শুক্রবার, মে 23, 2025

হাতকড়া পরা শিশুর ভাইরাল ছবিটি বাস্তব কোনো ঘটনার নয়, প্রতীকী অভিনয়

সম্প্রতি এক শিশুর হাতকড়া পরা একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হচ্ছে—আওয়ামী লীগ কর্মী পিতাকে না পেয়ে পুলিশ ওই শিশুকে হাতকড়া পরিয়ে গ্রেফতার করেছে। এসব পোস্টে শিশুটির নাম, পরিচয় বা অবস্থান কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।

তবে, এই দাবির প্রমাণ হিসেবে বিভিন্ন পোস্ট ও মন্তব্যে একটি ভিডিওর লিংক শেয়ার করা হচ্ছে। আবার, যারা ছবিটিকে সন্দেহ করে একে খেলনার হাতকড়া বা গুজব বলছেন, তাদের জবাবে প্রচারকারীরা ওই ভিডিওকেই ছবির ঘটনার প্রমাণ হিসেবে দেখাচ্ছেন।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন দাবির কিছু পোস্ট এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। এক্স (সাবেক টুইটার)-এ প্রচারিত কিছু পোস্ট এখানে, এখানে এবং এখানে। ইউটিউব এবং টিকটকের একই দাবির একটি করে পোস্ট এখানে এবং এখানে। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাতকড়া পরিহিত শিশুর ভাইরাল এই ছবিটি বাস্তব কোনো ঘটনার নয় বরং অভিনয়ের চিত্র। এছাড়াও, ছবিটির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে যেই ভিডিওটি শেয়ার করা হচ্ছে, সেটি ভিন্ন এক শিশুর। ফলে, ভিডিওটি ভাইরাল ছবির প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

হাতকড়া পরিহিত শিশুর ভাইরাল ছবির পক্ষে ভিন্ন শিশুর ভিডিও প্রচার

বিভিন্ন পোস্ট এবং মন্তব্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, হাতকড়া পরা ভাইরাল ছবিটির প্রমাণ হিসেবে একটি ভিডিও এবং সেই ভিডিও থেকে নেওয়া একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করা হচ্ছে। ভিডিওতে দেখা যায়, এক শিশু তার মায়ের সঙ্গে একটি প্রিজন ভ্যানে অবস্থান করছে। ভিডিওটি ‘আওয়ামী লীগ নেতাকে না পেয়ে স্ত্রী এবং তিন বছরের শিশুকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ’ দাবিতে প্রচার করা হলেও দেখা গেছে ওই আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক ইতিমধ্যেই হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন এবং তার জামিন পাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভিডিওতে দেখা যাওয়া নারীর নাম ফারজানা রহমান নীলা। তিনি ছাত্র হত্যার একটি মামলায় গ্রেফতার হওয়া সাবেক কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিকের স্ত্রী। ফেসবুকে পাওয়া কিছু পুরোনো পোস্টভিডিওতে, কয়েকদিন আগে তাকে আদালতে হাজির করার সময় শিশুটিকে কোলে নিয়ে প্রবেশ করতে দেখা গেছে।

এই ভিডিওতে দেখা যাওয়া শিশুটিকে আটক করা হয়েছে এমন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও শিশুটিকেও গ্রেফতার করা হয়েছে এমন দাবি করা হয়েছে। তবে প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিশুটিকে গ্রেফতার করা হয়নি; বরং গ্রেফতারকৃত মা তাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন।

এদিকে ফেসবুকে একটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে, ফারজানা রহমান নীলা রাজনৈতিক বা হত্যা মামলায় নয়, বরং ব্যাংক ঋণসংক্রান্ত একটি পুরোনো মামলায় আটক হয়েছেন। তবে এই দাবির সত্যতা রিউমর স্ক্যানার যাচাই করেনি।

তবে, এটা নিশ্চিত যে, ভিডিওতে দেখা যাওয়া শিশু ও ভাইরাল ছবির শিশুটি ভিন্ন। তাদের চেহারা ও পোশাকের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে।

হাতকড়া পরিহিত শিশুর ভাইরাল ছবি নিয়ে অনুসন্ধান

ভাইরাল ছবিটির সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও, পরবর্তীতে একটি ফেসবুক মন্তব্য এই দাবিটি যাচাইয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লু হয়ে ওঠে। এক ব্যক্তি চকরিয়া থানার সাবেক ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা পারভেজের ফেসবুক আইডি ‘S R Parvez’-কে মেনশন করে একটি পোস্টের কমেন্টে লেখেন— “তোর ভাগ্নের যেমন খুশি তেমন সাজের ছবিটা ভাইরাল হয়ে গেল। এইটা কেবল তুই প্রতীকী ছবি হিসেবে ইউজ করেছিলি। কিন্তু এখন অনেকে শেয়ার করতেছে।”

এই মন্তব্যের জবাবে সোহেল রানা পারভেজ ভিডিওর শিশুটির ভিন্ন একটি স্ক্রিনশট যুক্ত করে লিখেন: “এইটা আমার ভাগিনা কেমনে সম্ভব? আমার বাড়ি কি নোয়াখালী?”

এখানে তিনি ভাইরাল ছবির শিশুর প্রসঙ্গ এড়িয়ে ভিডিওর শিশুর প্রসঙ্গ টেনে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে ধারণা করা যায় এবং এটি তার ভাগিনা নয় বলে অস্বীকার করেন।

পরে ওই মন্তব্যকারী রিপ্লাইয়ে ভাইরাল ছবিটি যুক্ত করে লেখেন— “এই ছবিটার কথা বললাম।” তবে ওই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এরপর আর কোনো উত্তর দেননি। আমাদের পক্ষ থেকেও মেসেঞ্জারে তাকে কয়েকবার মেসেজ করা হলেও তিনি আমাদের জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর দেননি।

পরবর্তীতে মেসেঞ্জারে ওই মন্তব্যকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান– “সে (সোহেল রানা পারভেজ) আমাদের এলাকার। দু-একদিন আগে ছবিটা পোস্ট করেছিল। আমরা সবাই বলার পর পরে সে পোস্টটা ডিলিট করে।”

তিনি ব্যক্তিগত বার্তায়ও জানান/দাবি করেন, ছবির শিশুটি ওই সাবেক ছাত্রলীগ নেতার ভাগ্নে এবং তার পরিহিত হাতকড়াটি খেলনার ছিল।

পরে এই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে মিজানুর রহমান টুটুল নামের এক ব্যক্তির একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত পোস্টে সাবেক ওই ছাত্রলীগ নেতার সরিয়ে ফেলা পোস্টের একটি স্ক্রিনশট পাওয়া যায়। গুজবটি খণ্ডন করতে ওই ব্যক্তি সোহেল রানা পারভেজের ফেসবুক আইডিকে মেনশন করে তার পোস্টের স্ক্রিনশট যুক্ত করে লেখেন—

 “ছবি নিয়ে আসল ঘটনা:- বাচ্চাটি এলাকার ভাই S R Parvez এর ভাগিনা। গত ১০/০৪/২৫ তারিখ বিকাল আনুমানিক ০৪.২২ মিনিটে পারভেজ তার আইডিতে ছবিটি পোস্ট করে। ক্যাপশনসহ পারভেজের পোস্টটি ২নং ছবিতে দেওয়া হল। এটা দেখে আমি ৪.৩০ মিনিটে পারভেজকে কমেন্টে জানাই যে, ঘটনা কি? কি হল?? কোন সহযোগিতা লাগবে কিনা??? সে কমেন্টের রিপ্লাইতে বলে, তার ভাগীনা বাসায় যেমনখুশি-তেমনসাজো করতেছে। এরকম সাজল আর সেই ছবি সে দুষ্টুমি করে ক্যামরা বন্দী করে। এরপর সে বলে, ছবি তুলে দুষ্টুমি করে ফেইসবুকে দিলাম ভাই। এটা ছাড়া আর কিছুই না। আমি তখন তাকে কমেন্টে রিকুয়েষ্ট করি, ছবিটি ডিলেট করতে। কারণ হিসেবে বলি, এই ছবির মাধ্যমে রিউমার ছড়াতে পারে, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে এবং বাচ্চাটিও সারাজীবন ট্রমায় পরতে পারে। পরে পারভেজ ছবিটি সাথে সাথে ডিলেট করে দেয়।

এখন দেখছি ছবিটি নিয়ে কোন সত্য না জেনে,, যা-তা নিউজ হচ্ছে, অনেকে পুলিশকে দুষছে, অনেকে সরকারকে দুষছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন বিভিন্ন ভাবে রিউমার ছড়াচ্ছে এবং অনলাইন নিউজেও রিয়োমার ছড়ানো হচ্ছে। আসলে এটি একটি দুষ্টুমির ছবি ও #মিথ্যা ঘটনা। প্রয়োজনে পারভেজের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। ধন্যবাদ।”

পরবর্তীতে আমরা ওই ব্যক্তির সঙ্গে ভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে পোস্টটির স্ক্রিনশট সংগ্রহ করি। গুগলে ছবিটি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা S R Parvez-এর আইডি থেকে পোস্ট হওয়ার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টও পাওয়া যায়। সরিয়ে ফেলা পোস্টটির ক্যাপশনে S R Parvez ছবিটি যুক্ত করে লিখেছিলেন— “শেষ পর্যন্ত আমার ভাগিনা ডেভিল হান্টে গ্রেফতার, আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বি:দ্র: এইটা বাস্তবিক নয়, আসামীর আদলে অভিনয় করেছে ভাগিনা।”

উল্লেখ্য, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল রানা পারভেজ চলতি বছর ‘ডেভিল হান্ট’ অভিযানের সময় গ্রেফতার হয়ে মার্চে জামিনে মুক্তি পান বলে জানা যায়।

Deleted post screenshot and its digital footprint

সোহেল রানা পারভেজের ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট অনুসন্ধানে তার ভাগ্নেদের সাথে পোস্টকৃত একটি ছবির শিশুর সাথে ভাইরাল ওই ছবির সাদৃশ্যতা পরিলক্ষিত হয়। 

Face Comparison 

এছাড়াও, ভাইরাল ছবির হাতকড়াটি দেখতে প্লাস্টিকের বেবি টয় হ্যান্ডকাফের মতো, এবং প্লাস্টিকের খেলনা হাতকড়ার সাথে ভাইরাল ছবির হাতকড়ার মিল প্রতীয়মান হয়।

Image Collage: Facebook 

সংক্ষেপে, ছবিটি নিয়ে অনুসন্ধানে যা জানা যায়—সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা, যিনি ডেভিল হান্ট অভিযানে গ্রেফতার হয়ে পরবর্তীতে জামিন পেয়েছিলেন, তিনি তার ভাগ্নের খেলনা হাতকড়া পরিহিত একটি ছবি প্রতীকীভাবে ব্যবহার করে “শেষ পর্যন্ত আমার ভাগিনা ডেভিল হান্টে গ্রেফতার” শিরোনামে একটি পোস্ট দেন, যা পরে সরিয়ে ফেলেন। পরবর্তীতে ছবিটি বিকৃত ব্যাখ্যায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও পরে ছবিটি নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়, তিনি এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি এবং বিষয়টি অস্বীকার করার চেষ্টা করেন।

সুতরাং, হাতকড়া পরা শিশুর ভাইরাল ছবিটি কোনো বাস্তব ঘটনার নয়, এটি নিছক অভিনয়। ফলে ছবিটিকে বাস্তব হিসেবে উপস্থাপন করে প্রচারের বিষয়টি বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

  • Rumor Scanner’s investigation 
  • Facebook post of Mizanur Rahman Tutul

আরও পড়ুন

spot_img