যশোরে যুবলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যার দৃশ্য দাবিতে নড়াইলে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনির ভিডিও প্রচার

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি গণপিটুনির ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “যশোরে যুবলীগ নেতাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ইউনূস বাহিনী”।

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি উক্ত দাবিতে প্রচারিত উপরোল্লিখিত ভিডিও পোস্টগুলো প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজারেরও অধিক বার দেখা হয়েছে এবং প্রায় ১,৫০০ এরও অধিক পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওগুলোতে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

এরূপ দাবিতে এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি যশোরে যুবলীগ নেতাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার দৃশ্যের নয়৷ প্রকৃতপক্ষে এটি গত ১৪ আগস্টের নড়াইলের রূপগঞ্জ বাজারের ভিডিওটি এবং প্রদর্শিত ব্যক্তিকে চোর ও ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়া হয়। তাছাড়া, গণপিটুনির শিকার হওয়া উক্ত ব্যক্তি এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি বেঁচে আছেন।

অনুসন্ধানে মূলধারার গণমাধ্যম ‘চ্যানেল আই’ এর সাবেক সাংবাদিক ‘মধু সরকার’ এর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ১৪ আগস্টে প্রচারিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত গণপিটুনি খাওয়া ব্যক্তি ও আশেপাশের কয়েকজন ব্যক্তি ও পোশাকের মিল পাওয়া যায়। 

Comparison : Rumor Scanner

ভিডিওটির ক্যাপশনে বলা হয়, “নড়াইলের রুপগঞ্জ বাজার থেকে ছিনতাইকারীকে সাধারণ জনগণ গণপিটুনি দেয়,পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে….চোর দুইজনকে”। এছাড়াও, ‘MD Shakib Arfin’ নামের আরেকটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেও উক্ত ঘটনার ভিডিও গত ১৪ আগস্টে প্রচার হতে দেখা যায়। পোস্টটির ক্যাপশনে বলা হয়, “নড়াইলের রুপগঞ্জ  বাজার থেকে সোনার চেইন ছিনতাই করতে গিয়ে  ছিনতাইকারী সাধারণ জনগণের কাছে ধরা পড়ে পরে তাকে গণপিটুনি দেয়,পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে”।

উক্ত তথ্যের সূত্র ধরে গুগল ম্যাপে নড়াইলের রূপগঞ্জ বাজার এলাকা পর্যবেক্ষণ করলে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে রূপগঞ্জ বাজারের পারিপার্শ্বিক অবস্থার দৃশ্যের মিল পাওয়া যায় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে ঘটনাস্থল নড়াইলের রূপগঞ্জ বাজার।

পরবর্তীতে উক্ত ভিডিওটির বিষয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ঢাকা মেইল’ এর নড়াইল জেলা প্রতিনিধি হাবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করে। তিনি ভিডিওটি দেখে জানান, ঘটনাটি গত ২-৩ দিন আগে নড়াইলের রূপগঞ্জ বাজারে ঘটেছে৷ ছিনতাইকারী সন্দেহে উক্ত ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই এবং উক্ত ব্যক্তি এখনও বেঁচে আছেন।

এ বিষয়ে নড়াইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজেদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনিও নিশ্চিত করেন, গণপিটুনির ঘটনাটি চোর সন্দেহে ঘটেছে এবং যুবলীগ নেতা হওয়ার দাবিটি সঠিক নয়। তিনি আরো জানান, গণপিটুনির শিকার হওয়া ব্যক্তি বর্তমানে বেঁচে আছেন এবং জেলখানায় আছেন।

এছাড়াও, অনুসন্ধানে মূলধারার গণমাধ্যম দেশ টিভির ওয়েবসাইটে ‘যশোরে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে আওয়ামী লীগ নেতা আটক’ শিরোনামে গত ১৭ আগস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “যশোরে ফেসবুকে ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও আরবপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন সাজু আটক হয়েছেন। শনিবার (১৬ আগস্ট) গভীর রাতে শহরতলীর পুলেরহাট কৃষ্ণবাটি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। তিনি ওই এলাকার সিদ্দিক হোসেনের ছেলে।…পুলিশ জানায়, সাজু তার ফেসবুক আইডি ‘আমার বাংলাদেশ’ থেকে “যশোরে যুবলীগ কর্মীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা” শিরোনামে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। তবে ভিডিওটি যশোরের নয়, বরং ১৪ আগস্ট নড়াইলের রূপগঞ্জে ছিনতাইকারীকে মারধরের ঘটনা। ওই ভিডিও বিকৃত করে যশোরের ঘটনা হিসেবে প্রচার করা হয়। এর মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিতর্কিত করা, অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি।”

সাম্প্রতিক সময়ে যশোরে কোনো যুবলীগ নেতা গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন কি না এ বিষয়ে অনুসন্ধান করলে এমন কোনো ঘটনা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়নি। তবে মূলধারার গণমাধ্যম ‘দ্য ডেইলি স্টার’ এর ওয়েবসাইটে গত ১৩ আগস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “যশোরের সদর উপজেলায় রেজাউল ইসলাম (৪০) নামে এক যুবলীগ কর্মীকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। আজ বুধবার (১৩ আগস্ট) যশোর কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসনাত এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, রেজাউলের বাবার নাম গোলাম তোরফদার। স্থানীয় বাসিন্দাদের তথ্য অনুসারে, একদল দুর্বৃত্ত ভোররাতে রেজাউলকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং বাড়ির পাশেই গলা কেটে হত্যা করে।”

সুতরাং, গত ১৪ আগস্টে নড়াইলের রূপগঞ্জ বাজারে চোর ও ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনির ভিডিওকে যশোরে যুবলীগ নেতাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img