নেপালের রয়্যাল কোর্ট লাইব্রেরিতে অগ্নিসংযোগ দাবিতে সিংহ দরবারের ছবি প্রচার  

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সম্প্রতি নেপালের রাজপথে নেমে আসেন কয়েক হাজার মানুষ। বিক্ষোভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগে গত ০৯ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। তার পদত্যাগের ঘোষণার পরেও বিক্ষোভকারীরা নেপালের পার্লামেন্ট ভবন ও মন্ত্রীদের বাসভবন সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ভবনে প্রবেশ করে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে।

এরই প্রেক্ষিতে একটা জাতিকে ১০০০ বছর পিছিয়ে দিতে তাদের লাইব্রেরিগুলো পু’ড়িয়ে দিলেই যথেষ্ট! পু’ড়ছে নেপালের রয়াল লাইব্রেরি, পু’ড়ছে চর্যাপদ!

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)৷

ইন্সটাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নেপালে সাম্প্রতিক সময়ের বিক্ষোভ-অগ্নিসংযোগে দেশটির রয়্যাল লাইব্রেরি এবং চর্যাপদ পুড়ে যাওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। প্রকৃতপক্ষে, নেপালে সাম্প্রতিক বিক্ষোভকালে দেশটির সরকারি প্রশাসনিক ভবন সিংহ দরবারে অগ্নিসংযোগের ঘটনার ছবিকে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে স্টক ফটো ওয়েবসাইট gettyimages এ একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ছবির সাথে আলোচিত ছবিটির আংশিক সাদৃশ্য রয়েছে। প্রচারিত ছবিতে ভবনটি অগ্নিসংযোগের মুহূর্তে জ্বলন্ত অবস্থায় রয়েছে, অন্যদিকে গেটি ইমেজের ছবিটি একটি স্বাভাবিক সময়ে ধারণকৃত। 

Comparison: Rumor Scanner 

চেক ফটো-সাংবাদিক পল পপারের সৌজন্যে প্রকাশিত ছবিটির ক্যাপশন থেকে জানা যায়, ছবিটি ১৯৬৭ সালে ধারণকৃত নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু শহরের কেন্দ্রস্থলে সিংহ দরবার, যা সিংহের প্রাসাদ নামেও পরিচিত, এর বাইরের দৃশ্যের। 

পরবর্তীতে, স্টক ফটো প্লাটফর্ম gettyimages এর ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত পোস্টে আলোচিত ছবির অনুরূপ একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়৷ 

Screenshot: Instagram 

পোস্টটির ক্যাপশন থেকে জানা যায়, ছবিটি সাম্প্রতিক আন্দোলনে নেপাল সরকারের মূল প্রশাসনিক ভবন সিংহ দরবারে বিক্ষোভকারীদের অগ্নিসংযোগের চিত্র। 

অর্থাৎ, আলোচিত ছবিটি নেপালের সরকারি প্রশাসনিক ভবন সিংহ দরবারের। 

এছাড়া, নেপালের রয়্যাল লাইব্রেরি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীন যুগের নিদর্শন চর্যাপদের পুড়ে যাওয়ার বিষয়ে অনুসন্ধানে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি ‘রঙিন চর্যাপদের খোঁজে’ শিরোনামে হালনাগাদকৃত একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। 

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে চর্যাপদের পুথি আবিষ্কার করেন। উক্ত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, নেপালের রয়্যাল দরবার লাইব্রেরি বলতে এখন আর কিছু নেই। লেখক জেনেছেন, নেপালের সরকারি অনেক অধিদপ্তর এর সম্পদগুলো বণ্টন করে নিয়েছে। তার বিশ্বাস ছিল, ভক্তপুর দরবার নয়, সিংহদরবারের গ্রন্থাগারেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পুথিটি দেখেছিলেন। কারণ, ভক্তপুর দরবারে একটি মিউজিয়াম ছিল, সেটি তিনি দেখেছিলেন ২০১৪ সালে, সেখানে চর্যাপদ পাননি।

চর্যাপদ হলো প্রাচীন তান্ত্রিক-বৌদ্ধধর্মের গান ও শিক্ষার সংকলন, যা পূর্ব-ভারতের হাজার বছরের পুরনো সমাজ ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে। এটি মূলত তালপাতার পুথিতে লেখা ছিল, যেখানে চর্যাকাররা গান ও টীকা একত্রিত করেছেন। ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রয়্যাল কোর্ট লাইব্রেরিতে এই পুথির প্রতিলিপি আবিষ্কার করেন। মূল পুথিটি মুনিদত্তের টীকার পুথি হিসেবে পরিচিত, এবং শাস্ত্রী এর ভাষা প্রাচীন বাংলা হিসেবে শনাক্ত করেন। মূল পুথি বর্তমানে নেপালে নেই; তবে চর্যাপদের অমূল্য তথ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য ন্যাশনাল আর্কাইভ অফ নেপালে এটি সংরক্ষিত আছে।

কালক্রমে বিভিন্ন পণ্ডিত চর্যাপদকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ ও অধ্যয়ন করেছেন, যেমন হিন্দি, অসমীয়া, ওড়িয়া, মৈথিলি, ইংরেজি ও ফরাসি। বর্তমানে নেপালের সরকারি সংরক্ষণাগারে কিছু পাতা আছে, এবং কিছু রঙিন প্রতিলিপি সংগ্রহ করা হয়েছে, যা উচ্চ রেজল্যুশনে ছবি তোলা হয়েছে।

সুতরাং, সাম্প্রতিক বিক্ষোভে নেপালের রয়্যাল কোর্ট লাইব্রেরিতে অগ্নিসংযোগ ও এতে চর্যাপদের পুড়ে যাওয়ার দাবিটি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img