দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১৮ কোটি – টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী কি এমন কিছু বলেছেন?

সম্প্রতি, জনশুমারি এবং গৃহ গণনার ফলাফল প্রকাশের পর গত মে মাসে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সেটি হলো দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮ কোটি শীর্ষক একটি সংবাদ।

জনশুমারি ও গৃহ গণনার প্রাথমিক রিপোর্ট থেকে জানা যায় দেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। জনশুমারির এই রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সেই সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য প্রচার হতে থাকে যে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যদি ১৮ কোটি হয়, তাহলে মোট জনসংখ্যা কিভাবে সাড়ে ১৬ কোটি?

এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, বাংলা ভিশন, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ দেখুন- এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

হুয়াওয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বরাতে সংবাদমাধ্যম গুলোতে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮ কোটি বিষয়টিকে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এর বক্তব্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। 

এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন- বনিক বার্তা (archive) নিউজ বাংলা ২৪ (archive), ডেইলি বাংলাদেশ (archive), বিজনেস ইনসাইডার বিডি (archive)।

দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কি ১৮ কোটি? টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী এমন কিছু কি বলেছেন? তা অনুসন্ধান করেছে রিউমর স্ক্যানার। 

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত মে মাসে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত হুয়াওয়ে এশিয়া প্যাসিফিক ডিজিটাল ইনোভেশন কংগ্রেস-২০২২ সম্মেলনের প্রথম দিনে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল স্ট্র‍্যাটেজি অ্যান্ড প্র‍্যাকটিস’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বক্তব্য দিয়েছিলেন টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। 

সে সময় বেশকিছু গণমাধ্যমে উক্ত অনুষ্ঠানে মন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে দেশে এখন ১৮ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শীর্ষক সংবাদটি প্রকাশ করেছিল। সংবাদগুলোতে বলা হয় মোস্তফা জব্বার তার বক্তব্যে এই কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি হুয়াওয়ে থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়েছে বলে প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়।

তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুরে দেয়া সেই বক্তব্যে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার ‘দেশে ১৮ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে’ শীর্ষক কোন কথা বলেননি। বরং তিনি তার বক্তব্যের শেষ দিকে একটি স্লাইড প্রদর্শন করেন। সেই স্লাইডে দেখা যায়, দেশে টেলিফোন সাবস্ক্রিপশন বা মোবাইল গ্রাহক ১৮ কোটি এবং ইন্টারনেট সাবস্ক্রিপশন বা গ্রাহক প্রায় ১২ কোটি ৫০ লাখ।

সেখানে দেয়া টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এর  বক্তব্য দেখুন এখানে। ভিডিওটির ৫০ তম মিনিট থেকে পরবর্তী ২০ মিনিটে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এর সেখানে দেয়া পুরো বক্তব্য রয়েছে এবং প্রদর্শিত স্লাইডটি দেখুন ভিডিওর ১০৭ তম মিনিটে। 

মূলত হুয়াওয়ের প্রেস রিলিজের বরাতে সংবাদমাধ্যম গুলো টেলিফোন সাপস্ক্রিপশন বা মোবাইল গ্রাহক ১৮ কোটির এই সংখ্যাকে সেসময় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে প্রচার করায় ১৮ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শীর্ষক বিভ্রান্তিটির উৎপত্তি ঘটে। 

অর্থাৎ, উক্ত প্রেস রিলিজের বরাতে কতিপয় সংবাদমাধ্যম টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এর বক্তব্যকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রকাশ করেছে।

ছড়িয়ে পড়া এই বিষয়টি নিয়ে মোস্তাফা জব্বার এর সাক্ষাতকার খুঁজে পাওয়া যায় গত ২৮ জুলাই News Bangla 24 এর ‘দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১৮ নয়, সাড়ে ১২ কোটি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে। 

উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘যে খবরটি এখন ভাইরাল হচ্ছে, সেটি সে সময় মিসকোট করা হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানে আমি স্পষ্ট করে বলেছিলাম যে দেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮ কোটির ওপরে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নয়।’

তিনি বলেন, ‘দেশে মোবাইল ব্যবহারকারী ১৮ কোটি। আপনি যদি এখনও বিটিআরসির ওয়েবসাইটে যান তাহলে দেখতে পাবেন মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮ কোটির ওপরে। মে মাসে আমি সে তথ্যই দিয়েছি। 

‘আমি নরমালি স্মৃতিভ্রষ্ট হই না। ২০০৮ সালে দেশে মোট মোবাইল ব্যবহারকারী ছিল ৪ কোটি। তা থেকে বেড়ে ১৮ কোটি হয়েছে।’

মোস্তাফা জব্বার আরো বলেন, ‘ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২০০৮ সালে ছিল সাড়ে ৭ লাখ, যেটা এখন হয়েছে ১২ কোটির ওপরে। এটাই প্রকৃত তথ্য। এখন কেউ যদি মিস রিপোর্ট করে সেটার দায়দায়িত্ব তো আমার না।

দেশে বর্তমান ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কত?

বিটিআরসির ওয়েবসাইটের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুসারে জুন-২০২২ এ দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৬২ লাখ ১০ হাজার। 

কিভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা তৈরি হয়?

প্রতি মাসেই দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রকাশ করে থাকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এই সংখ্যা প্রকাশে তারা সবশেষ ৯০ দিনে কোনো সিমে ইন্টারনেট চালু করার বিষয়টি বিবেচনা করে।

সবশেষ ৯০ দিনের মধ্যে কোনো সিমে ইন্টারনেট অ্যাকটিভ করলে সেটিকে একটি ইউনিক গ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করে গণনা করে বিটিআরসি। একইভাবে আইএসপি ও পিএসটিএনের প্রতিটি সংযোগকে একটি ইউনিক গ্রাহক ধরে সংস্থাটি এই সংখ্যা প্রকাশ করে থাকে।

বিটিআরসি জানাচ্ছে, ইন্টারনেট ব্যাবহারকারী মানে এমন গ্রাহক/সাবস্ক্রিপশন যারা আগের ৯০ দিনে অন্তত একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করেছেন। 

তারা আরো জানাচ্ছে, বিটিআরসি প্রায় সমস্ত আইএসপি থেকে বাজার বিশ্লেষণ, পরামর্শ এবং ডেটা সংগ্রহের মাধ্যমে আইএসপি গ্রাহকদের তথ্য গণনা করে থাকে। তবে ISP অপারেটরদের সংখ্যা বেশি এবং নির্দিষ্ট ইন্টারনেট সাবস্ক্রিপশনের খুব কম মাসিক মন্থনের কারণে ISP এবং PSTN ইন্টারনেট গ্রাহকদের তথ্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে আপডেট করা হচ্ছে।

Screenshot from BTRC website 

দেশে বর্তমান মোবাইল ব্যাবহারকারীর সংখ্যা কত?

বিটিআরসির জুনের হিসাবে দেশে বর্তমান মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮ কোটি ৪৪ লাখ ৪৫ হাজার। যেটি গত মে মাসে ছিল প্রায় ১৮ কোটি ৪২ লাখ ২৩ হাজার।

Screenshot from BTRC website 

মোবাইল ব্যাবহারকারীর সংখ্যা কিভাবে হিসাব করা হয়?

সাধারণত প্রতিটি সিমকে একটি ইউনিক গ্রাহক হিসেবে ধরে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা হিসাব করে বিটিআরসি। সে জন্য সবশেষ তিন মাসের মধ্যে প্রতিটি সক্রিয় সিমকে এক একজন নতুন গ্রাহক ধরা হয়। কোন সিমে সবশেষ ৯০ দিনে কোন কল বা ডাটা ক্রয় কিংবা এসএমএস করা হলে তা অ্যাকটিভ ব্যাবহারকারী হিসবে গণনা করে বিটিআরসি।

Screenshot from BTRC website 

মূলত, হুয়াওয়ের প্রেস রিলিজের বরাতে মোবাইল গ্রাহক ও ইন্টারনেট গ্রাহক বা ব্যবহাকারীর সংখ্যার সাথে দেশের মোট জনসংখ্যা গণনা করার বিষয়টি মেলানো উচিত নয়। মোবাইল গ্রাহক বা ইন্টারনেট গ্রাহক হিসাব পদ্ধতির কারণে দেশের মোট জনসংখ্যার থেকে মোবাইল ব্যাবহারকারীর সংখ্যা ও ইন্টারনেট গ্রাহক বা ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবসময়ই ভিন্ন হবে। একজনের একাধিক ডিভাইস এবং একাধিক সিম কার্ড থাকার কারণে এই সংখ্যা কখনই জনসংখ্যার সমান হওয়া সম্ভব নয়।  

সুতরাং, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮ কোটি নয় বরং ১২ কোটি ৬২ লাখ এবং টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১৮ কোটি শীর্ষক কোন মন্তব্য করেন নি। বরং তিনি মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ১৮ কোটি সেটি দেখিয়েছেন।

তথ্যসূত্র

  1. Mustafa Jabbar Speech – Huawei
  2. Mustafa Jabbar Statement – Newsbangla24
  3. Internet Subscription Data – BTRC
  4. Mobile Subscription Data – BTRC

আরও পড়ুন

spot_img