বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে হিন্দু কর্মকর্তাদের আধিক্য দাবিতে প্রচারিত তালিকাটি সঠিক নয় 

সম্প্রতি, বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিন্দু ধর্মাবলম্বী দাবিতে একটি তথ্য ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে। 

হিন্দু কর্মকর্তা

ছড়িয়ে পড়া দাবিগুলো হলো –

১। বাংলাদেশে ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা।
২। পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান অপরূপ চৌধুরী।
৩। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের পরিচালক প্রশান্ত কুমার রায়।
৪। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী।
৫। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশনের (ডিপিডিসি) চেয়ারম্যান তাপস কুমার।
৬। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক স্বপন কুমার রায়।
৭। পাবলিক লাইব্রেরির মহাপরিচালক আশীষ কুমার সরকার।
৮। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান নারায়ন চন্দ্র সাহা।
৯। প্রেস কাউন্সিলের প্রধান শ্যামল চন্দ্র কর্মকার।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিন্দু ধর্মাবলম্বী দাবিতে প্রচারিত তালিকাটি সঠিক নয় বরং আলোচ্য তালিকায় উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানের উক্ত পদগুলোতে বর্তমানে ভিন্ন ব্যক্তিরা কর্মরত। ২০১৬ সাল থেকে একই তালিকা ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে।

প্রথম দাবি যাচাই

ইন্টারনেটের প্রচারিত দাবি অনুসারে বাংলাদেশে ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকে অসংখ্য নির্বাহী পরিচালক কর্মরত আছেন। তবে, তাদের মধ্যে শুভঙ্কর সাহা নামের কোনো ব্যক্তি নেই।

অন্যদিকে মূলধারার অনলাইন গণমাধ্যম বাংলানিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা প্রতিষ্ঠানটির নতুন মুখপাত্র হয়েছিলেন।

২০১৮ সালে বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সে বছরের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা অবসরে গিয়েছিলেন।

অর্থাৎ, বাংলাদেশে ব্যাংকের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা নয়, তিনি সাবেক নির্বাহী পরিচালক।

দ্বিতীয় দাবি যাচাই

ইন্টারনেটের প্রচারিত দাবি অনুসারে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান অপরূপ চৌধুরী।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের বর্তমান চেয়ারম্যান একেএম আফতাব হোসেন প্রামানিক। গত ২৪ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব থেকে গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পেয়ে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।

Screenshot: Bangladesh Parjatan Corporation. 

অন্যদিকে ২০১৪ সালে দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হন অপরূপ চৌধুরী।

ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে জানা যায়,  ২০১৭ সালের মে মাসে অপরূপ চৌধুরী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে যোগদান করেন এবং এই সময়ে আখতারুজ জামান খান কবির বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান।

অর্থাৎ, অপরূপ চৌধুরী বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের বর্তমান নন, বরং সাবেক চেয়ারম্যান।

তৃতীয় দাবি যাচাই

ইন্টারনেটের প্রচারিত দাবি অনুসারে বাংলাদেশ সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের পরিচালক প্রশান্ত কুমার রায়।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি বাড়ি একটি খামার বা আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক আকবর হোসেন। 

Screenshot: Ektee Bari Ektee Khamar project.

অন্যদিকে গত ২৪ মার্চ মূলধারার অনলাইন গণমাধ্যমে বিডিনিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রশান্ত কুমার রায় এই প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ছিলেন। এ বছরের মার্চে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।

অর্থাৎ, প্রশান্ত কুমার রায় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক নয়, বরং তিনি প্রকল্পটির সাবেক পরিচালক।

চতুর্থ দাবি যাচাই

ইন্টারনেটের প্রচারিত দাবি অনুসারে বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের বর্তমান চেয়ারম্যান মোঃ জিল্লুর রহমান চৌধুরী।

Screenshot: Bangladesh Land Port Authority. 

তার আগে ২০২১ সালের ০৬ জুন থেকে ২০২৩ সালের ২৬ জুন পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন মোঃ আলমগীর। তারও আগে ২০২০ সালের ১০ আগস্ট থেকে ২০২১ সালের ৩১ মে পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন কে. এম. তারিকুল ইসলাম।

তবে ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ছিলেন তপন কুমার চক্রবর্তী।

অর্থাৎ, তপন কুমার চক্রবর্তী  বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের বর্তমান চেয়ারম্যান নয়, বরং তিনি সাবেক চেয়ারম্যান।

পঞ্চম দাবি যাচাই

ইন্টারনেটের প্রচারিত দাবি অনুসারে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশনের (ডিপিডিসি) চেয়ারম্যান তাপস কুমার।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) বর্তমান চেয়ারম্যান মোঃ হাবিবুর রহমান।

Screenshot: DPDC.

অন্যদিকে ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেসময় ডিপিডিসির চেয়ারম্যান ছিলেন তাপস কুমার।

অর্থাৎ, তাপস কুমার ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) বর্তমান চেয়ারম্যান নয়, বরং তিনি সাবেক চেয়ারম্যান।

ষষ্ঠ দাবি যাচাই

ইন্টারনেটের প্রচারিত দাবি অনুসারে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক স্বপন কুমার রায়।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের বর্তমান মহাপরিচালক মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী। 

Screenshot: National Museum of Science and Technology.

অন্যদিকে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, সেসময়  জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক ছিলেন স্বপন কুমার রায়।

অর্থাৎ, স্বপন কুমার রায় জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের বর্তমান মহাপরিচালক নয়, বরং তিনি সাবেক মহাপরিচালক।

সপ্তম দাবি যাচাই

ইন্টারনেটের প্রচারিত দাবি অনুসারে পাবলিক লাইব্রেরির মহাপরিচালক আশীষ কুমার সরকার।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, পাবলিক লাইব্রেরি বা গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক মোঃ আবুবকর সিদ্দিক। 

Screenshot: Public Library.

অন্যদিকে ২০১৫ সালের ২১ মে জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আশীষ কুমার সরকারকে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

২০১৯ সালে আমাদের সময়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সে সময়ও আশীষ কুমার সরকার গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছিলেন।

অর্থাৎ, আশীষ কুমার সরকার জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের বর্তমান মহাপরিচালক নয়, বরং তিনি সাবেক মহাপরিচালক।

অষ্টম দাবি যাচাই

ইন্টারনেটের প্রচারিত দাবি অনুসারে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান নারায়ন চন্দ্র সাহা।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বর্তমান চেয়ারম্যান মোঃ ফরহাদুল ইসলাম। 

Screenshot: NCTB. 

অন্যদিকে ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মূলধারার সংবাদমাধ্যম আজকের পত্রিকার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে যান।

অর্থাৎ, নারায়ণ চন্দ্র সাহা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বর্তমান চেয়ারম্যান নয়, বরং সাবেক চেয়ারম্যান। 

নবম দাবি যাচাই

ইন্টারনেটের প্রচারিত দাবি অনুসারে প্রেস কাউন্সিলের প্রধান শ্যামল চন্দ্র কর্মকার।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের বর্তমান প্রধান বা চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিম। 

Screenshot: Bangladesh Press Council.

২০১৪ সালের ০৪ আগস্ট মূলধারার গণমাধ্যম বাংলা নিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদকে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। তার আগে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক বিচারপতি বি কে দাস ২০১০ সালের ৯ নভেম্বরে তিন বছরের জন্য বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন। এরপর এই পদে কাউকে নিয়োগ করা হয়নি।

২০২১ সালে জাতীয় দৈনিক যুগান্তরের ওয়েবসাইট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের আগস্টে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে মমতাজ উদ্দিনের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. নিজামুল হককে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে সরকার। 

অন্যদিকে প্রেস কাউন্সিলের সরকারি ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, শ্যামল চন্দ্র কর্মকার প্রতিষ্ঠানটির সচিব (অতিরিক্ত সচিব)।

অর্থাৎ, শ্যামল চন্দ্র কর্মকার বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের প্রধান বা চেয়ারম্যান নন, বরং সচিব (অতিরিক্ত সচিব)। তিনি কখনোই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ছিলেন না। 

Image: Rumor Scanner. 

মূলত, বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন পদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কর্মরত আছেন দাবিতে একটি তালিকা ইন্টারনেটে প্রচারিত হচ্ছে। এ দাবির প্রেক্ষিতে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই তালিকাটি ২০১৬ সালের জুন মাস থেকেই ইন্টারনেটে প্রচারিত হচ্ছে। তালিকাটি প্রথম প্রচারের সময়ে দাবিকৃত একটি পদ বাদে বাকি সব পদেই উক্ত ব্যক্তিরা কর্মরত ছিল। কিন্তু বর্তমানে উল্লিখিত পদগুলোতে ভিন্ন ব্যক্তিরা কর্মরত আছেন।

সুতরাং, বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিন্দু ধর্মাবলম্বী দাবিতে প্রচারিত আলোচ্য তালিকাটি বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img