সম্প্রতি, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘ইজরায়েল তার আত্মরক্ষার অধিকার রাখে’ শীর্ষক মন্তব্য করেছেন দাবিতে ইংরেজি জাতীয় দৈনিক ডেইলি স্টারের ফটোকার্ডের ডিজাইন সম্বলিত একটি ছবি ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডেইলি স্টার ড. ইউনূসের বক্তব্য দাবিতে এমন কোনো ফটোকার্ড প্রকাশ করেনি বরং গত ০৫ অক্টোবর গণমাধ্যমটি প্রকাশিত ভিন্ন একটি ফটোকার্ডে থাকা বক্তব্য এডিট করে উক্ত ভুয়া মন্তব্যটি ড. ইউনূসের নামে প্রচার করা হচ্ছে।
দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে প্রচারিত ফটোকার্ডটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে, কথিত এই ফটোকার্ড ডেইলি স্টারের বাংলা সংস্করণের ফেসবুক পেজে প্রকাশের তারিখ উল্লেখ রয়েছে ১০ অক্টোবর, ২০২৩।
উক্ত তারিখ সূত্রে গণমাধ্যমটির বাংলা সংস্করণের ফেসবুক পেজে গত ১০ অক্টোবর প্রকাশিত এমন কোনো ফটোকার্ডের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। গণমাধ্যমটির ওয়েবসাইটেও আলোচিত মন্তব্য সংবলিত ড. ইউনূস বিষয়ক কোনো সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে আরো অনুসন্ধান করে ডেইলি স্টারের বাংলা সংস্করণের ফেসবুক পেজে গত ০৫ অক্টোবর প্রকাশিত একটি ফটোকার্ডের সঙ্গে ড. ইউনূসের মন্তব্য দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত ফটোকার্ডটির কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে ফটোকার্ড দুইটিতে থাকা ড. ইউনূসের বক্তব্যের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। এই ফটোকার্ডে থাকা ড. ইউনূসের মন্তব্যটি এমন, “কেন শঙ্কিত হবো? আমি অপরাধ করিনি, শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাকে ডেকেছে, সে জন্য আমি এসেছি।”

অন্যদিকে ফেসবুকে প্রচারিত ফটোকার্ডটিতে ড. ইউনূসের দাবিতে প্রচারিত বক্তব্যটি হলো, “ইজরায়েল তার আত্মরক্ষার অধিকার রাখে।”
০৫ অক্টোবর প্রকাশিত ডেইলি স্টারের ফটোকার্ডের সূত্রে সেদিন গণমাধ্যমটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সংবাদটি পড়ে দেখেছি আমরা। ড. ইউনূস সেদিন দুদক কার্যালয়ে তার বিরুদ্ধে চলা মামলার বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। তবে চলমান ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সংঘাত বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ বিষয়ে জানতে ডেইলি স্টারের বাংলা সংস্করণের সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা ফটোকার্ডটি সম্পর্কে রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “এটা মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা।”
একইদিন (০৫ অক্টোবর) ড. ইউনূসের নিজের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে সাংবাদিকদের সাথে তার সেদিনের বক্তব্যের বিষয়ে একটি পোস্ট পাওয়া যায়৷ এখানেও তিনি উক্ত দাবিতে এমন কোনো মন্তব্য করার তথ্য মেলেনি। অবশ্য, ড. ইউনূসের তা করার কথাও নয়। কারণ, চলমান এই সংঘাত শুরুই হয়েছে তার দুইদিন পর (০৭ অক্টোবর)।
ড. ইউনূস পরবর্তীতে এমন কোনো মন্তব্য করেছেন কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে তাঁর ফেসবুক পেজ, তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠান Yunus Centre এর ফেসবুক পেজ এবং দেশীয় গণমাধ্যমে এমন কোনো মন্তব্য তিনি করেছেন শীর্ষক দাবির পক্ষে প্রমাণ মেলেনি।
এমন বক্তব্য ইউনূস ব্যতিত অন্য কেউ কি দিয়েছেন?
আলোচিত মন্তব্যটি ড. ইউনুস ব্যতিত অন্য কেউ করেছে কিনা সে বিষয়ে কিওয়ার্ড সার্চ করে রিউমর স্ক্যানার টিম দেখেছে, হুবহু একই মন্তব্য বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং দেশটির প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
সর্বশেষ গত ০৭ অক্টোবর মূল ধারার সংবাদমাধ্যম ‘দেশ রূপান্তর’ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও একই মন্তব্য পাওয়া যায়। হামাস ইস্যুতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনালাপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উক্ত মন্তব্য করেছেন বলে কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার বরাতে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এ সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন এখানে।
তাছাড়া, চলতি বছরের ০৬ এপ্রিলও একই ধরণের মন্তব্য করা হয় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের পক্ষ থেকে। দেখুন এখানে।
অর্থাৎ ড. ইউনূসকে নিয়ে করা ডেইলি স্টারের পুরোনো একটি ফটোকার্ডে তাঁর বক্তব্যটির উপর ভিন্ন আরেকজনের বক্তব্য জুড়ে দিয়ে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।
দাবিটির সূত্রপাত কীভাবে?
ফেসবুকের মনিটরিং টুলসহ একাধিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম দেখেছে, গত ১০ অক্টেবর রাত ১০ টা ০১ মিনিটে ফেসবুকে Mohona Sanju নামে একটি অ্যাকাউন্ট (আর্কাইভ) থেকে “শেখ হাসিনা রিজার্ভ ফোর্স ” নামক ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি গ্রুপে (আর্কাইভ) এ বিষয়ে সম্ভাব্য প্রথম পাবলিক পোস্ট করা হয়৷
পোস্টটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

মোহনা সানজুর অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করে আমাদের কাছে এটি ফেক আইডি বলে প্রতীয়মান হয়েছে। গত ০১ অক্টোবর এই অ্যাকাউন্টে প্রথম পাবলিক পোস্ট করা হয়। সর্বশেষ গত ১০ অক্টোবর রাতে যে নারীর ছবি তিনি পাবলিক প্রাইভেসিতে আপলোড করেছেন তা পূর্ব থেকেই ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে পেয়েছি আমরা। দেখুন এখানে, এখানে।

আমরা “শেখ হাসিনা রিজার্ভ ফোর্স ” নামক ছয় সদস্য বিশিষ্ট গ্রুপটিও পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, এই গ্রুপটি (আর্কাইভ) গত ১০ অক্টোবর সন্ধ্যা ছয়টা ৫৪ মিনিটে চালু করা হয়েছে এবং চালু করা হয়েছে মোহনা সানজুর অ্যাকাউন্ট থেকেই।

মূলত, গত ০৫ অক্টোবর দুদক কার্যালয়ে নিজের বিরুদ্ধে চলা মামলার বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেদিন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের ফেসবুক পেজে তাঁর বক্তব্য নিয়ে একটি ফটোকার্ড প্রকাশিত হয়। উক্ত ফটোকার্ডে ড. ইউনূসের বক্তব্য এডিট করে তিনি “ইজরায়েল তার আত্মরক্ষার অধিকার রাখে।” শীর্ষক মন্তব্য করেছেন দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে জেনেছে, ড. ইউনূস চলমান ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সংঘাত ইস্যুতে এমন কোনো মন্তব্য করেননি। তবে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাম্প্রতিক সময়ে এবং পূর্বে বিভিন্ন সময়ে হুবহু একই মন্তব্য করেছেন।
প্রসঙ্গত, চলমান ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সংঘাত ইস্যুতে একাধিক ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার৷
সুতরাং, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস “ইজরায়েল তার আত্মরক্ষার অধিকার রাখে।” শীর্ষক মন্তব্য করেছেন দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং উক্ত দাবিতে প্রচারিত ফটোকার্ডটিও বিকৃত বা এডিটেড।
তথ্যসূত্র
- Daily Star: Facebook Post
- Daily Star: আমি অপরাধ করিনি, শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই: ড. ইউনূস
- Statement from Golam Mortaza, Daily Star Bangla
- Rumor Scanner’s own investigation