সম্প্রতি একাধিক গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ইসলাম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন।
খবরগুলোয় দাবি করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী মেলোনি গত ১৭ ডিসেম্বর তার দলের দলের পক্ষ থেকে রোমে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, ইসলামি সংস্কৃতি ইউরোপীয় সভ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইসলামি সংস্কৃতি এবং ইউরোপীয় সভ্যতার মূল্যবোধ ও অধিকারের একটি ‘সামঞ্জস্যতা সমস্যা’ রয়েছে। ইতালিতে শরিয়া আইন প্রয়োগ করতে দেবেন না তিনি।
কতিপয় গণমাধ্যমে এমনও দাবি করা হয়েছে যে, বেশ আগে ধারণ করা সেই ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) এক বিবৃতিতে মেলোনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভিডিওর বক্তব্যটি আমার এবং আমি এখনও মনে করি যে ইসলামি সংস্কৃতি বা এই সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং ইসলামে স্বীকৃত অধিকার ও মূল্যবোধের সঙ্গে আমাদের সভ্যতার সামঞ্জস্যগত সমস্যা রয়েছে।’
উক্ত দাবিগুলোতে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন সময় টিভি, একাত্তর টিভি, এনটিভি, মানবজমিন, ইনকিলাব, নয়া দিগন্ত, দৈনিক সংগ্রাম, নয়া শতাব্দী, আমাদের সময়.কম, ঢাকা পোস্ট, রাইজিং বিডি, খবর সংযোগ, বাহান্ন নিউজ, বাংলাদেশ মোমেন্টস, বাংলা২৪ লাইভ নিউজপেপার।
উক্ত দাবিগুলোতে গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন এই সময়, ফার্স্ট পোস্ট।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, জর্জিয়া মেলোনি ইসলাম নিয়ে সম্প্রতি কোনো বিরূপ মন্তব্য করেননি বরং ২০১৮ সালে তার এ সংক্রান্ত একটি বক্তব্যের ভিডিও প্রচার করে উক্ত দাবিটি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে গত ১৭ ডিসেম্বর রোমে আয়োজিত Atreju নামক সরকারি দলের আলোচিত অনুষ্ঠানের বিষয়ে ইতালির সংবাদমাধ্যম Rai News এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী মেলোনির বিস্তারিত বক্তব্যে ইসলাম বিষয়ে কোনো মন্তব্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
আমরা ইতালির আরো কিছু সংবাদমাধ্যমে (১, ২, ৩) একই অনুষ্ঠানে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে উল্লেখ পেলেও তাকে ইসলাম বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। মেলোনির সেদিনের বক্তব্যের পুরো লাইভ দেখুন এখানে।
তাছাড়া, ইতালির প্রধানমন্ত্রীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত জর্জিয়া মেলোনির সাম্প্রতিক সময়ে অংশ নেওয়া অনুষ্ঠানগুলোর প্রেস রিলিজ বিশ্লেষণ করেও ইসলাম সম্পর্কে তার কোনো বক্তব্য দেওয়ার বিষয়ে তথ্য মেলেনি।
পরদিন সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) তিনি তার ইসলাম নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছেন এমন দাবির বিষয়ে অনুসন্ধানে ইতালির গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ না পেলেও মেলোনির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে সেদিন প্রকাশিত একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়৷ তবে এই পোস্টে ইসলাম বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
আমরা পরবর্তীতে এ বিষয়ে জানতে ইতালির ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টা ডট নিউজের (Facta.news) ফ্যাক্টচেকার ফ্রান্সেসকা কাপোচ্চিয়ার (Francesca Capoccia) সাথে কথা বলেছি। তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী মেলোনি সাম্প্রতিক সময়ে ইসলাম নিয়ে উক্ত মন্তব্য করেননি।
রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে ইতালির আরেক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান পেজেল্লা পলিটিকার (Pagella Politica) এডিটোরিয়াল ম্যানেজার কার্লো কানেপার (Carlo Canepa) সাথেও কথা বলেছি আমরা। তিনি বলছিলেন, মেলোনি ২০১৮ সালে এমন একটি মন্তব্য করেছিলেন। সে বছরের ০৮ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (০১:৫৯ মিনিট সময় থেকে) বলেন, আমি বিশ্বাস করি যে ইসলামী সংস্কৃতি বা এর কিছু ব্যাখ্যা এবং আমাদের সভ্যতার অধিকার ও মূল্যবোধের মধ্যে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। আমি অবগত যে ইতালির অধিকাংশ ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সৌদি আরব থেকে অর্থায়ন পায়, যারা এমন একটি দেশ যেটি দেশীয়ভাবে শরিয়া আইন প্রয়োগ করে। শরিয়া ব্যভিচারের জন্য পাথর মারা, ধর্মত্যাগের জন্য মৃত্যুদণ্ড এবং সমকামিতার জন্য মৃত্যুদণ্ডকে বোঝায়। এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। এর অর্থ ইসলাম সম্পর্কে সাধারণীকরণ নয় বরং ইউরোপে ইসলামিকরণের একটি প্রক্রিয়াকে স্বীকার করা যা আমাদের সভ্যতার মূল্যবোধ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বিচ্ছিন্ন।
কার্লো কানেপা আমাদের বলছিলেন, মেলোনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পূর্বে ইসলাম সম্পর্কে প্রায়ই সমালোচনামূলক মতামত প্রকাশ করতেন। ২০১৬ এবং ২০২১ সালেও দুইবার এমন মন্তব্য করে সমালোচনায় পড়েছিলেন তিনি৷
তবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, ইসলাম সম্পর্কে তার সমালোচনামূলক মন্তব্য করা কমেছে বলে ধারণা কানেপার। উল্টো ইসলামের পক্ষেই তাকে অবস্থান করতে দেখেছেন তিনি। কানেপা জানালেন, গত ২৫ অক্টোবর এক সংসদীয় বক্তৃতায় মেলোনি ইসরায়েলের উপর হামাসের আক্রমণ এবং ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করেছিলেন।
মূলত, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এক বক্তব্যে বলেন, ইসলামি সংস্কৃতি এবং ইউরোপীয় সভ্যতার মূল্যবোধ ও অধিকারের একটি ‘সামঞ্জস্যতা সমস্যা’ রয়েছে। ইতালিতে শরিয়া আইন প্রয়োগ করতে দেবেন না তিনি। তার এই বক্তব্যকে সাম্প্রতিক দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, জর্জিয়া মেলোনি ২০২২ সালের অক্টোবরে ইতালির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
সুতরাং, ২০১৮ সালে ইতালির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির ইসলাম নিয়ে করা বিরূপ মন্তব্যের একটি ভিডিওকে সাম্প্রতিক ঘটনা দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Rai News: Meloni closes Atreju by attacking Schlein and Conte. “It won’t be low blows that make me give up”
- Italian Government: Website
- Statement from Francesca Capoccia
- Statement from Carlo Canepa
- Giorgia Meloni: Video Statement
- Giorgia Meloni: Facebook Post
- Rumor Scanner’s own investigation