নেশার টাকার জন্য স্ত্রীকে হত্যার দাবিটি বিভ্রান্তিকর

সম্প্রতি “মামুন নেশার টাকার জন্য তার স্ত্রীকে হত্যা করে বলে জানিয়েছে ডিবি!” শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। 

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, কলেজ ছাত্রকে বিয়ে করা শিক্ষিকা খাইরুন নাহারের মৃত্যু নিয়ে এমন কোনো বক্তব্য ডিবি পুলিশ দেয়নি। তবে তার মৃত্যুর বিষয়ে শিক্ষিকার ভাগ্নে নাহিদ গণমাধ্যমে দেওয়া এক বক্তব্যে ‘খালামনির স্বামী মামুন একজন নেশাখোর’ বলে দাবি করেন। 

কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনে ১৩ আগস্ট “‘মানসিক চাপে’ ছিলেন কলেজ শিক্ষিকা, মামুনকে দোষারোপ স্বজনদের” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটিতে মৃত্যুর কারণ শিক্ষিকার ভাগ্নে নাহিদ হোসেনকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়, “মামুন মাদকাসক্ত। বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত তিনি পাঁচ লাখ টাকা এবং একটি মোটরসাইকেল নিয়েছেন। সম্প্রতি আরও দামি মোটরসাইকেল চেয়েছেন মামুন। এ নিয়ে তার খালা খায়রুন নাহার মানসিক চাপে ছিলেন। এ ছাড়া সম্প্রতি গুরুদাসপুরে মাদক নিয়ে কিছু বখাটের মধ্যে গোলমাল হয়। ওই ঘটনায় মামুন আসামি হয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে মানসিক ও পারিবারিক বিভিন্ন চাপে অশান্তিতে ছিলেন তার খালা।”

এছাড়া অনলাইন গণমাধ্যম bd24live.com এ ১৪ আগস্ট বিকাল ৩ টা ২৪ মিনিটে “মামুনের কারনে অশান্তিতে ছিলেন নাসরিন” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটিতে নিহত শিক্ষিকার ভাগ্নে নাহিদকে উদ্ধৃত করে জানায়, “আমার খালামনির স্বামী মামুন একজন নেশাখোর। বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত সে ৫ লাখ টাকা ও একটি পালসার মোটরসাইকেল নিয়েছে। সম্প্রতি ওই মোটরসাইকেল তার ভালো লাগছে না এমন কথা জানিয়ে আরো দামী মোটরসাইকেল চেয়েছে। এ নিয়ে তার খালামনি মানসিক চাপে ছিলেন। এছাড়াও সম্প্রতি গুরুদাসপুরে মাদক নিয়ে কিছু বখাটের মধ্যে গোলমাল হয়। ওই ঘটনায় সে আসামি হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে মানসিক, পারিবারিক ও বিভিন্ন চাপে অশান্তিতে ছিলেন তিনি। সবকিছু মিলিয়েই এই ঘটনা ঘটতে পারে। তবে এটি আত্মহত্যা নাকি হত্যা সে বিষয়ে আমরাও নিশ্চিত নই।”

এছাড়া বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল Rtv তাদের ফেসবুক পেইজে ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় “মামুন নেশা করতো; অভিযোগ নিহত শিক্ষিকার পরিবারের।” শীর্ষক শিরোনামে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রচার করে। 

পরবর্তীতে বাংলা ট্রিবিউনে ১৪ আগস্ট বিকাল ৩ টা ১৬ মিনিটে “অসংলগ্ন কথা বলছেন মামুন: পুলিশ” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত আরেকটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এ প্রতিবেদনটিতে মামুন তার স্ত্রীর আত্মহত্যা নিয়ে পুলিশের কাছে ভিন্ন বক্তব্য দেন।

এই প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে পুলিশের কাছে মামুন জানিয়েছেন যে, তার স্ত্রী খায়রুনের ছোট ছেলে বাবার (খায়রুনের আগে স্বামী) কাছে থাকলেও বড় ছেলে থাকে নানার বাড়ি। বিয়ের আগে ব্যাংক, এনজিওতে খায়রুনের ১৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ ছিল। সম্প্রতি বড় ছেলে খায়রুনের কাছে ছয় লাখ টাকার বেশি দামি মোটরসাইকেল দাবি করে। কিনে না দিলে ছেলে আত্মহত্যা করবে বলে ভয় দেখায়।”

 এদিকে এ ঘটনায় ডিবিকে উদ্ধৃত করে নেশার টাকার জন্য মামুন তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি তথ্য ছড়িয়ে পড়লেও মূলধারার কোনো গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

তবে বেসরকারি টেলিভিশন যমুনা টিভির ফেসবুক পেইজে ১৪ আগস্ট রাতে “আলোচিত কলেজ শিক্ষিকার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারে হস্তান্তর” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, নিহত শিক্ষিকার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (পিআইবি) ছায়া তদন্ত করছে। 

এছাড়া বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভির করা একটি প্রতিবেদনে  মামুন জানান, তাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধানের কারণে আত্মীয়-স্বজনরা নানা কটু কথা বলতেন। এ কারণে খাইরুন নাহার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।

অপরদিকে মূলধারার জাতীয় দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকায় ১৫ আগস্ট “চিকিৎসক বললেন শ্বাসরোধে মৃত্যু খায়রুনের” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটিতে কলেজশিক্ষিকা খাইরুন নাহারের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য গঠিত মেডিকেল টিমের প্রধান নাটোর সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. সামিউল ইসলাম শান্ত জানান, মরদেহের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তারা ধারণা করছেন, শ্বাসরোধ হওয়ার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। তারপরও ভিসেরা রিপোর্ট আসলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।

পরবর্তীতে বিষয়টি সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে 

নাটোর সদর থানার ওসি মো. নাছিম আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, ‘মামুন তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে কি না এটা তদন্ত ছাড়া আমরা বলতে পারছি না। আপাতত এটাকে আমরা সুইসাইড হিসেবে ধরে নিচ্ছি।’

মূলত, আজ সকাল ৭ টায় নাটোরের শহরে একটি ভাড়া বাসা থেকে কলেজ শিক্ষিকা খাইরুন নাহারের মরদেহ উদ্ধার পরবর্তী সময়ে কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ছাড়াই ডিবি পুলিশকে উদ্ধৃত করে ‘নেশার টাকার জন্য মামুন তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন’ শীর্ষক দাবিটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রসঙ্গত, ৬ মাস প্রেমের পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর এম হক ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোছা. খাইরুন নাহার (৪০] ও নাটোর এন এস সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মামুন হোসাইন (২২)। সম্প্রতি তাদের বিয়ের এই বিষয়টি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হলে ঘটনাটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

সুতরাং, ‘নেশার টাকার জন্য মামুন তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন’ শীর্ষক দাবিটি বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র

Bangla Tribune: ‘মানসিক চাপে’ ছিলেন কলেজ শিক্ষিকা, মামুনকে দোষারোপ স্বজনদের

Bangla Tribune: অসংলগ্ন কথা বলছেন মামুন: পুলিশ

Rtv Online: ছাত্রকে বিয়ে করা শিক্ষিকা ‘হত্যার’ শিকার, নাকি ‘আত্মহত্যা’! (ভিডিও)

Rtv Online: কটূক্তি করতেন স্বজনরা

Jamuna Tv Facebook Page: আলোচিত কলেজ শিক্ষিকার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারে হস্তান্তর

Dainik Deshrupantar: চিকিৎসক বললেন শ্বাসরোধে মৃত্যু খায়রুনের

আরও পড়ুন

spot_img