গত বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বা পাঠ্যক্রম চালু হওয়ার পর চলতি বছর থেকে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষায় মূল্যায়নের জন্য নতুন গ্রেডিং সিস্টেম দাবিতে একটি ছবি গত সপ্তাহ থেকে ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
ফেসবুক মনিটরিং টুল ক্রাউডট্যাংগল জানাচ্ছে, শুধু SSC Grading System কিওয়ার্ডেই বিভিন্ন ফেসবুক পেজ, গ্রুপ এবং ভেরিফাইড প্রোফাইলে এই ছবিটি তিন শতাধিক বার পোস্ট হয়েছে, যাতে লক্ষাধিক রিয়েক্ট পড়েছে৷ ফেসবুকে ইয়ার্কি নামে একটি স্যাটায়ার পেজসহ একাধিক পেজ থেকে একই ছবি শেয়ার করে রীতিমত ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে দেখা গেছে।
ফেসবুক ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, এসএসসির নতুন গ্রেডিং সিস্টেম দাবিতে প্রচারিত ছবিতে যে তথ্যগুলো উপস্থাপনা করা হয়েছে তা সঠিক নয় বরং, মাধ্যমিকে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়নের প্রস্তাবনায় নম্বরভিত্তিক মূল্যায়ন রাখা হয়নি। তার পরিবর্তে বিভিন্ন মাত্রা ও ধাপ পেরিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে জাতীয় দৈনিক আজকের পত্রিকা’র ওয়েবসাইটে গত ২৯ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা ও পারদর্শিতার পাশাপাশি আচরণগত দিক মূল্যায়নের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক মূল্যায়নের মতো এ মূল্যায়নেও সাতটি স্তর বা সূচক থাকবে। রিপোর্ট কার্ডে ‘আচরণিক ক্ষেত্র’ নামে আলাদা একটি ছক থাকবে। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে এই মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকেরা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তৈরি করা ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ এর মূল্যায়ন কৌশল ও বাস্তবায়ন নির্দেশনা’ সংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, সাতটি স্কেল হলো অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক। সর্বোচ্চ স্কেল ‘অনন্য’ বলতে বোঝানো হবে, শিক্ষার্থী সব বিষয়ে পারদর্শিতার চূড়ান্ত স্তর অর্জন করেছে। আর ‘প্রারম্ভিক’ স্তর হলো সবচেয়ে নিচের স্তর।
এনসিটিবি সূত্রের বরাত দিয়ে আজকের পত্রিকা জানায়, প্রতিবেদনটি গত ২৮ মে কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিভিশন কোর কমিটিতে পাস হয়েছে। এখন তা এনসিটিবির বোর্ড সভা হয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভায় চূড়ান্ত হবে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে এনসিটিবির ওয়েবসাইট বা বিশ্বস্ত সূত্রগুলোর সহায়তা নিয়েও ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ এর মূল্যায়ন কৌশল ও বাস্তবায়ন নির্দেশনা’ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি পাওয়া যায়নি। চূড়ান্ত না হওয়ায় এটি এখনও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে ইতোমধ্যে প্রাথমিক স্তরের (১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণি) মূল্যায়ন নির্দেশিকা এনসিটিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে।
ওয়েবসাইটে তিন শ্রেণির প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা ফাইলে মূল্যায়ন নির্দেশিকা দিয়েছে এনসিটিবি। তবে প্রতিটি বিষয়েরই নির্দেশিকা প্রায় একই। রিউমর স্ক্যানার ৩য় শ্রেণির গণিত বিষয়ের নির্দেশিকাটি ধরে আলোচিত দাবিটি যাচাই করে দেখেছে।
শিক্ষার্থীদের শিখন মূল্যায়নে নাম্বার পদ্ধতির পরিবর্তে এক বা একাধিক পারদর্শিতার নির্দেশক (PI) নির্ধারণ করা হয়েছে৷ এই পদ্ধতিতে তিনটি মাত্রা ঠিক করা হয়েছে। ভাল, খুব ভাল, অতি উত্তম। একেকটি বিষয়ে একাধিক পারদর্শিতার নির্দেশক রয়েছে। ৩য় শ্রেণির গণিত বইয়ের ক্ষেত্রে যেমন সংখ্যাটা ৩৩, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তা ২২।
এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শেষে অনেকগুলো পারদর্শিতার নির্দেশককে যুক্ত করে কয়েকটি পারদর্শিতার ক্ষেত্র গঠিত হবে। প্রতিটি পারদর্শিতার ক্ষেত্র এর বিপরীতে শিক্ষার্থীর অবস্থান নির্ধারণ করা হবে। এই অবস্থান সাত ধাপের মূল্যায়ন স্কেল দিয়ে প্রকাশ করা হবে। এগুলোই হচ্ছে আলোচিত দাবিতে থাকা সাতটি নাম, অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান এবং প্রারম্ভিক।
পারদর্শিতার ধাপ নির্ণয়ের একটি সূত্রও দেওয়া হয়েছে নির্দেশিকায়। এই সূত্র ব্যবহার করে যে মান বের হবে তা শতকরা হিসেবে সর্বোচ্চ ১০০ শতাংশ থেকে সর্বনিম্ন -১০০ শতাংশ হবে।
পারদর্শিতার ধাপভেদে শর্তগুলো জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে সর্বোচ্চ ১০০ শতাংশ পাওয়া শিক্ষার্থী ‘অনন্য’ বলে বিবেচিত হবে৷ নির্দেশিকায় একটি রিপোর্ট কার্ডের নমুনাও যুক্ত করা হয়েছে, যাতে আলোচিত দাবিতে থাকা নম্বরভিত্তিক মূল্যায়নের কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং উপরোল্লিখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই রিপোর্ট কার্ড প্রস্তুতের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়েও এই পদ্ধতিই অনুসরণ করার প্রস্তাব এসেছে।
রিউমর স্ক্যানার এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকারের সাথে কথা বলেছে। তিনি আলোচিত ছবিটিকে ভুয়া বলে নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে আরো জানতে জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসানের সাথেও কথা বলেছে রিউমর স্ক্যানার। জনাব তারিক বলছেন, “এটা (ছবিটি) সঠিক না, প্রোপাগান্ডা। আগের গ্রেডিং এর সাথে বর্তমান স্কেলিং এর কোনোই সম্পর্ক নাই।”
তারিক আহসান রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, নাম্বারের রেঞ্জগুলোর সাথে নতুন দেওয়া নামগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।
মূলত, নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষার মূল্যায়নের জন্য নতুন গ্রেডিং সিস্টেম দাবিতে একটি ছবি গত সপ্তাহ থেকে ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, এসএসসির নতুন গ্রেডিং সিস্টেম দাবিতে প্রচারিত ছবিতে থাকা তথ্যগুলো সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিখন মূল্যায়নের জন্য যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তাতে নম্বরভিত্তিক মূল্যায়ন রাখা হয়নি। এর পরিবর্তে বিভিন্ন মাত্রা ও ধাপ পেরিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সুতরাং, নতুন কারিকুলামের জন্য এসএসসির গ্রেডিং সিস্টেম দাবিতে পুরোনো নাম্বার পদ্ধতির সাথে নতুন মূল্যায়ন স্তরকে জড়িয়ে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Ajker Patrika: নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের আচরণও মূল্যায়ন করা হবে
- Statement from Tapan Kumar Sarkar
- NCTB: Class Three Math
- Statement from Dr. Mohammad Tariq Ahsan
- Rumor Scanner’s own analysis