বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কেই প্রথম নয়, এর আগেও দেশে ম্যাকাও পাখির বাচ্চা জন্মেছে

সম্প্রতি, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের বরাতে’দেশে প্রথমবার জন্ম নিলো ম্যাকাও পাখির বাচ্চা’ শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। 

গণমাধ্যমে প্রচারিত এমন প্রতিবেদন দেখুন আরটিভি, প্রথম আলো, জাগো নিউজ২৪, বিডিনিউজ২৪, দেশ রূপান্তর, আমাদের সময়.কম, আজকের পত্রিকা, ডিবিসি নিউজ, ঢাকা পোস্ট, ঢাকা ট্রিবিউন, যুগান্তর, ডেইলি বাংলাদেশ, ভোরের কাগজ, দৈনিক আমাদের সময়.কম, মানবকন্ঠ, অধিকার বিডি, রাইজিং বিডি, অপারেজয় বাংলা, প্রতিদিনের সংবাদ, বাংলাদেশ বুলেটিন, আপন দেশ, কুমিল্লার কাগজ

গণমাধ্যমের ফেসবুক পেইজে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

Image Collage: Rumor Scanner

গণমাধ্যমের প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদন দেখুন ভোরের কাগজ, দৈনিক আমাদের সময়, যুগান্তর। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের বরাতে দেশে প্রথমবারের মতো ম্যাকাও পাখির বাচ্চা জন্মের দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে অন্তত ২০১১ সালেই বাংলাদেশে ম্যাকাও পাখির বাচ্চা জন্ম নেওয়ার তথ্য খোদ গণমাধ্যম সূত্রেই পাওয়া যায়। 

কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে ইংরেজি দৈনিক Daily Star এ ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ‘Macaws breed in captivity‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Daily Star 

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ঢাকার একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানায় দুটি ডিম ফুটে ম্যাকাওয়ের বাচ্চা জন্মেছে। যা সেই সময়ে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ম্যাকাওয়ের প্রজননের ঘটনা। 

Screenshot: Daily Star

এছাড়া প্রতিবেদনটি থেকে ম্যাকাওয়ের বাচ্চা দুইটির ছবিও পাওয়া যায়। পাশাপাশি প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, উপমহাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু ম্যাকাওয়ের প্রজননের জন্য আদর্শ নয়, বিশেষ করে আবদ্ধ পরিবেশে। তবে সেই সময়ে নারী ম্যাকাওটি এপ্রিল, জুন এবং আগস্ট মাসে ডিম দেয়৷ এর মধ্যে প্রথম চারটি ডিম থেকে বাচ্চা না ফুটলেও তৃতীয়বার দেওয়া ডিম থেকে দুইটি ডিম ফুটে বাচ্চা জন্ম নেয়।

Screenshot: Daily Star

পরবর্তীতে মূলধারার অনলাইন পোর্টাল বাংলানিউজ২৪ এ ২০১১ সালের পহেলা অক্টোবর ‘ম্যাকাও ছানাটি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যাচ্ছে‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: Bangla News24

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, রাজধানীর হাতিরপুলে নিজ বাড়িতে মাঝারি আকারের একটি পাখির চিড়িয়াখানা পরিচালনা করেন পাখি-প্রজনন বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল ওয়াদুদ৷ তার এই চিড়িয়াখানাতেই বাংলাদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো জন্ম নেয় ম্যাকাও পাখির দুইটি ছানা। পরবর্তীতে এদের মধ্যে একটি ছানা অসুস্থ হয়ে পড়লে  শিশুপাখিটিকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট প্লিজেন্ট পশু হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

এছাড়া জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠে ২০১৫ সালের ১৩ মে ‘সাত বাচ্চার মা সেই প্রিন্সেস‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: Kaler Kantho

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, পাখি-প্রজনন বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল ওয়াদুদের কাছে থাকা প্রিন্সেস নামের ম্যাকাও পাখিটি ২০১১ সালে প্রথম ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বাচ্চাও হয়। পরবর্তীতে এই পাখিটিই ২০১৫ সালে আরও সাতটি বাচ্চার জন্ম দেয়।

Screenshot: Kaler Kantho

তবে শুধু আব্দুল ওয়াদুদের কাছেই নয় গণমাধ্যম সূত্রে আরও বেশ কয়েকজন পাখি পালকের কাছে বাংলাদেশে ম্যাকাওয়ের বাচ্চা জন্ম নেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।

যেমন, ২০১৮ সালের ১২ মে জাতীয় দৈনিক সমকালে ‘ম্যাকাও প্রেমিক রনি‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Samakal

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিলেটের শ্রীমঙ্গলের রনি রাজ আহমেদ ম্যাকাও পাখি পোষেন। সেই সময়ে রনি রাজ আহমেদের পক্ষীশালায় ১১টি পূর্ণবয়স্ক ম্যাকাও পাখি ছিল। তিনি কলোনি করে পাখি পোষেন। তার পাখির কলোনিতে নয়টি বাচ্চা দেয় তিন জোড়া ম্যাকাও।

Screenshot: Samakal

উল্লেখ্য, কলোনি হলো অনেক বড় জায়গায় পাখি ছেড়ে পালন করা। প্রায় মুক্ত পরিবেশে পাখি খেলাধুলা করে। সঙ্গী বেছে নেয়। কলোনি পদ্ধতিতে বাংলাদেশে রনি রাজ প্রথম ম্যাকাও-এর বাচ্চা ফোটাতে পেরেছেন। তার আগে ড. ওয়াদুদ, শহীদুল ইসলাম পিন্টু ম্যাকাও-এর বাচ্চা উৎপাদনে সফল হন। যদিও তা কলোনি পদ্ধতিতে ছিল না।

Screenshot: Samakal

পরবর্তীতে ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ, প্রাণী কল্যাণ ও সাপ বিষয়ক সচেতনতা নিয়ে কাজ করা অলাভজনক উদ্যোগ Deep Ecology and Snake Conservation Foundation এর ফেসবুক গ্রুপের একটি পোস্টে আকিজ ওয়াইল্ড লাইফ ফার্মের ইনচার্জ ও  গ্রুপটির এডমিন আদনান আজাদের একটি কমেন্ট খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে তিনি লিখেন, ‘২০০৯ সালে আমিই বাংলাদেশে প্রথম ম্যাকাও সফল ব্রিডিং শুরু করি। এরপর বাংলাদেশে আরো অনেকেই ম্যাকাও ব্রিডিং করেছে। ২০০৯ সালে ব্রিডিং করলেও ২০১১তে ফেসবুক প্রথম ভিডিও পোস্ট আপশন চালু করলে আমি সেই ভিডিও পোস্ট দেই যা আমার ফেসবুকে আজও আছে।’ 

Screenshot: Adnan Azad Facebook Comment

তিনি তার এই কমেন্টে ২০১১ সালের ১৪ আগস্ট ফেসবুকে ‘বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া প্রথম ম্যাকাউ ছানা‘ শীর্ষক তার ধারণকৃত একটি ভিডিও দৃশ্যও সংযুক্ত করেন। 

Screenshot: Adnan Azad Facebook Post 

রিউমর স্ক্যানার টিমের এই পর্যন্ত অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয় যে, দেশে এবারেই প্রথম নয়, ইতোপূর্বেও দেশে ম্যাকাও পাখির বাচ্চা জন্মের ঘটনা ঘটেছে।

পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করে। 

তিনি এ প্রসঙ্গে রিউমর স্ক্যানারকে জানান, ‘ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা বা অন্য কোথাও ব্যক্তিগতভাবে কেউ ম্যাকাওয়ের বাচ্চা জন্ম দিয়েছে কি না তা আমাদের জানা নেই। তবে কেউ চাইলে করতেও পারে। কিন্তু সরকারিভাবে অর্থাৎ আমাদের কোনো সাফারিপার্ক বা চিড়িয়াখানায় এর আগে হয় নাই, এটাই প্রথম।’

অর্থাৎ, দেশে এর আগেও ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় ম্যাকাও পাখি জন্ম নিলেও সরকারিভাবে অর্থাৎ দেশের কোনো সাফারিপার্ক বা চিড়িয়াখানায় এবারই প্রথম ম্যাকাও পাখির বাচ্চার জন্মের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু পার্ক কর্তৃপক্ষের বরাতে গণমাধ্যমে এই তথ্যটিকেই দেশে প্রথমবারের মতো ম্যাকাও পাখির বাচ্চা জন্ম নেওয়ার ঘটনা দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ পূর্বে গণমাধ্যমের বরাতেই দেশে একাধিকবার ম্যাকাও পাখি জন্ম নেওয়ার সংবাদ জানা যায়।

মূলত, সম্প্রতি গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ম্যাকাও পাখির বাচ্চা জন্মের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে পরবর্তীতে দেশীয় একাধিক গণমাধ্যম সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের বরাতে প্রচার করে যে, এটিই দেশে প্রথমবারের মতো ম্যাকাও পাখির বাচ্চা জন্ম নেওয়ার ঘটনা। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ম্যাকাও পাখির বাচ্চা জন্মানোর ঘটনাটি প্রথমবারের মতো দেশে ম্যাকাও পাখির বাচ্চা জন্ম নেওয়ার ঘটনা নয়। প্রকৃতপক্ষে, খোদ গণমাধ্যম সূত্রেই ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতো ম্যাকাও পাখির বাচ্চা জন্মানোর তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া অনুসন্ধানে ব্যক্তি উদ্যোগে ২০০৯ সালেও দেশে ম্যাকাও পাখির প্রজননের তথ্য পাওয়া যায়। 

সুতরাং, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের বরাতে সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ম্যাকাও পাখির বাচ্চা জন্ম নেওয়ার দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img