শেখ হাসিনাকে জোরপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেননি স্টিফেন ডুজারিক

সম্প্রতি, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ একটি জরুরি বৈঠক করেছে এবং বৈঠকটির পর জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক একটি জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেছেন দাবিতে স্টিফেন ডুজারিক প্রেস ব্রিফংয়ে কথা বলছেন এমন একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে। 

ভিডিওটি প্রচার করে ক্যাপশনে দাবি করা হয়, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আজ জাতিসংঘের জরুরী বৈঠকের পর জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এক জরুরী সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

এতে বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনের নামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জোরপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে বলে জানান তিনি। স্টিফেন ডুজারিক আরো বলেন, একটি মেটিকুলাস প্লান করে গত একবছর ধরে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রেখেছে ড. ইউনুস, এতে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের উপর ইউনুস প্রশাসন গণহত্যা চালাচ্ছে। আগামী ২৫ দিনের মধ্যে ড. ইউনুস রাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানো হবে বলে জানান তিনি।’ 

অর্থাৎ দাবি করা হচ্ছে,

এক. সম্প্রতি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ একটি জরুরি বৈঠক করেছে এবং এরপর উক্ত বৈঠকটির বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক একটি জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

দুই. উক্ত সংবাদ সম্মেলনে ডুজারিক জানান, কোটা আন্দোলনের নামে শেখ হাসিনাকে জোরপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে।

তিন. ড. ইউনূস একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গত এক বছর ধরে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আছেন।

চার. পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে থাকায়, এতে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর ইউনূস প্রশাসন গণহত্যা চালাচ্ছে।

পাঁচ. কথিত সংবাদ সম্মেলনে ডুজারিক জানান, ২৫ দিনের মধ্যে ড. ইউনূস রাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানো হবে।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিডিওটির সাথের প্রচারিত দাবিগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া, ভিডিওটিসাম্প্রতিক সময়েরও নয়। প্রকৃতপক্ষে, ২০২৪ সালের ২৯শে জুলাই জাতিসংঘের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিকের বাংলাদেশের সেই সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার ভিডিও ক্লিপ ব্যবহার করে আলোচিত দাবিগুলো প্রচার করা হয়েছে। তাছাড়া, সম্প্রতি জাতিসংঘ বাংলাদেশ ইস্যুতে কোনো জরুরি বৈঠকে বসেনি এবং ডুজারিকও বাংলাদেশ নিয়ে এমন কোনো সংবাদ সম্মেলন করেননি।

এই বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার। এতে, অডিও হিসেবে শুনা যায়, “I can tell you that The Secretary-General remains deeply concerned about the situation in Bangladesh. He notes reports of the resumption of student protests today and reiterates his call for calm and restraint. The Secretary-General is concerned about reported mass arrests of thousands of young people and political opposition in connection with the current … student movement. He is also alarmed by emerging reports about the excessive use of force by security forces and credible evidence of human rights violations.”

আলোচিত ভিডিওটি প্রচার করে ক্যাপশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বা শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়া ইস্যুতে যেসব দাবি করা হয়েছে সেসব বিষয়ে ভিডিওটিতে কোনো তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। রিউমর স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণে ভিডিওটি জুলাই আন্দোলনের সময়ের বলে প্রতীয়মান হয়।

পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে ‘United Nations’ ইউটিউব চ্যানেলে ২০২৪ সালের ৩০ জুলাই ‘Venezuela, South Asia floods & other topics – Daily Press Briefing (29 July 2024) | United Nations’ ক্যাপশনে প্রচারিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। 

Comparison : Rumor Scanner 

উক্ত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ভিডিওটির ১ মিনিট ৭ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট ৩২ সেকেন্ড এবং ১ মিনিট ৪১ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট ৫০ সেকেন্ড অংশের সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওর মিল রয়েছে। 

উক্ত ভিডিওটির ১ মিনিট থেকে ২ মিনিট ৫১ সেকেন্ড অংশে বাংলাদেশের সেই সময়ে চলমান ছাত্র আন্দোলন তথা কোটা সংষ্কার আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ইস্যুতে স্টিফেন ডুজারিক জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া জানান।

ডুজারিকের ব্রিফিং থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশের সেই সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি তখন ছাত্র বিক্ষোভ আবার শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে সব পক্ষকে শান্ত থাকার এবং সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানান। তিনি ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার তরুণ ও রাজনৈতিক বিরোধীদের গণহারে গ্রেপ্তারের খবরেও চিন্তিত ছিলেন। তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারের ওপর জোর দেন। এছাড়াও, নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের যে খবর সে সময় এসেছে  তাতে তিনি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি সব ধরনের সহিংসতার দ্রুত, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং যারা এর জন্য দায়ী, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা বলেছিলেন সেই সময় জাতিসংঘের উদ্বেগের বিষয়টি ঢাকা ও নিউ ইয়র্ক উভয় জায়গাতেই বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অব্যাহতভাবে জানিয়েছে বলে জানা যায়।

জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই ব্রিফিংয়ের বিষয়ে প্রচারিত প্রতিলিপি থেকেও একই তথ্য জানা যায়।

সুতরাং, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের তৎকালীন আন্দোলন সম্পর্কিত বিষয়ে জাতিসংঘের মন্তব্যের ভিডিওকে সম্প্রতি শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়া ইস্যুতে আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিকের সংবাদ সম্মেলন দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img