গতকাল (০৫ এপ্রিল) ইংল্যান্ডের মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) সম্মানসূচক আজীবন সদস্যপদ পেয়েছেন বাংলাদেশের মাশরাফি বিন মুর্তজা। কিন্তু এই খবর দেশীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর সুনির্দিষ্ট দুইটি দাবি দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
প্রথম দাবি
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এমসিসির আজীবন সদস্যপদ লাভের সম্মান অর্জন করেছেন মাশরাফি।
উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমের একটি প্রতিবেদন দেখুন চ্যানেল আই।
দ্বিতীয় দাবি
দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে এমসিসির আজীবন সদস্যপদ লাভের সম্মান অর্জন করেছেন মাশরাফি। এর আগে আরও একজন (সাবের হোসেন চৌধুরী) এই সম্মান লাভ করেছিলেন।
উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমের কিছু প্রতিবেদন দেখুন বিডিনিউজ২৪, ডেইলি মেসেঞ্জার, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, বাহান্ন নিউজ, কালের কণ্ঠ, রাইজিং বিডি, বিজনেস জার্নাল, সমকাল, বাংলানিউজ২৪, নয়া দিগন্ত, দৈনিক করতোয়া, বাংলাদেশ টাইমস, একাত্তর টিভি (ইউটিউব), বাংলাদেশ প্রতিদিন, জাগো নিউজ, বিডি২৪ লাইভ, দৈনিক আজাদী, দৈনিক আমাদের সময়, আলোকিত বাংলাদেশ, ডেইলি ক্যাম্পাস, ডেইলি বাংলাদেশ, ইত্তেফাক, যুগান্তর, ইনকিলাব, ঢাকা পোস্ট, বিডিক্রিকটাইম, বাংলাদেশ জার্নাল, সময়ের আলো, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, মানবকণ্ঠ, দৈনিক বাংলা, নতুন সময়, প্রতিদিনের সংবাদ, ডেল্টা টাইমস, Daily Sun, ঢাকা প্রকাশ, বৈশাখী টিভি, ঢাকা মেইল, অনফিল্ড (ইউটিউব), দেশ রূপান্তর, বাংলা ভিশন, চ্যানেল আই (প্রথম দাবি সংশোধন করে দ্বিতীয় দাবি তুলেছে)।
উক্ত দাবিগুলোতে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে ইউটিউবের একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথম বা দ্বিতীয় বাংলাদেশি নয়, তৃতীয় বাংলাদেশি হিসেবে মাশরাফি এমসিসির আজীবন সদস্যপদ লাভ করেছেন। রাইসউদ্দিন আহমেদ ও সাবের হোসেন চৌধুরী যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে এই সম্মাননা লাভ করেছেন। তবে মাশরাফি এই সম্মান পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার। অন্য দুইজন ছিলেন ক্রিকেট সংগঠক।
মাশরাফি প্রথম বাংলাদেশি নয়
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে টুইটারে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) অ্যাকাউন্টে গতকাল ০৫ এপ্রিল প্রকাশিত একটি টুইট খুঁজে পাওয়া যায়।
এমসিসি লিখেছে, “এমসিসি বিশ্বের সেরা কিছু ক্রিকেটারকে ক্লাবের সম্মানসূচক আজীবন সদস্যপদ প্রদান করে। আমরা এখন এই বিশেষাধিকারের সাথে প্রাপ্ত সর্বশেষতম পুরুষ এবং মহিলাদের নাম প্রকাশ করতে যাচ্ছি।”
এমসিসির টুইটে দেওয়া লিংকের সূত্র ধরে ক্লাবটির ওয়েবসাইটে (Lords) এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৮টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের মোট ১৭ জন নারী ও পুরুষ ক্রিকেটারকে এবার আজীবন সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে আছেন মাশরাফি।
এছাড়া ক্রিকেটে অবদান রাখার জন্য নন প্লেয়িং ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন আরও দুইজন।
মাশরাফি ছাড়া ভারত ও ইংল্যান্ড থেকে পাঁচ জন করে, নিউ জিল্যান্ড থেকে দুই জন এবং অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রয়েছেন এক জন করে।
এমসিসির এমন সম্মাননা বাংলাদেশি হিসেবে মাশরাফিই একমাত্র পেয়েছেন কিনা সে বিষয়ে জানতে গিয়ে ‘Lords’ এর ওয়েবসাইটে “MCC HONORARY LIFE MEMBERS” শিরোনামে আরেকটি পাতা খুঁজে পাওয়া যায়।
এই পাতায় আজীবন সদস্যদের তালিকা রয়েছে। এই পাতার বাংলাদেশ অংশে মাশরাফির সাথে এস এইচ চৌধুরী (S.H. Chowdhury) নামে আরও একজনের নাম রয়েছে, যিনি ২০০৩ সালে উক্ত সম্মাননা পেয়েছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত ব্যক্তি সাবের হোসেন চৌধুরী, যিনি বাংলাদেশের একজন ক্রীড়া সংগঠক। তিনি ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে তিনি ক্রিকেটার ছিলেন না।
অর্থাৎ, মাশরাফি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এমসিসির আজীবন সদস্য পদ পাননি।
দ্বিতীয় বাংলাদেশিও নয়
মাশরাফি এমসিসির আজীবন সদস্যপদ পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি নয় শীর্ষক তথ্যটি নিশ্চিত হওয়ার পর অধিকতর অনুসন্ধানে জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’র একই বিষয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম।
প্রথম আলো লিখেছে, “এর আগে বাংলাদেশ থেকে এমসিসির সম্মানসূচক এই সদস্যপদ পেয়েছিলেন ক্রিকেট প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত দুজন। বিসিবির সাবেক সহ–সভাপতি প্রয়াত রাইসউদ্দিন আহমেদ ছিলেন এমসিসির সদস্যপদ পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি। এরপর সদস্যপদ পান সাবেক বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী।”
একই দাবি করেছে আজকের পত্রিকা, কালবেলা, নিউজজি২৪, New Age, সময় টিভি (ইউটিউব), সংবাদ প্রকাশ, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (ইংরেজি), যুগান্তর (২), একুশে টিভি।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে গতকাল (০৫ এপ্রিল) টুইটারের একটি টুইটে রাইসউদ্দিন আহমেদকে এমসিসির পক্ষ থেকে পাঠানো আজীবন সদস্য পদ সংক্রান্ত একটি চিঠির ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। ছবিটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৮১ সালের ১৯ আগস্ট পাঠানো এই চিঠিতে রাইসউদ্দিন আহমেদকে এমসিসির আজীবন সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা জানায় ক্লাবটি।
কিন্তু এমসিসির ওয়েবসাইটে কিওয়ার্ড সার্চ করেও রাইসউদ্দিন আহমেদের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
রিউমর স্ক্যানার টিম পরবর্তীতে এমসিসির ওয়েবসাইটে আজীবন সদস্যদের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখেছে যে তালিকার সকলেই বেঁচে আছেন। মৃত ব্যক্তির নাম সাইট থেকে মুছে ফেলা হতে পারে এমন সম্ভাবনা থেকে রিউমর স্ক্যানার টিম অধিকতর অনুসন্ধানে এমসিসির টুইটার অ্যাকাউন্টে ২০২২ সালের ০৯ আগস্ট রুডি কোয়ের্টজেন এবং ২০২১ সালের ০২ ফেব্রুয়ারি ক্যাপ্টেন স্যার টম মোরে নামে দুই ব্যক্তির মৃত্যুর বিষয়ে টুইট খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে দুই ব্যক্তিকেই এমসিসির আজীবন সদস্য পদ লাভকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু এমসিসির ওয়েবসাইটের আজীবন সদস্যদের তালিকায় উক্ত দুই ব্যক্তির নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ফলে, মৃত ব্যক্তির নাম এমসিসির ওয়েবসাইটের আজীবন সদস্যদের তালিকা থেকে মুছে ফেলা শীর্ষক সম্ভাবনাটি জোরালো হয় বলে প্রতীয়মান হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাইসউদ্দিন আহমেদ ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি মারা যান।
এই তথ্যের সূত্র ধরে উক্ত তারিখের (২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি) পূর্বের এমসিসির ওয়েবসাইটের আজীবন সদস্যদের তালিকা বিষয়ক পেজটির আর্কাইভ ভার্সন (২০২০ সালের ০৯ আগস্ট) খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম।
আর্কাইভ ভার্সন থেকে দেখা যায়, উক্ত পেজে রাইসউদ্দিন আহমেদের নাম রয়েছে।
একইসাথে এমসিসি টুইট করে যে দুজনের (রুডি কোয়ের্টজেন এবং ক্যাপ্টেন স্যার টম মোরে) মৃত্যুর বিষয়ে জানিয়েছে তাদের নামও খুঁজে পাওয়া যায় একই আর্কাইভ ভার্সনে।
অর্থাৎ, এমসিসির আজীবন সদস্য পদ পাওয়া কেউ যদি মারা যায় তবে তার নাম এমসিসির ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। এক্ষেত্রে তাই রাইসউদ্দিন আহমেদের নামও সরিয়ে নিয়েছে এমসিসি।
তবে রাইসউদ্দিন আহমেদের প্রসঙ্গ না এনে “২০০৩ সালে এই ক্যাটাগরিতেই সম্মানসূচক আজীবন সদস্যপদ পান সাবেক বিসিবি সভাপতি ও ক্রিকেট সংগঠক সাবের হোসেন চৌধুরী।” শীর্ষক তথ্য দিয়েছে জনকণ্ঠ, এনটিভি, নিউজ নাউ২৪, বিজনেস পোস্ট বিডি, নিউজ২৪।
মূলত, ১৯৮২ সালে রাইসউদ্দিন আহমেদ এবং ২০০৩ সালে সাবের হোসেন চৌধুরী যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে ইংল্যান্ডের মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) সম্মানসূচক আজীবন সদস্যপদ পান। তাদের পর তৃতীয় বাংলাদেশি হিসেবে (প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার) মাশরাফি অতি সম্প্রতি এই সম্মাননা পেলেও দেশীয় মূলধারার গণমাধ্যমগুলো “মাশরাফিই প্রথম বা দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে এই সম্মাননা পেয়েছেন” বলে তাদের প্রতিবেদনে প্রচার করেছে।
সুতরাং, প্রথম বা দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে মাশরাফির এমসিসির আজীবন সদস্যপদ পাওয়ার দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Twitter: MCC Tweet
- Lords: MCC ANNOUNCES LATEST COHORT OF HONORARY LIFE MEMBERS
- Lords: MCC HONORARY LIFE MEMBERS
- Saber Chowdhury: Honors and Awards
- Lords: MCC HONORARY LIFE MEMBERS – 09 August 2020