সম্প্রতি, ভুটানের খাদ্য, পানি ও পরিবেশ নিয়ে কিছু তথ্য একটি ফটোকার্ডের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।
যা দাবি করা হচ্ছে
আলোচিত পোস্টগুলোতে বলা হয়েছে, “ভুটান হলো পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেটি কখনো পানি ও খাদ্য সংকট বা পানি ও বাতাস দূষণের সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। এছাড়া এটি একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ যেখানে এটি কার্বন উৎপাদন থেকে কার্বন বেশি শোষণ করে।”

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভুটানের খাদ্য, পানি ও পরিবেশ নিয়ে প্রচারিত আলোচিত দাবিগুলো সঠিক নয় বরং ভুটান বিভিন্ন সময়ে খাদ্য ও পানি সংকট এবং পানি ও বাতাস দূষণের সম্মুখীন হয়েছে। তাছাড়া ভুটান পৃথিবীর একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ নয়। কার্বন নেগেটিভ দেশের তালিকায় আরও দুটি দেশের নাম রয়েছে। দেশ দুটি হলো পানামা ও সুরিনাম।
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ফটোকার্ডটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। রিউমর স্ক্যানারের পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে উক্ত ফটোকার্ডে উল্লেখিত দাবিগুলো পৃথকভাবে যাচাই করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
দাবি ০১ঃ ‘ভুটান একমাত্র দেশ যেখানে কখনো পানি ও খাদ্য সংকট হয়নি’
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে জাতিসংঘের ‘World Food Program’ এর ওয়েবসাইটে ‘BHUTAN: Threatened by Climate Change’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ভুটান সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভুটানের খাদ্যসামগ্রীর ৫০% বাহির থেকে আমদানি করতে হয়।

এছাড়াও, ভুটানের গণমাধ্যম ‘Business Bhutan’ এর ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘Will Bhutan undergo a food crisis?’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদনে ভুটান ভোক্তা মূল্য সূচকের বরাতে জানানো হয়, ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেশটিতে ভোগ্যপণ্য ও পরিসেবার দাম ৬.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশটিতে বসবাসের খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি পুষ্টিকর খাদ্য ক্রয়ের প্রবণতা কমেছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম ‘Business Today’ এর ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ২৬ মে ‘Bhutan faces food shortage; spike in domestic prices’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, খাদ্য চাহিদা পূরণে ভুটান আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ভুটান ২০২১ সালে ভারত থেকে 30.35 মিলিয়ন ডলারের খাদ্যসামগ্রী, প্রধানত চাল এবং গম আমদানি করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত তেল এবং শস্যের দাম বৃদ্ধির কারণে ভুটানে খাদ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পায়।
ভুটানের পানি সংকটের বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ২০২২ সালের ২৩ জুন জার্মানি ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে’র ওয়েবসাইটে ‘Bhutan fights back against water crisis’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভুটান পানি সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। খরা এবং হিমালয়ের বরফ গলার প্রভাবে দেশটির কৃষি ও বনায়ন হুমকির মুখে পড়ছে।
অর্থাৎ, ‘ভুটান একমাত্র দেশ যেখানে কখনো পানি ও খাদ্য সংকট হয়নি’ শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয়।
দাবি ০২ঃ ‘ভুটান একমাত্র দেশ যেখানে কখনো পানি ও বাতাস দূষণ হয়নি’
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ভুটানের গণমাধ্যম ‘The Bhutanese’ এর ওয়েবসাইটে ২০১৪ সালের ০৪ ডিসেম্বর ‘NEC study shows deteriorating air quality in Bhutan’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদনে ২০০৪ সালে ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট কমিশনের এক সমীক্ষার বরাতে ভুটানের বায়ু দূষণের বিষয়ে জানানো হয়। প্রতিবেদনে ভুটানের থিম্পু সহ শহর অঞ্চলে বায়ু দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে বলা হয়।
এছাড়াও, ভুটানের গণমাধ্যম ‘Bhutan Broadcasting Corporation’ এর ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি ‘Air pollution becoming a serious concern in Bhutan’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদনে ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট কমিশনের বরাতে ভুটানের বায়ু দূষণের জন্য দায়ী ‘পিম ১০’ এবং ‘পিএম ২.৫’ নামক দুটি কণার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। অত্যন্ত ক্ষুদ্র এই কণা বাতাসে প্রবেশের মাধ্যমে বায়ু দূষণ ঘটায়। এটি শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসকে প্রভাবিত করতে পারে, যা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরিতে ভূমিকা পালন করে।
ভুটানের পানি দূষণের বিষয়ে অনুসন্ধানে গবেষণা জার্নাল ‘Science Direct’ এর ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের নভেম্বরে ‘Assessing the water quality and status of water resources in urban and rural areas of Bhutan’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়।
সেখানে উল্লেখিত তথ্য থেকে জানা যায়, ভুটানের কিছু অঞ্চলে টেকসই ও নিরাপদ পানির অভাব রয়েছে। ভুটানে শহুরে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে শহর অঞ্চলে প্রাকৃতিক পানির গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে। গত দশকের তুলনায় ভুটানের পানির গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে বলেও উক্ত গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
অর্থাৎ, ‘ভুটান একমাত্র দেশ যেখানে কখনো পানি ও বাতাস দূষণ হয়নি’ শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয়।
দাবি ০৩ঃ ‘ভুটান একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ’
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার ক্লাইমেট কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে ২০১৭ সালের ০২ এপ্রিল ‘BHUTAN IS THE WORLD’S ONLY CARBON NEGATIVE COUNTRY, SO HOW DID THEY DO IT?’
শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভুটান শুধুমাত্র একটি কার্বন নিরপেক্ষ দেশ নয়, এটি একটি কার্বন নেগেটিভ দেশও। ভুটান আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবীর প্রথম কার্বন নেগেটিভ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টিও সেখানে উল্লেখ পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে ‘World Population Review’ এর ওয়েবসাইটে ‘Carbon-Negative Countries 2024’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত কার্বন নেগেটিভ দেশগুলোর একটি তালিকা খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত তালিকা পর্যবেক্ষণ করে তালিকায় ভুটানের পাশাপাশি,পানামা ও সুরিনামের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়।

অর্থাৎ, ভুটানই একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ নয়। এই তালিকায় পানামা এবং সুনিনাম নামের আরও দুটি দেশও রয়েছে।
উপরোক্ত তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, আলোচিত ফটোকার্ডটিতে ভুটানের খাদ্য, পানি ও পরিবেশ নিয়ে প্রচারিত তথ্যগুলো সঠিক নয়।
মূলত, সাম্প্রতিক সময়ে “ভুটান হলো পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেটি কখনো পানি ও খাদ্য সংকট বা পানি ও বাতাস দূষণের সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। এছাড়া এটি একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ যেখানে এটি কার্বন উৎপাদন থেকে কার্বন বেশি শোষণ করে।” শীর্ষক দাবি সম্বলিত কিছু তথ্য একটি ফটোকার্ডের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিগুলো সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত দাবিগুলো প্রচার করা হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার টিম যাচাই করে দেখেছে ভুটান খাদ্য ও পানি সংকট এবং পানি ও বাতাস দূষণের সম্মুখীন হয়েছে। তাছাড়া ভুটান কার্বন নেগেটিভ দেশ হলেও এটি পৃথিবীর একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ নয়। উক্ত তালিকায় পানামা ও সুরিনাম নামের আরও দুটি দেশের নাম রয়েছে।
সুতরাং, ভুটানের খাদ্য, পানি ও পরিবেশ নিয়ে ফেসবুকে প্রচারিত তথ্যগুলোর অধিকাংশই মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- UN World Food Program: BHUTAN: Threatened by Climate Change
- Business Bhutan: Will Bhutan undergo a food crisis?
- Business Today: Bhutan faces food shortage; spike in domestic prices
- DW: Bhutan fights back against water crisis
- The Bhutanese: NEC study shows deteriorating air quality in Bhutan
- Bhutan Broadcasting Corporation: Air pollution becoming a serious concern in Bhutan
- Science Direct: Assessing the water quality and status of water resources in urban and rural areas of Bhutan
- Climate Council, Australia: BHUTAN IS THE WORLD’S ONLY CARBON NEGATIVE COUNTRY, SO HOW DID THEY DO IT?
- World Population Review: Carbon-Negative Countries 2024
- Rumor Scanner’s Own Analysis