সম্প্রতি ‘এটি হলো #আমেরিকার_সংস্থা_হার্প এর জাহাজ। এই ডিমের আকার জাহাজটি সুমদ্রে যে প্রান্তে যায় সেখানে ভূমিকম্প হয়। তুর্কির তীরে এটি আসে তারপরে হয় তুর্কি, সিরিয়ায় ভূমিকম্প।যদিও এখন পর্যন্ত তুর্কির তরফ থেকে কিছু বলা হয়নি।আমেরিকা হার্প প্রযুক্তির সাহায্যে ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে, আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটাতে পারে।’ শীর্ষক শিরোনামে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, হার্প কোনো সংস্থা নয় বরং এটি আমেরিকার একটি বৈজ্ঞানিক প্রকল্প এবং এই প্রকল্পের কোনো জাহাজ নেই। তুরস্কে সম্প্রতি সংঘটিত ভূমিকম্পের সঙ্গে আমেরিকার হার্প প্রকল্পের কোনো সম্পৃক্ততা নেই এবং হার্পের ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো সক্ষমতাও নেই৷ এছাড়া যে ছবিটিকে হার্পের জাহাজ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে সেটি আমেরিকান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বোয়িং কর্তৃক নির্মিত মাঝারি পাল্লার একটি রাডার সিস্টেমের ছবি।
ছবিটি কি কথিত হার্পের জাহাজ?
রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শিপ ট্র্যাকিং ও মেরিটাইম ইন্টেলিজেন্স ভিত্তিক ওয়েবসাইট Marine Traffic এ ‘SBX 1‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ফটো গ্যালারিতে কিছু ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। এই ছবিগুলোর সাথে হার্পের জাহাজ দাবিতে প্রচারিত ছবিটির মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে এই ছবিগুলোর সূত্রে Naval Technology নামের একটি ওয়েবসাইটে ‘Sea-Based X-Band Radar-1 (SBX-1)‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, SBX-1 হলো সমুদ্র-ভিত্তিক এক্স-ব্যান্ড রাডার-1। একটি সমুদ্রগামী অর্ধ নিমজ্জিত জাহাজের উপর মাঝারি পাল্লার এই রাডার প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করেছে বোয়িং।
এই রাডারটি কমান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশন সিস্টেম এবং একটি ইন-ফ্লাইট ইন্টারসেপ্টর কমিউনিকেশন সিস্টেম ডেটা টার্মিনাল নিয়ে গঠিত।
অর্থাৎ যে জাহাজটিকে ফেসবুকে হার্পের জাহাজ দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে সেটি মূলত আমেরিকান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বোয়িং কর্তৃক নির্মিত মাঝারি পাল্লার একটি রাডার সিস্টেম।
এছাড়া তুরস্ক ভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Teyit এ ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল ‘Did HAARP ship drop anchor in Çanakkale?‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এটি একটি সমুদ্র-ভিত্তিক রাডার সতর্কতা ব্যবস্থা যা SBX-1 নামে পরিচিত। ২০০৩ সালে আমেরিকা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবহারের জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। ২০০৫ সালে SBX-1 কে মেরিন ভিত্তিক X-Band রাডার-1 নামে নামকরণ করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, এই রাডার সিস্টেমের রাডারটি সাদা বলের ভিতরে অবস্থিত, যেটি মূল প্লাটফর্মের উপর দৃশ্যমান। এই বলটির মূল উদ্দেশ্য হলো রাডার সিস্টেমকে বায়ু এবং বৃষ্টিপাতের মতো প্রাকৃতিক প্রভাব থেকে রক্ষা করা। এটির সঙ্গে হার্প সিস্টেমের কোনো সম্পর্ক নেই।
HAARP কি?
কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা, ফেয়ারব্যাংকসের ওয়েবসাইটে HAARP সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
ওয়েবসাইটটি থেকে জানা যায়, HAARP এর পূর্ণরূপ হলো High-frequency Active Auroral Research Program। HAARP হলো একটি বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা, যার লক্ষ্য আয়নোস্ফিয়ারের বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ অধ্যয়ন করা।
ওয়েবসাইটটিতে নাসাকে উদ্ধৃত করে আয়োনস্ফিয়ার সম্পর্কে বলা হয়, আয়নোস্ফিয়ার হচ্ছে পৃথিবীর পৃষ্ঠের উপরে প্রায় ৫০ থেকে ৪০০ মাইল প্রসারিত একটি নিরপেক্ষ পর্দা।
পাশাপাশি ওয়েবসাইটটির প্রশ্নোত্তর বিভাগ থেকে জানা যায়, হার্প প্রকল্পটি ১৯৯০ সালে পৃথিবীর উপরের বায়ুমণ্ডল এবং রেডিও তরঙ্গ সম্পর্কে গবেষণার উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছিল।
চালু করার পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এটি আমেরিকান বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর যৌথ অংশগ্রহণে পরিচালিত হতো। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে এই প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
এছাড়া ওয়েবসাইটটি থেকে হার্প প্রকল্পের একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়।
উল্লিখিত ছবির সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত ছবিটির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অপরদিকে ফেসবুকে প্রচারিত তথ্যটিতে হার্পকে আমেরিকার একটি সংস্থা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হার্প হচ্ছে আমেরিকান বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর যৌথ অংশগ্রহণে পরিচালিত একটি বৈজ্ঞানিক প্রকল্প।
হার্প প্রকল্পের কি কোনো জাহাজ আছে?
রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে হার্প সিস্টেমটি জাহাজে বহন করে নিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত বা এই ধরনের কোনো জাহাজ সংক্রান্ত কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া তুরস্কের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Teyit এর ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
তুরস্কের ভূমিকম্পের সাথে হার্প প্রকল্পের কোনো সম্পর্ক আছে?
অনুসন্ধানে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ‘Fact Check-Earthquake in Turkey was not a HARRP Operation‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটিতে ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা, ফেয়ারব্যাংকসের ওয়েবসাইট সূত্রে জানায়, হার্প প্রকল্পের মাধ্যমে আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না।
পাশাপাশি প্রতিবেদনটিতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড হাইসেলকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, হার্প হল একটি রেডিও ট্রান্সমিটার যা অন্যান্য রেডিও ট্রান্সমিটারের চেয়ে বড় এবং তাত্ত্বিকভাবে হার্পের পক্ষে ভূমিকম্প তৈরি করা সম্ভব নয় ৷
কলোরাডো বোল্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি ফর অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যান্ড স্পেস ফিজিক্স (এলএএসপি)-এর বিজ্ঞানী ডেভিড মালাস্পিনাকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানায়, হার্প যে ধরনের রেডিও তরঙ্গ তৈরি করে তা ভূমিতে ১ সেন্টিমিটারেরও কম প্রবেশ করে৷ অপরদিকে ভূমিকম্পের গভীরতা অনেক বেশি হয়। যেমন তুরস্কের ২০২৩ সালের ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে ভূমি থেকে ১৭ কিলোমিটার নিচে।
পাশাপাশি অনুসন্ধানে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে ভূমিকম্প সৃষ্টির পক্ষে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে এবারই প্রথম নয়, ইতোপূর্বেও তুরস্কের ভূমিকম্পের সঙ্গে হার্পের সম্পর্ক আছে দাবিতে বিভিন্ন সময়ে ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব (Conspiracy Theory) ছড়ানো হয়েছে। যেমন, ১৯৯৯ সালে দেশটির গোলাক (Gölcük) অঞ্চলে সংঘটিত ভূমিকম্পের জন্য হার্পকে দায়ী করা হয়।
ভূমিকম্প কেন হয়?
একসময় পুরো পৃথিবীর সব স্থলভাগ একসাথে ছিল। তবে পৃথিবীর উপরিভাগ কতগুলো অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত হওয়ায় এসকল স্থলভাগ ধীরে ধীরে তারা আলাদা হয়ে গেছে। যে প্লেটগুলোকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়।
সাধারণত এই প্লেটগুলো একে–অপরের সঙ্গে পাশাপাশি লেগে থাকে। কোনো কারণে এদের মধ্যে সংঘর্ষ হলেই তৈরি হয় শক্তি। যা সিসমিক তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। যদি তরঙ্গ শক্তিশালী হয়, তাহলে সেটি পৃথিবীর উপরিতলে এসে পৌঁছায়। আর তখনো যদি যথেষ্ট শক্তি থাকে, তাহলে সেটা ভূত্বককে কাঁপিয়ে তোলে। এই কাঁপুনিই মূলত ভূমিকম্প।
তুরস্কে ঘন ঘন ভূমিকম্প হওয়ার পেছনে দেশটির টেকটোনিক প্লেটে অবস্থানকে দায়ী করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, তুরস্ক চারটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। প্লেটগুলো হলো আনাতোলিয়ান প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট, অ্যারাবিয়ান প্লেট এবং আফ্রিকান প্লেট। এর মধ্যে অ্যারাবিয়ান প্লেটের বছরের পর বছর ধরে ইউরেশিয়ান প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটছে। যার ফলে এই এলাকায় অনেক ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছে।
মূলত, High-frequency Active Auroral Research Program বা HAARP হলো একটি বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা, যার লক্ষ্য আয়নোস্ফিয়ারের বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ অধ্যয়ন করা। ১৯৯০ সালে পৃথিবীর উপরের বায়ুমণ্ডল এবং রেডিও তরঙ্গ সম্পর্কে গবেষণার উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছিল। চালু করার পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এটি আমেরিকান বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর যৌথ অংশগ্রহণে পরিচালিত হতো। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে এই প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছিল। তাত্ত্বিকভাবে হার্পের পক্ষে ভূমিকম্প তৈরি করা সম্ভব না হলেও গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে সংঘটিত ভূমিকম্পের জন্য হার্পকে দায়ী করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে যে, হার্পের জাহাজ সুমদ্রের যে প্রান্তে যায় সেখানে ভূমিকম্প হয়। সম্প্রতি এই জাহাজটি তুরস্কের তীরে আসায় তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্প হয়৷ তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে হার্পকে দায়ী করা সংক্রান্ত দাবির সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বোয়িং কর্তৃক নির্মিত মাঝারি পাল্লার একটি রাডার সিস্টেমের ছবিকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক প্রকল্প হার্পের জাহাজ হিসেবে উল্লেখ করে কথিত জাহাজটি তুরস্কের তীরে আসায় তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্প হয়েছে দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Marine Traffic: SBX 1
- Naval Technology: Sea-Based X-Band Radar-1 (SBX-1)
- Teyit: Did HAARP ship drop anchor in Çanakkale?
- HAARP : https://haarp.gi.alaska.edu/
- HAARP: https://haarp.gi.alaska.edu/faq
- Reuters: Fact Check-Earthquake in Turkey was not a HAARP Operation
- Daily Prothom Alo: ভূমিকম্প কেন হয়, এ সময়ে করণীয় কী
- Rappler: FACT CHECK: Earthquakes are not caused by radio waves