বৃহস্পতিবার, এপ্রিল 25, 2024
spot_img

শেখ রেহেনাকে জড়িয়ে গাফফার চৌধুরী সম্পর্কে প্রচারিত মন্তব্যটি এম আর আখতার মুকুলের নয়

সম্প্রতি, ”বঙ্গবন্ধুর ফোনে একবার একটা কাজে ৩২নং বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম বেগম মুজিব ও শেখ কামাল জুতা দিয়ে আবদুল গাফফার চৌধুরীকে বেধড়ক পেটাচ্ছেন। পেছনে মুজিব দাঁড়িয়ে আছেন। জানতে চাইলাম, শেখ কামাল তাকে এতো পেটাচ্ছেন কেন? সে তো মারা যাবে। তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, বদমাশটা রেহানাকে একা পেয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু দিতে চেয়েছে। পরে দেখলাম আবদুল গাফফার বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিবের পা ধরে পড়ে আছে। পরে আমি সুপারিশ করলে বঙ্গবন্ধু তাকে নিয়ে চলে যেতে বলে। সে দিন সে মদপ্য ছিল বলে বঙ্গবন্ধু তাকে ক্ষমা করে। তার কিছুদিন পর গাফফার লন্ডন চলে যান। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্বশায় আর দেশে ফেরে নি। -এম এ আক্তার মুকুল। ‘প্রথম সরকারের ইতিকথা’ পৃষ্টা ১১৫” শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

গাফফার

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানারের টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু পরিবারকে জড়িয়ে সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পর্কে প্রচারিত মন্তব্যটি প্রয়াত লেখক এম আর আখতার মুকুলের নয় এবং এই নামের কোন বইয়ের অস্তিত্ব নেই বরং কোনোপ্রকার বাস্তবিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই উক্ত তথ্যটি বিগত ৯ বছর যাবৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে।

তথ্য যাচাই

প্রচারিত তথ্যটির সূত্র হিসেবে প্রয়াত লেখক এম আর আখতার মুকুলের ‘প্রথম সরকারের ইতিকথা’ নামক বইয়ের ১১৫ পৃষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হলেও রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে উক্ত লেখক কর্তৃক সম্পাদিত ‘প্রথম সরকারের ইতিকথা’ নামক কোনো বইয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে, আলোচিত তথ্যটি যারা প্রচার করছে তাদের অনেকেই উইকিপিডিয়াকে সোর্স দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাচ্ছেন যে তাদের দাবি সত্য। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এম আর আখতার মুকুলের নামে থাকা ইংরেজি উইকিপিডিয়া পেজে গতকাল অর্থাৎ ১৯ মে তারিখেই এই লেখাটি একটি এনোনিমাস আইডি থেকে সংযুক্ত করা হয়েছে।

এছাড়া, প্রয়াত লেখক এম আর আখতার মুকুলের লেখা ‘প্রথম সরকারের ইতিকথা‘ নামক বইয়ের পিডিএফ ফাইল দাবি করে একটি লিংক শেয়ার করা হচ্ছে।

তবে উক্ত পিডিএফ ফাইলটি ডাউনলোড করে রিউমর স্ক্যানার টিম ঐ নামের কোনো বই খুঁজে পায়নি। বরং সেটি ডাউনলোড করার পর উক্ত ফাইলে বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএসসি প্রোগ্রামের ইতিহাস দ্বিতীয় পত্র বইয়ের ৩৫ টি পৃষ্ঠা পাওয়া গিয়েছে।

তাছাড়া, উক্ত নামে কোনো বই আছে কিনা তা অধিকতর যাচাইয়ের জন্য রিউমর স্ক্যানারের পক্ষ থেকে প্রয়াত লেখক এম আর আখতার মুকুলের এর কন্যা অস্ট্রেলীয় প্রবাসী কবিতা পারভেজের সাথে যোগাযোগ করা হলে তার বাবার বরাত দিয়ে ফেসবুকে প্রচারিত তথ্যের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার বাবার ‘প্রথম সরকারের ইতিকথা’ নামে কোনো বই নেই। তারা বাবার নামও ভুলভাবে প্রচার করছে। পুরো জিনিসটাই বানোয়াট।”

সূত্রপাত

সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক গাফফার চৌধুরী সম্পর্কে ফেসবুকে আলোচিত তথ্যটির সূত্রপাত খুঁজতে গিয়ে একই দাবিতে ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর ও তার পরবর্তী সময়ে ফেসবুকে প্রচারিত বেশ কিছু পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। সেসব পোস্টে “গত দুই দিন আগে শেখ মুজিবকে রাজাকার বলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বাজে মন্তব্য করেছিল এক কালের আওয়ামী লম্পট আবদুল গাফফার চৌধুরী।” শীর্ষক একটি মন্তব্য পাওয়া যায়।

উক্ত মন্তব্যের সূত্র ধরে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে মূলধারার গণমাধ্যম দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ২০১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর “তারেক রহমান ‘জীবন্ত উন্মাদ’: আবদুল গাফফার চৌধুরী” শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে তারেক রহমান সম্পর্কে আবদুল গাফফার চৌধুরীর বেশ কিছু মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়।

তার মন্তব্যের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হলো, “একদিন জিয়াউর রহমানের বাড়িতে গিয়ে দেখি তিনি তারেককে বেল্ট খুলে প্রহার করছেন। রক্তাক্ত তারেকের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়াও। শাহীন কলেজে এক মেয়েকে টিজ করার কারণে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।”

প্রথম আলোর ঐ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘ইতিহাসের আলোকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও ৭ মার্চের তাৎপর্য’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় আবদুল গাফফার চৌধুরী তার একদিন আগে অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর (২০১৪) লন্ডনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তারেক রহমানের করা আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে তারেক রহমানকে সম্পর্কে এই মন্তব্য করেন।

এছাড়া, একই অনুষ্ঠানে (‘ইতিহাসের আলোকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও ৭ মার্চের তাৎপর্য’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা) গাফফার চৌধুরীর মন্তব্য নিয়ে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। সেই প্রতিবেদনেও তারেক রহমান সম্পর্কে গাফফার চৌধুরীর একই ধরণের মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়।

Also Read: অস্ত্র হাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দাবিতে প্রচারিত ছবিটি এডিটেড

মূলত, ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তির প্রতিবাদে পরদিন ১৭ ডিসেম্বর তারেক রহমানকে নিয়ে সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর মন্তব্যের পরবর্তী সময় হতে কোনো বাস্তবিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবারকে জড়িয়ে গাফফার চৌধুরী সম্পর্কে আলোচিত তথ্যটি অনলাইনে প্রচার হয়ে আসছে।

উল্লেখ্য, লন্ডনে এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করার ঘটনায় নড়াইলের আদালতে করা এক মামলায় ২০২১ সালের ০৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয় নড়াইলের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।

প্রসঙ্গত, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী গত ১৯ মে বৃহস্পতিবার লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮৭ বছর।বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে রচিত বিখ্যাত গান ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি তার লেখা। প্রয়াত লেখক ও সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের চরমপত্রের লেখক, কথক ও পরিচালক ছিলেন। আমি বিজয় দেখেছি, ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা, ভাষানী মুজিবের রাজনীতি তার রচিত বিখ্যাত বই।

সুতরাং, প্রয়াত লেখক এম আর আখতার মুকুলের মন্তব্য দাবি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে জড়িয়ে সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পর্কে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

RS Team
RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img