চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশের কতিপয় গণমাধ্যমে মাহের আলী রুশো নামে বাংলাদেশি এক শিক্ষার্থীর বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, “মাহের আলী রুশো গত ১৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বোল্ডারে ৯০ শতাংশ স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।“
উক্ত দাবিতে কতিপয় গণমাধ্যমের কিছু প্রতিবেদন দেখুন নিউজ বাংলা২৪, ঢাকা পোস্ট, ইত্তেফাক (প্রিন্ট সংস্করণ), ময়মনসিংহের আলো।
একই শিক্ষার্থী ও তার বাবার একটি সাক্ষাৎকার গত ২৫ এপ্রিল জাতীয় দৈনিক ডেইলি স্টার পত্রিকার ইউটিউব (আর্কাইভ) এবং ফেসবুক পেজে (আর্কাইভ) “যেভাবে একাডেমিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সাফল্য অর্জন করেছে কিশোর মাহের আলী রুশো” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
পত্রিকাটির ওয়েবসাইটেও এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সাক্ষাৎকারের শুরুতে ডেইলি স্টারের সঞ্চালক পরিমল পালমা বলছিলেন, মাহের আলী রুশো ১৫ বছর বয়সে মাস্টার্স করছেন ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বোল্ডারে। জনাব পরিমল রুশোর এই বিষয়টিকে অসাধারণ অর্জন হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ২৩:২০ মিনিট সময় থেকে দেওয়া বক্তব্যে রুশো দাবি করেছেন, তিনি Alison ওপেন ইউনিভার্সিটি নামে একটি প্লাটফর্মে Legal Studies নামে একটি ডিপ্লোমা কোর্স করেছেন। তার এই কোর্স থেকে পাওয়া দুই ক্রেডিট কলোরাডোর মাস্টার্সের Elective কোর্সে যুক্ত হবে।
তাছাড়া, মূলধারার গণমাধ্যম বাংলাভিশন এর ওয়েবসাইটে এবং ইউটিউব চ্যানেলে গত ১০ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, রুশো যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলোরেডো বোল্ডার থেকে সম্পন্ন করেছেন মাইক্রো মাস্টার্স।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যায়, মাহের আলী রুশো যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ইউনিভার্সিটি বোল্ডারে ডাটা সায়েন্সের উপর যে মাস্টার্স করছেন তাতে তিনি ৯০ শতাংশ স্কলারশিপ সুবিধা পাননি বরং কোর্সেরা নামে একটি এডুকেশন প্লাটফর্মের মাধ্যমে করা এই প্রোগ্রামে কোনো স্কলারশিপ সুবিধাই নেই। রুশোকে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করেই প্রোগ্রামটিতে এনরোল করতে হচ্ছে। তাছাড়া, রুশো এলিসন প্লাটফর্মে Legal Studies নামে করা কোর্স থেকে পাওয়া দুই ক্রেডিট কলোরাডোতে তার মাস্টার্স প্রোগ্রামের Elective কোর্সে যুক্ত হবে বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে এলিসনে কোর্সটির কোনো ক্রেডিট নেই এবং মাস্টার্স প্রোগ্রামটিতে ক্রেডিট ট্রান্সফার সুবিধাই নেই।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে, রুশোর ব্যক্তিগত একটি ওয়েবসাইটের সন্ধান পায় রিউমর স্ক্যানার টিম।
ওয়েবসাইটে তার আলোচিত মাস্টার্সটির বিষয়ে একটি ইমেইলের স্ক্রিনশট খুঁজে পাওয়া যায়। রুশো তার ওয়েবসাইটে লিখেছেন, তিনি Coursera তে ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বোল্ডারে Data Science এ মাস্টার্স করছেন। ইতোমধ্যেই তিনি ৩০ টি ক্রেডিটের মধ্যে চারটি ক্রেডিট সম্পন্ন করেছেন বলে উল্লেখ করেন সেখানে (২৭ এপ্রিলের আর্কাইভ অনুযায়ী)।
কিন্তু ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রুশো উল্লেখ করেননি যে তিনি প্রোগ্রামটি কোর্সেরাতে করছেন।
আমরা কোর্সেরার বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখতে পাই, কোর্সেরা একটি আন্তর্জাতিক শিখন প্লাটফর্ম। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক এই প্লাটফর্মটি চালু করেন এবং এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান প্রোগ্রাম বা কোর্স ঘরে বসেই সম্পন্ন করা যায়। এক্ষেত্রে কিছু প্রোগ্রামে কোনো খরচ না থাকলেও অধিকাংশ প্রোগ্রামই অর্থের বিনিময়ে সম্পন্ন করতে হয়।
প্রোগ্রামটির বিষয়ে অনুসন্ধান করে কোর্সেরা এবং কলোরাডো ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে উক্ত কোর্সটি খুঁজে পেয়েছি আমরা।
রুশো এই প্রোগ্রামটি অর্থের বিনিময়ে করছেন কিনা সে বিষয়ে ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেননি তিনি। তবে তার বাবা মোহাম্মদ আলী বলছিলেন (২৭:০০ মিনিট থেকে), রুশো এতদিন ধরে মাস্টার্স, অনার্স বা যত কোর্স বা প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেছে তাতে যে খরচ হয়েছে তা খুবই কম খরচের। সে ৯০-৯২% স্কলারশিপ পেয়েছে। সেটা দিয়েই খরচগুলো হয়েছে। মনে হতে পারে, টাকা দিয়ে কোর্সগুলো করেছে, বিষয়টা তা না।
অর্থাৎ, তিনি দাবি করছেন রুশোর মাস্টার্স প্রোগ্রামটিতে অর্থ খরচ করতে হয়নি।
কিন্তু কোর্সেরায় এই প্রোগ্রামটির টিউশন ফি উল্লেখ রয়েছে, ১৫,৭৫০ ডলার।
এই প্রোগ্রামে কোনো স্কলারশিপের ব্যবস্থা আছে কিনা এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে কলোরাডো ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, এই মুহূর্তে এই প্রোগ্রামে কোনো স্কলারশিপ সুবিধা নেই।
এ বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে আমরা কলোরাডো ইউনিভার্সিটির মাস্টার্সের ডাটা সায়েন্স প্রোগ্রামের সহযোগী অধ্যাপক শ্রীরাম শঙ্করানারায়ানানের (Sriram Sankaranarayanan) সাথে যোগাযোগ করলে তিনিও জানান, “এই প্রোগ্রামে আমার জানামতে কোনো স্কলারশিপ থাকার সম্ভাবনা নেই।”
জনাব শ্রীরাম এ ব্যাপারে আমাদের কলোরাডো কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
পরবর্তীতে কলোরাডো কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাদের পক্ষ থেকেও রিউমর স্ক্যানারকে জানানো হয়, এই প্রোগ্রামের জন্য (ডাটা সায়েন্সের মাস্টার্স) তারা কোনো স্কলারশিপ দেন না।
অর্থাৎ, মাহের আলী রুশো কলোরাডো ইউনিভার্সিটিতে ডাটা সায়েন্সে যে মাস্টার্স প্রোগ্রামটি করছেন সেটি অর্থের বিনিময়েই করতে হচ্ছে তাকে। এই প্রোগ্রামে স্কলারশিপ সুবিধা নেই।
এলিসনের ক্রেডিট কলোরাডোতে ট্রান্সফার শীর্ষক দাবির সত্যতা কতটুকু?
এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম মাহের আলী রুশোর ওয়েবসাইটে উক্ত এলিসনের কোর্সটির একটি সার্টিফিকেট খুঁজে পেয়েছে। সার্টিফিকেটে দেওয়া তথ্য বলছে, তার এই সার্টিফিকেট ইস্যু হয়েছে গত ০৫ মার্চ।
আমরা এলিসনের বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখতে পাই, কোর্সেরার মতো এলিসনও একটি শিখন প্লাটফর্ম। আইরিশ এই ওপেন স্টাডি প্লাটফর্মের পথচলা শুরু ২০০৭ সালে। তবে কোর্সেরার মতো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স এই প্লাটফর্মে পাওয়া যায় না। কোর্সগুলোর কোনো ক্রেডিট সুবিধাও নেই। কোর্স সম্পন্ন করতে কোনো অর্থও ব্যয় করতে হয় না। তবে সার্টিফিকেট পেতে অর্থ ব্যয় করতে হয়।
অনুসন্ধানের স্বার্থে রিউমর স্ক্যানার টিমের একজন সদস্য গত ২৭ এপ্রিল রুশোর করা Legal Studies কোর্সটি এলিসনে এনরোল করে দেখেছে। ঘন্টাখানেকের এই কোর্স সম্পন্ন করতে আমাদের কোনো অর্থ খরচ করতে হয়নি। তবে সার্টিফিকেট পেতে বা ডাউনলোড করতে ৮৩ ডলার প্রদান করতে হবে বলে জানানো হয় (১৫ জুনের সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী)৷ তাছাড়া, এই ডিপ্লোমা কোর্সে কোনো ক্রেডিটও নেই।
পরবর্তীতে কলোরাডোতে লিগ্যাল স্টাডিজের কোনো Elective কোর্স আছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার টিমের একজন সদস্য একই কোর্সে এনরোলের প্রক্রিয়া শুরুর পর এ বিষয়ে কোর্সেরা থেকে আমাদের একটি ইমেইল পাঠিয়ে জানানো হয়, এই কোর্স করতে কোনো GRE, ট্রান্সক্রিপ্ট বা এপ্লিকেশন প্রয়োজন হবে না।
আমরা এনরোল পেজে গিয়ে (স্ক্রিন রেকর্ড রিউমর স্ক্যানার টিমের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে) আলোচিত প্রোগ্রামের ইলেক্টিভ কোর্সগুলোর তালিকা খুঁজে পেয়েছি, যেখানে Legal studies নামে কোনো ইলেক্টিভ কোর্স নেই বলে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।
এ বিষয়ে আরো জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম শ্রীরাম শঙ্করানারায়ানানের (Sriram Sankaranarayanan) সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, “না, আমরা স্বীকৃত নয়, এমন প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রেডিট ট্রান্সফার করি না।”
একই বিষয়ে কলোরাডো কর্তৃপক্ষ রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছে, “এই প্রোগ্রামে ক্রেডিট ট্রান্সফারের সুবিধা নেই।”
অর্থাৎ, রুশো Alison এ Legal Studies নামে করা কোর্স থেকে পাওয়া দুই ক্রেডিট কলোরাডোতে তার মাস্টার্স প্রোগ্রামের Elective কোর্সে যুক্ত হবে বলে যে দাবি করেছেন তা সঠিক নয়৷
রিউমর স্ক্যানারকেও ভুল তথ্য দিয়েছেন রুশো
সার্বিক বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে মাহের আলী রুশোর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল।
রুশোর কাছে তার এলিসনে করা লিগ্যাল স্টাডিজের ডিপ্লোমা প্রোগ্রামটির মাস্টার্সের একটি ইলেক্টিভ কোর্সে এড হওয়া শীর্ষক যে দাবি তিনি করছেন তার বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলাম আমরা।
তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলছিলেন, “আসলে ডেইলি স্টারের সাক্ষাৎকারটি যখন প্রকাশিত হলো (২৫ এপ্রিল), তখন কলোরাডো ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স ডিগ্রিতে ইলেক্টিভ ক্রেডিটে এলিসনের লিগ্যাল স্টাডিজের কোর্স থেকে ট্রান্সফার করা সম্ভব ছিল। কিন্তু নতুন কারিকুলামে এই সুবিধা রাখা হয়নি।”
জনাব রুশো আমাদের কাছে সর্বশেষ আপডেটকৃত কারিকুলামের একটি পিডিএফ সংস্করণও পাঠিয়েছেন, যেখানে হ্যান্ডবুক বা কারিকুলামটি “২০২১ সামার ১ – ২০২২ সামার ২” শীর্ষক তথ্য উল্লেখ রয়েছে।
এই পিডিএফটি পড়ে দেখেছি আমরা। হ্যান্ডবুকটির ৭ম পৃষ্ঠায় ক্রেডিট বিষয়ক প্যারায় উল্লেখ রয়েছে, “এই প্রোগ্রামের পাইলট প্রকৃতির কারণে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা কলোরাডো বোল্ডারের অন্যান্য প্রোগ্রামে অর্জিত ক্রেডিট এই প্রোগ্রামে স্থানান্তরযোগ্য (transferable) নয়।”
একই প্যারায় বলা হয়েছে, “মাস্টার্সের ডাটা সায়েন্স প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে নেওয়া ক্রেডিটগুলো প্রোগ্রাম-নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা এবং গ্র্যাজুয়েট স্কুলের নিয়ম অনুসারে প্রোগ্রামের বিবেচনার ভিত্তিতে এবং গ্র্যাজুয়েট স্কুলের কলোরাডো বোল্ডারের অন্যান্য স্নাতক ডিগ্রি প্রোগ্রামে স্থানান্তরিত করা যেতে পারে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও তাদের বিবেচনার ভিত্তিতে এই প্রোগ্রাম থেকে ট্রান্সফার ক্রেডিট গ্রহণ করতে পারে, তাদের ক্রেডিট মান স্থানান্তরের ভিত্তিতে।”
অর্থাৎ, রুশো দাবি করছেন, গত ২৫ এপ্রিলের পূর্বের কারিকুলাম অনুযায়ী তার এলিসনের ক্রেডিট কলোরাডোয় ট্রান্সফারের সুযোগ ছিল। নতুন কারিকুলামে সে সুযোগ নেই। তিনি আমাদের নতুন কারিকুলামের একটি কপিও পাঠিয়েছেন যেখানে উল্লেখ আছে, কলোরাডোর এই প্রোগ্রামে ক্রেডিট ট্রান্সফারের সুযোগ নেই।
কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে রুশোর ওয়েবসাইটের গত ০১ এপ্রিলের একটি আর্কাইভ ভার্সণে একই কারিকুলামই খুঁজে পাওয়া গেছে, যেখানেও ক্রেডিট ট্রান্সফার বিষয়ক একই তথ্যই উল্লেখ দেখেছি আমরা।
অর্থাৎ, রুশো তার এলিসনে করা লিগ্যাল স্টাডিজের ডিপ্লোমা প্রোগ্রামটির মাস্টার্সের একটি ইলেক্টিভ কোর্সে এড হওয়া শীর্ষক যে দাবি করছেন তা সঠিক নয়।
স্কলারশিপ বিষয়ে কী বলছেন রুশো?
রুশোর কাছে রিউমর স্ক্যানার টিম মাস্টার্স প্রোগ্রামটিতে স্কলারশিপের বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। তিনি আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন, এখন এই প্রোগ্রামে কোনো স্কলারশিপ সুবিধা নেই। তার দাবি, ভবিষ্যতের সেশনগুলোতে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কোর্সেরার এই প্লাটফর্মে স্কলারশিপ মিলবে।
কিন্তু কলোরাডোর ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে, এই প্রোগ্রামে এনরোলকালীন একজন শিক্ষার্থীকে সম্পূর্ণ অর্থ প্রদান করতে হবে।
একই প্রোগ্রামের বিষয়ে কোর্সেরার ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে, কেউ চাইলে Pay as you go পদ্ধতিতেও ফি পরিশোধ করতে পারবে। এর মাধ্যমে এক থেকে তিনটি কোর্সের ফি পরিশোধ করে সেসব কোর্স এনরোল করা যাবে।
রুশোকেও তাই একইভাবে অর্থ বা ফি প্রদান করেই প্রতিটি কোর্স সম্পন্ন করতে হচ্ছে।
৭৫ এর অধিক কোর্স রুশোর: স্বপ্রণোদিত নাকি আমন্ত্রিত হয়ে করা?
মাহের আলী রুশোর কাছে তার দাবিকৃত ৭৫টিরও অধিক অনলাইন কোর্সের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম আমরা। রিউমর স্ক্যানার টিম তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কোর্সগুলো কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাকে অফার করেছে নাকি তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে করেছেন। কোর্স বা সার্টিফিকেট পেতে তার অর্থ খরচ করতে হয়েছে কিনা।
রুশো রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “এডেক্সসহ (edx, অনলাইন এডুকেশন প্লাটফর্ম) অন্যান্য ইউনিভার্সিটি কোর্স প্লাটফর্মে এমন অনেক কোর্স আছে যেগুলো মানুষ অডিট হিসেবে নিতে পারে। কিন্তু আপনি যদি একটি কোর্সে সার্টিফিকেট এবং পূর্ণ এসাইনমেন্ট অর্জন করতে চান তাহলে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এই অর্থের পরিমাণ কোর্সভেদে কমবেশি হয়। এডেক্সে এই ফি এর পরিমাণ ৫০ থেকে ৩০০ ডলারের মধ্যে।”
রুশো বলছেন, “এখন ইউনিভার্সিটিগুলো অনেক সুযোগ দিচ্ছে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য। যেমন, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির Code in Place একটি ফ্রি অনলাইন কোর্স, যেখানে সম্পূর্ণ ফ্রিতে কোর্সটি করার সুযোগ পেয়েছি। এটির নির্বাচন প্রক্রিয়া বেশ কঠোর।”
রুশো রিউমর স্ক্যানারের কাছে দাবি করেছেন, কোর্সগুলো করতে তিনি যেমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছেন ঠিক তেমনি তিনি নিজেও কিছু কোর্স বিভিন্ন এডুকেশন প্লাটফর্ম থেকে অর্থের বিনিময়ে সম্পন্ন করেছেন।
আমরা এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে, রুশোর ওয়েবসাইটে স্ট্যানফোর্ডে প্রোগ্রামটির বিষয়ে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক রুশোকে পাঠানো একটি ইমেইলের স্ক্রিনশট দেখতে পাই৷
ইমেইলটি থেকে জানা যাচ্ছে, স্ট্যানফোর্ড কর্তৃপক্ষ এই প্রোগ্রামের জন্য ৭০ হাজার আবেদন পেয়েছেন। তার মধ্য থেকে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের মধ্যে রুশোও একজন।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে এই প্রোগ্রামটির বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতি বছর ১৬০০ শিক্ষার্থী এই প্রোগ্রামটি সম্পন্ন করার সুযোগ পান।
রুশো এই প্রোগ্রামটি সম্পন্ন করার আমন্ত্রণ পেয়েছেন বলে যে দাবি করা হয়েছে তা সঠিক নয়। এই প্রোগ্রামে এনরোল করার জন্য অন্য সকলের মতো তাকেও আবেদন করতে হয়েছে এবং পরবর্তীতে ১৬০০ শিক্ষার্থীর একজন হিসেবে তিনিও নির্বাচিত হয়েছেন।
অর্থাৎ, রুশো অনলাইনে যেসব কোর্স বা প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেছেন তার সবগুলোই তিনি স্বপ্রণোদিত হয়েই করেছেন।
কলোরাডোর মাস্টার্স: অনলাইন ও অফলাইনের মান একই?
রিউমর স্ক্যানার টিম কলোরাডো কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছিল, অনলাইনে করা ডাটা সায়েন্সের মাস্টার্স প্রোগ্রাম এবং অন ক্যাম্পাসে স্বশরীরে করা কোর্সের মান একই কিনা। কোর্সেরাতে এই কোর্স সবাই করতে পারে। সেক্ষেত্রে কেউ কি এই কোর্স সম্পন্ন করে নিজেকে মাস্টার্স গ্রাজুয়েট দাবি করতে পারবে কিনা।
এই প্রশ্নের জবাবে কলোরাডো কর্তৃপক্ষ আমাদের বলেছে, “এই প্রোগ্রামের অন ক্যাম্পাস এবং কোর্সেরা প্রোগ্রামের কারিকুলাম একই। তবে অন ক্যাম্পাস এবং কোর্সেরার কোর্সগুলো আলাদাভাবে প্যাকেজ করা হয়েছে (উদাহরণস্বরূপ, ক্যাম্পাসের একটি ক্লাস ৩ ক্রেডিটের, যেখানে কোর্সেরার প্রতি ক্লাস এক ক্রেডিটের)। শিক্ষার্থীরা প্রতিটি ক্লাস নিতে পারে যাকে আমরা নন-ক্রেডিট সংস্করণ বলি, যার জন্য শুধুমাত্র Coursera সাবস্ক্রিপশন ফি প্রয়োজন। যাইহোক, আপনি যদি ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বোল্ডার থেকে একাডেমিক ক্রেডিট চান, তবে আপনাকে প্রতিটি কোর্সের জন্য টিউশন ফি দিতে হবে, যা আপনাকে ক্রেডিট সামগ্রীর জন্য পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত অ্যাক্সেস দেবে। একবার আপনি প্রোগ্রামে ৩০ ক্রেডিট সফলভাবে সম্পন্ন করলে, তারপর ডেটা সায়েন্সে মাস্টার অফ সায়েন্স ডিগ্রি অর্জন করবেন।”
রুশো কি কলোরাডো বোল্ডার থেকে মাইক্রো মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন?
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে রুশোর ওয়েবসাইটের গত ২৭ এপ্রিলের একটি আর্কাইভ ভার্সণে রুশোর মাইক্রো মাস্টার্সের একটি সার্টিফিকেট খুঁজে পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
সার্টিফিকেট থেকে জানা যাচ্ছে, রুশো অনলাইন এডুকেশন প্লাটফর্ম edX এর মাধ্যমে University of Maryland Baltimore County থেকে Database Management Systems নামক একটি প্রোগ্রামে মাইক্রো মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে।
সার্টিফিকেটে উল্লিখিত ভেরিফিকেশন আইডির সূত্র ধরে এডেক্সের ওয়েবসাইটে যাচাই করে দেখা যায়, সার্টিফিকেটটি আসল। গত জানুয়ারিতে এটি ইস্যু করা হয়েছে।
অর্থাৎ, মাহের আলী রুশো কলোরাডো থেকে নয়, মাইক্রো মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন University of Maryland Baltimore County থেকে।
মূলত, গত জানুয়ারিতে দেশের কতিপয় গণমাধ্যমে মাহের আলী রুশো নামে বাংলাদেশি এক শিক্ষার্থীর বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, রুশো যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বোল্ডারে ৯০ শতাংশ স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যায়, দাবিটি সঠিক নয়। কোর্সেরা নামে একটি এডুকেশন প্লাটফর্মের মাধ্যমে করা এই প্রোগ্রামে কোনো স্কলারশিপ সুবিধাই নেই। রুশোকে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করেই প্রোগ্রামটিতে এনরোল করতে হচ্ছে। তাছাড়া, রুশো এলিসন প্লাটফর্মে Legal Studies নামে করা কোর্স থেকে পাওয়া দুই ক্রেডিট কলোরাডোতে তার মাস্টার্স প্রোগ্রামের Elective কোর্সে যুক্ত হবে বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে এই প্রোগ্রামে ক্রেডিট ট্রান্সফার সুবিধাই নেই। তাছাড়া, এলিসনে কোর্সটিরও কোনো ক্রেডিট সুবিধা নেই।
প্রসঙ্গত, হোয়াইট হাউসের নাম ব্যবহার করে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি রাকিবের সাফল্যের একটি খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণ করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, মাহের আলী রুশো কলোরাডো ইউনিভার্সিটি বোল্ডারে মাস্টার্সে ৯০ শতাংশ স্কলারশিপ পেয়েছেন শীর্ষক একটি দাবি কতিপয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Maher Ali Rusho: Website
- Statement from Maher Ali Rusho
- Statement from University of Colorado Boulder
- Coursera: Master of Science in Data Science
- Statement from Sriram Sankaranarayanan
- Rumor Scanner’s own analysis