পিরিয়ড মিথ: নারীদের নারিকেল, শসা, ঠান্ডা পানি খাওয়া এবং শ্যাম্পু ব্যবহারে বাধা নেই

বিগত কয়েক বছর ধরেই কতিপয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হচ্ছে, নারীদের পিরিয়ডের সময় নারিকেল, শসা এবং ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না।

উক্ত দাবিতে ২০২২ সালে কতিপয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন সময় টিভি, জাগো নিউজ২৪

একই দাবিতে ২০১৯ সালে কতিপয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন সময়ের আলো, ডেইলি বাংলাদেশ, অধিকার নিউজ। 

একই দাবিতে ২০১৮ সালে কতিপয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন যুগান্তর, একুশে টিভি

উক্ত দাবিগুলোর সাথে পিরিয়ডে শ্যাম্পুও ব্যবহার করা যাবে না বলে আরেকটি দাবি ফেসবুকের একাধিক পোস্টে খুঁজে পাওয়া যায়। ফেসবুকে এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’র ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনেও দাবি করা হয়, “পিরিয়ডের সময় চুলের গোড়া আলগা হয়ে যায়, ফলে লোমকূপ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এ সময় চুলে শ্যাম্পু ব্যবহার না করাই ভালো।”

একই দাবিতে ইউটিউবের একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নারীদের পিরিয়ডের সময় নারিকেল, শসা ও ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না এবং শ্যাম্পু ব্যবহার করা যাবে না শীর্ষক দাবিগুলো সঠিক নয় বরং কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ছাড়াই বিগত কয়েক বছর ধরেই উক্ত ভিত্তিহীন দাবিগুলো প্রচার হয়ে আসছে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ প্রতিবেদনেই আলোচিত তথ্যটির উৎস হিসেবে বোল্ডস্কাই এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। 

পরবর্তীতে অনুসন্ধান করে ভারতের লাইফ স্টাইল বিষয়ক সাইট ‘boldsky’ এ ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ Don’t Do This When You Have Periods; It Can Be Dangerous For Your Health শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সেদিনেরই (১৭ মার্চ, ২০১৭) ইন্টারনেট আর্কাইভ সংস্করণ খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনে পিরিয়ডের সময় শসা খাওয়ার বিষয়ে দাবি করা হয়, “এই সময়ে (পিরিয়ড) শসা আপনার জন্য খারাপ হতে পারে, কারণ শসাতে থাকা উপাদানগুলোর কারণে জরায়ু প্রাচীরে রক্ত জমতে পারে।”

একই প্রতিবেদনে ঠান্ডা পানির বিষয়ে দাবি করা হয়, “আপনার অবশ্যই এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে যেহেতু এসব খেলে জরায়ু প্রাচীরে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। ৫-১০ বছর পর এখান থেকে সিস্ট বা ক্যান্সার কোষ তৈরি হতে পারে।” 

Screenshot collage: Rumour Scanner 

প্রতিবেদনে এই তথ্যগুলোর কোনো সূত্র উল্লেখ করা হয়নি, দেওয়া হয়নি কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা ডাক্তারের মত। তাছাড়া, বাংলাদেশের কতিপয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বোল্ডস্কাইয়ের প্রতিবেদনে বরাতে নারিকেল না খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলেও মূল প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি। 

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্বের একাধিক ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা পিরিয়ড বিষয়ে আলোচিত এই মিথগুলোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে। এএফপি ফ্যাক্টচেক যেমন ম্যাক্সিকোর দুই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ Dra. Anaïs Reyes Navarroa এবং Dr. Kiyoshi Arturo Macotela Nakagaki এর সাথে কথা বলেছে। 

Dr. Kiyoshi Arturo Macotela Nakagaki বলছিলেন, “নারকেল খাওয়া বা বরফ ঠাণ্ডা পানি পান করার সাথে পিরিয়ডে সমস্যার কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলোর কারণে বন্ধ্যাত্ব বা ক্যান্সারও হয় না। এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই।” সংস্থাটিকে Dra. Anaïs Reyes Navarroa ও একই মত (শসার বিষয়েও) দিয়েছেন।

Screenshot source: AFP Fact Check

শ্যাম্পুর বিষয়ে জানতে চাইলে Dra. Anaïs Reyes Navarroa বলছিলেন, “এ বিষয়ে কিছুই বলার নেই। এটা অনেকটা কৌতুকের (jokes) মতো শোনাচ্ছে।”

আরেক ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা Afria Check কেও একই মত জানিয়েছেন নাইজেরিয়ার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ Dr Aloysius I. Inofomoh।

Screenshot source: Afria Check

ভারতের ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা The Quint ও সেদেশের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ Dr. Shilpa Agrawal এর সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছে। তিনিও একই মত দিয়ে জানিয়েছেন, পিরিয়ডের সাথে নারকেল, শসা, ঠান্ডা পানি বা শ্যাম্পুর কোনো সম্পর্ক নেই। 

এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান করে ইউনিসেফের ওয়েবসাইটে পিরিয়ড বিষয়ে প্রকাশিত একটি গাইডলাইনে পিরিয়ড বিষয়ক বেশকিছু মিথের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে ঠান্ডা পানি বিষয়ক আলোচিত তথ্যটিরও উল্লেখ পাওয়া যায়। 

ইউনিসেফ বলছে, ঠান্ডা পানি খেলে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায় বলে মিথের প্রচলন দেখা যায় তা সঠিক নয়। ঠাণ্ডা পানির সঙ্গে ঋতুচক্রের কোনো সম্পর্ক নেই। পিরিয়ড সাথে প্রজননতন্ত্র জড়িত আর ঠান্ডা পানির সম্পর্ক পরিপাকতন্ত্রের সাথে। এই দুই তন্ত্র ভিন্ন হওয়ায় এদের একটির সাথে অন্যটির সম্পর্ক নেই। 

ইউনিসেফ পরিস্কার করেই বলেছে, ঠান্ডা পানি এমনকি কোনো নির্দিষ্ট খাবার পিরিয়ডে সমস্যা সৃষ্টি করেনা। 

Screenshot collage: Rumor Scanner 

অর্থাৎ, ঠান্ডা পানির পাশাপাশি পিরিয়ডে শসা কিংবা নারিকেলের মতো নির্দিষ্ট খাবার খেতেও বাধা নেই বলে জানাচ্ছে ইউনিসেফ।

শ্যাম্পুর বিষয়ে অনুসন্ধান করে ইউনিসেফের জর্ডান শাখার একটি প্রতিবেদন খুঁজে পেয়েছি আমরা। ২০১৯ সালের উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইউনিসেফের এবং তাদের সহযোগীরা জর্ডানের কিশোরীদের পিরিয়ডকালীন সময়ের জন্য হাইজিন কিট বিতরণ করে যেখানে শ্যাম্পুও রয়েছে।

Screenshot source: UNICEF

পিরিয়ডে যদি শ্যাম্পু ব্যবহার নিষেধই থাকতো তাহলে ইউনিসেফ শ্যাম্পু বিতরণ করতো না। 

এ বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে যোগাযোগ করলে সংস্থাটির মিডিয়া বিভাগ থেকে জানানো হয়, “এই তথ্যগুলো সম্পূর্ণ ভুল। কেউ ভালোভাবে অনলাইনে যাচাই করলেই এগুলো যে ভুল তা জেনে নিতে পারবে।” 

মূলত, বিগত কয়েক বছর ধরেই নারীদের পিরিয়ডের সময় নারিকেল, শসা ও ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না এবং শ্যাম্পু ব্যবহার করা যাবে না শীর্ষক দাবি প্রচার হয়ে আসছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব দাবি সঠিক নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে রিউমর স্ক্যানার টিমকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। তাছাড়া, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের একাধিক স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞও এসব দাবি একবাক্যে ভিত্তিহীন বলে রায় দিয়েছেন। এছাড়া, বৈজ্ঞানিকভাবেও এসব দাবির কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন তারা। 

সুতরাং, নারীদের পিরিয়ডের সময় নারিকেল, শসা ও ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না এবং শ্যাম্পু ব্যবহার করা যাবে না শীর্ষক দাবিগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img