাপটপ পাওয়ার যোগ্য কিনা সেটি নিশ্চিত করতে পরবর্তী ধাপে যেতে বলা হয়। 

Screenshot: Scam Website

কিছুক্ষণ লোডিং হওয়ার পর আরেকটি পেজে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে পুনরায় নিজের নাম দেওয়ার একটি ঘর আসে এবং ল্যাপটপ নেওয়ার উদ্দেশ্য নির্বাচন করতে বলা হয়। তথ্য দেওয়ার পর ‘অনুরোধ’ বাটন চাপতে বলা হয়।

Screenshot: Scam Website

পরের পেজে ল্যাপটপ পাওয়ার জন্য অনুমোদিত হয়েছেন বলে অভিনন্দন জানানো হয়। তবে এখানেই শেষ নয়। এবার ১৫ জন বন্ধু বা ৫টি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি বার্তা শেয়ার করতে বলে হয় এই কাজটি সম্পূর্ণ করলেই ১৫ মিনিটের মধ্যে একটি নিশ্চিতকরণ এসএমএস পাওয়া যাবে বলা হয়।

Screenshot: Scam Website

কিন্তু শেয়ার দেওয়ার পর আরেকটি পেজে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে আইফোন, ল্যাপটপ, আইপ্যাড এবং অন্যান্য উপহার প্রলোভন দেখিয়ে কিছু স্প্যাম লিংকে ক্লিক করতে বলা হয়।

Screenshot: Scam Website

হোয়াটসঅ্যাপে ছড়ানো আর্থিক সীমাবদ্ধতায় থাকা মানুষদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদান করার ক্যাম্পেইন লিংকের প্রতিটি ধাপ অনুসরণ করা জানা যাচ্ছে, এই ক্যাম্পেইনে কোনো ল্যাপটপ প্রদান করা হচ্ছে না বরং ল্যাপটপ প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে।

ক্যাম্পেইন ওয়েবসাইট পর্যালোচনা

ল্যাপটপ প্রদানের এই ওয়েবসাইটটি পর্যালোচনা করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। ওয়েবসাইটি কোনো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের নয়, এমনকি বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদান করা হবে দাবি করা হলেও এসব ল্যাপটপ কে দিবে এবং কেনই বা দেওয়া হবে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য সেখানে দেওয়া নেই।

ক্যাম্পেইনের দ্বিতীয় ধাপে এখন পর্যন্ত কতজন এই অফারের সুবিধা নিয়েছে তার পরিসংখ্যান দেখানো হয়। এই পরিসংখ্যান ৯৮৭০০ থেকে শুরু হয় এবং ক্রমশ বাড়তে থাকে। তবে, ক্যাম্পেইনের পেছনের ধাপে ফিরে আবার এই ধাপে আসলে প্রতিবারই ৯৮৭০০ থেকে পরিসংখ্যান শুরু হয়। যার ফলে স্পষ্ট হয় যে, এই পরিসংখ্যানটি বানোয়াট।

Screenshot: Scam Website

শুরুতে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ দেওয়া হবে বলা হয়েছে কিন্তু একটি ধাপে গিয়ে ল্যাপটপ নেওয়ার উদ্দেশ্য নির্বাচন করতে গিয়ে অপশনে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছাড়াও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যের অপশন নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

Screenshot: Scam Website

তাছাড়া ক্যাম্পেইনের ওয়েবসাইটটিতে গেলে ল্যাপটপ পেয়েছে জানিয়ে বেশ কয়েকটি রিভিউ লক্ষ্য করা যায়। রিভিউ গুলোর বাক্য গঠনে অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া সেখানে একটি মন্তব্যের ঘর থাকলেও সেখানে কোনো মন্তব্যই করা যায় না। অর্থাৎ ক্যাম্পেইন ওয়েবসাইটে যে রিভিউগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলোও ভুয়া।

Screenshot: Scam Website

তাছাড়া PMYP এর বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায়, এর পূর্ণরূপ Prime Minister’s Youth Programme, যা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ২০১৩ সালে শুরু করেন। যুবদের মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাকিস্তানের উচ্চ শিক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় ২০২৩ সালেও এই উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদান করা হয়েছে। তবে সে স্কিমের ওয়েবসাইট ভিন্ন।  

এছাড়া অনুসন্ধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই নামে বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদানের কোনো স্কিমের তথ্য পাওয়া যায়নি। 

এসব ভুয়া ক্যাম্পেইন ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী?

বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট নকল করে কিংবা ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে আকর্ষণীয় অফারের প্রলোভন দেখিয়ে ভুয়া ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়।

এসব ভুয়া ক্যাম্পেইনের নামে স্প্যাম ও ফিশিং লিংক ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব ফিশিং লিংকের মাধ্যমে ই-মেইল, পাসওয়ার্ড, ক্রেডিট কার্ডের পিনকোড, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার পিনকোড সহ আরো অনেক ব্যক্তিগত অথবা পেশাগত তথ্য চুরি করা হয়। 

চুরি করা এসব তথ্য দিয়ে কখনো কখনো সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ও ইমেইলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার সম্ভব হয়। আবার ব্যক্তিগত এসব অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেসব থেকে অন্যদের ফিশিং লিংক পাঠানো, অন্যদের থেকে আর্থিক সহায়তা চাওয়া কিংবা ব্ল্যাকমেইলের ঘটনাও ঘটতে পারে।

মূলত, প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে PMYP নামের একটি উদ্যোগের অধীনে আর্থিক সীমাবদ্ধতায় থাকা মানুষদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদান করা হবে দাবিতে একটি ক্যাম্পেইন লিংক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে উক্ত ক্যাম্পেইনের সে লিংকে গেলে ল্যাপটপ প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ধাপ পূরণ করতে বলা হয়। সর্বশেষ ধাপে একটি বার্তা ১৫ জন বা ৫টি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠালেই ল্যাপটপ পাওয়া যাবে বলা হলেও সে ধাপ শেষ করলে আবার কিছু স্প্যাম ও সার্ভে লিংকে ক্লিক করতে বলা হচ্ছে। তাছাড়া PMYP নামের বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদানের উদ্যোগটি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর, সে স্কিমের ওয়েবসাইটের সাথে আলোচ্য ওয়েবসাইটের কোনো মিল নেই। এছাড়া  বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই নামে বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদানের কোনো স্কিমের তথ্য বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া যায়নি। 

উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময়ে একইভাবে স্বনামধন্য বিভিন্ন সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট নকল করে প্রতারণার উদ্দেশ্য এমন ক্যাম্পেইন ছড়ালে পাঠকদের সতর্ক করার উদ্দেশ্যে সেসব যাচাই করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। প্রতিবেদনগুলো পড়ুন এখানে

অর্থাৎ,প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে PMYP নামের একটি উদ্যোগের অধীনে আর্থিক সীমাবদ্ধতায় থাকা মানুষদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদান করা হবে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ক্যাম্পেইনটি সম্পূর্ণ ভুয়া।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img