হুনজা উপত্যকার মানুষের গড় আয়ু, রোগমুক্ত থাকা এবং নারীদের ৬৫ থেকে ৯০ বছর পর্যন্ত গর্ভধারণ সম্পর্কে গণমাধ্যমে ভুল তথ্য 

পাকিস্তানের গিলগিত-বালতিস্তান এলাকার একটি পাহাড়ি উপত্যকা হলো হুনজা। এই উপত্যকায় বসবাসকারী মানুষরা সাধারণত হুনজা উপজাতি নামেই পরিচিত। উল্লেখ্য, হুনজা এবং আরো কিছু উপত্যকায় বসবাসকারী এদেরকে কেউ কেউ ব্রুশো বলেও অভিহিত করেন। হুনজা উপত্যকার অধিবাসীদের সম্পর্কে বছরের পর বছর ধরে কিছু দাবি নানা গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হতে লক্ষ্য করে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

হুনজা উপত্যকার বসবাসকারীদের সম্পর্কে প্রচলিত তিনটি দাবি হলো:

১. এখানকার বাসিন্দাদের গড় আয়ু ১০০ বছরের অধিক (১০০-১২০ বছর)৷ কেউ কেউ ১৬৫ বছর পর্যন্তও বাঁচে।

২. এখানকার বাসিন্দাদের কখনও টিউমার বা ক্যান্সার হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এপ্রিকট নামের একটি ফল খাওয়ার কারণে ক্যান্সারমুক্ত থাকে তারা।

৩৷ এখানকার স্থানীয় নারীদের ৬৫-৯০ বছর পর্যন্ত যুবতী মনে হয়৷ এই বয়সেও অনায়াসেই গর্ভধারণ করতে পারে এখানকার নারীরা। 

এছাড়াও, দাবি করা হয়, দূষণমুক্ত পরিবেশ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির কারণেই হুনজা উপজাতিরা এতো বছর বেঁচে থাকেন অনায়াসেই।

Screenshot collage: Rumor Scanner 

এরকম এক বা একাধিক দাবি নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের প্রচারিত সংবাদ বা প্রতিবেদন দেখুন : জাগোনিউজ২৪ (২০২৪), দৈনিক নয়া দিগন্ত, ডেইলি বাংলাদেশ, বাংলা ভিশন, যমুনা টিভি (ইউটিউব), আরটিভি (ইউটিউব), আরটিভি, সমকাল (ইউটিউব), রোর বাংলা, ডিবিসি নিউজ, জাগোনিউজ২৪ (২০২২), দুর্মর বাংলা, ডিএমপি নিউজ, চাঁদপুর টাইমস, দুরবিন নিউজ, দৈনিক জামালপুর, হবিগঞ্জ২৪, জুম বাংলা, ডেইলি সোনারগাঁ

উক্ত এক বা একাধিক দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন : Bengal Studio, NH Tv Bangla, Jago Facts, অবাক বিশ্ব, Friends For Friend (VRUR), Ojana Biggan, ধরণী, Bd Documentary, ATN Bangla News, Bijoy TV, G News BD.

গণমাধ্যম ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরে এরকম এক বা একাধিক দাবি নিয়ে প্রচুর পোস্ট প্রচার করা হয়েছে। 

Screenshot collage: Rumor Scanner 

উক্ত দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, হুনজা উপত্যকার অধিবাসী মানুষদের গড় আয়ু ১১০-১২০ বছর নয়, তাদের কখনও ক্যান্সার বা টিউমার হয়নি দাবিটিও সত্য নয়৷ তাছাড়া, ৬৫ থেকে ৯০ বছর পর্যন্ত হুনজা উপত্যকার নারীরা গর্ভধারণ করতে পারে শীর্ষক দাবির পক্ষেও কোনো বিশ্বস্ত তথ্যপ্রমাণ নেই।

হুনজা উপত্যকার অধিবাসীদের গড় আয়ু কি ১০০ বছর বা তার অধিক?

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধান করে নেদারল্যান্ডসের রেডবাউন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাইমেগেন স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টের রিসার্চ ওয়েবসাইট গ্লোবাল ডাটা ল্যাবে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ১৯৯৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গড় আয়ুর হিসাব পাওয়া যায়। এই তথ্য মতে, ২০২১ সালে পাকিস্তানের গিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চলের (হুনজা উপত্যকার অবস্থান) মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৪.২৮ বছর। 

Photo : Global Data Lab

এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের অধ্যাপক আলী এইচ মোকদাদের ২০১৯ সালের আরেকটি গবেষণায় উল্লেখকৃত চার্ট থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে পাকিস্তানের গিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চলের মানুষের গড় আয়ু ৬৪.৬ বছর যা ১৯৯০ সালে ৫৮.২ বছর ছিল। 

২০১০ সালের আরেকটি গবেষণায় পাকিস্তানের হুনজা উপত্যকা ছাড়াও সোভিয়েতের ককেশাস অঞ্চল ও ইকুয়েডরের ভিলকাবাম্বা উপত্যকার মানুষের আয়ুষ্কাল সম্পর্কিত দাবিগুলো মূলত মিথ বা প্রচলিত ধারণা, এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এছাড়াও, জার্নাল অব দ্যা আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে ১৯৬২ সালে হুনজাদের নিয়ে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র বলা হয়, হুনজাদের আয়ুষ্কাল হিসেবে দাবিকৃত বয়সের পক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র নেই। তবে, ব্যতিক্রম হিসেবে কেউ কেউ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারেন।

এছাড়াও, জন টিয়ার্নি নামের একজন আমেরিকান সাংবাদিক যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, হুনজা উপজাতিদের কোনো জন্মনিবন্ধন নেই এবং তাদের মধ্যে নিজেদের বয়স বাড়িয়ে বলার একটি প্রবণতা দেখা যায়। হুনজা উপত্যকায় তার ভ্রমণ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তার লেখা উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তিনি যখন হুনজা এলাকায় গিয়েছিলেন তখন তাদের বয়স্ক অশিক্ষিত মানুষদেরকে আনুমানিকভাবে বয়স প্রায় ১-২ দশক বাড়িয়ে বলার বিষয় লক্ষ্য করেন তিনি। তিনি হুনজাদের স্মৃতিকথার সাথে চেনাজানা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর তুলনা করে এসব বিষয় বুঝতে পারেন। 

তাছাড়া, তাদের জীবনযাত্রাও চরম দূষিত হিসেবে লক্ষ্য করার বিষয় উল্লেখ করেন তার প্রতিবেদনে। তিনি বলেন, হুনজাদেরকে তিনি ব্রঙ্কাইটিসে ভুগতে দেখেছেন৷ তাছাড়া টিউবারকিউলোসিস, আমাশয়, ম্যালেরিয়া, টিটেনাস এবং ক্যান্সারের মতো রোগবহন করতেও লক্ষ্য করেছেন তিনি। তাদের খাদ্যে আয়োডিনের অভাবের ফলে তাঁদের মধ্যে মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। অধিবাসীদের মধ্যে শিশুমৃত্যুও ঘটে থাকে বলেও জানতে পারেন এই আমেরিকান সাংবাদিক। বিবি খুমারি নামের একজন হুনজা অধিবাসীর সাক্ষাৎকার নিলে তিনি জানতে পারেন, সেই নারীর (বিবি খুমারী) ১৬টি শিশুর মধ্যে প্রথম ১৩টিই মৃত্যুবরণ করেছে। তাছাড়া, জন টিয়ার্নির উক্ত প্রতিবেদন থেকে ১৯৮৬ সালের একটি মেডিক্যাল গবেষণার বরাতে জানা যায়, এরকম বিচ্ছিন্ন ঐতিহ্যবাহী গ্রামগুলোতে পুরুষদের গড় আয়ুষ্কাল মাত্র ৫৩ বছর এবং নারীদের ক্ষেত্রে মাত্র ৫২ বছর।

তাছাড়া, পাকিস্তানের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান SOCH FACT CHECK হুনজাদের সম্পর্কে এসব প্রচলিত দাবি সম্পর্কে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ প্রতিবেদনটিতে তারা জানায়, হুনজাদের গড় বয়স অন্তত ৯০ হওয়ার পক্ষেও প্রমাণ পাওয়া যায়না৷ একই প্রতিবেদনে জাপানি রিসার্চার কিনজি ইমানিশি এর লেখা “Personality and Health in Hunza Valley” নামের একটি বইয়ের বরাতে তারা জানায়, কিনজি ইমানিশি এসব বাসিন্দাদেরকে অপুষ্টি এবং খারাপ স্বাস্থ্যে ভুগতে লক্ষ্য করেছেন।

২০১২ সালে স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ অনুসারে, হুনজা জনগোষ্ঠীর দীর্ঘায়ুর দাবি সত্যের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অপ্রামাণিক বা সন্দেহজনক। এই দাবিকে গুরুত্ব সহকারে দাবিকারীদের অনেকেই উক্ত উপত্যকায় কখনোই যাননি। একজন জাপানি ডাক্তার উপত্যকাটি ভ্রমণ করলে তিনি সেখানকার অধিবাসীদের অপুষ্টি এবং অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ভুগতে দেখেন। তাছাড়া, সেখানে ভয়ঙ্কর মাত্রার শিশুমৃত্যুর হারও লক্ষ্য করেন তিনি।

এছাড়া, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন ফ্রান্সের অধিবাসী জিন লুইস ক্যালমেন্ট। ১৯৯৭ সালের ৪ আগস্ট মারা যাওয়ার আগে তিনি ১২২ বছর ১৬৪ দিন বেঁচে ছিলেন। তবে, তার বয়স নিয়েও নানা বিতর্ক রয়েছে।

মূলত, পাকিস্তানের গিলগিত-বালতিস্তানের হুনজা উপত্যকার মানুষদের গড় আয়ু সাধারণত ১০০-১২০ বছর ও কেউ কেউ ১৬৫ বছর পর্যন্ত বাঁচেন দাবিতে দেশের প্রথম সারির কয়েকটি গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য ও প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, হুনজা উপত্যকার মানুষদের আয়ুষ্কাল ও গড় আয়ু সম্পর্কে প্রচারিত তথ্যগুলো ভিত্তিহীন এবং এর কোনো তথ্য প্রমাণ বা ব্যাখ্যা নেই। ২০২১ সালে গিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চলের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৪ বছর। 

সুতরাং, হুনজা উপত্যকার মানুষের গড় আয়ু ১১০-১২০ বছর দাবিতে প্রচারিত তথ্যগুলো ভিত্তিহীন।

হুনজা উপত্যকার অধিবাসীরা কি কখনও টিউমার, ক্যান্সার বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হয়না?

হুনজাদের সম্পর্কে প্রচলিত আরেকটি দাবি হচ্ছে তাদের কারোর টিউমার বা ক্যান্সার হয়েছে বলে শোনা যায়নি। টিউমার বা ক্যান্সার থেকে সুস্থ থাকার কারণ হিসেবে দাবি করা হয়, হুনজা অধিবাসীরা এপ্রিকট নামে একটি ফল খেয়ে থাকে যা ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে বা ক্যান্সার থেকে হুনজা অধিবাসীদের মুক্ত এবং সুস্থ রাখে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে অস্ট্রেলিয়ার ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান এএপি এর একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়৷ ১৯৮৬ সালে আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি জার্নালে জনস্বাস্থ্য প্রফেসর ডক্টর উইলিয়াম জার্ভিস কর্তৃক “HelpingYour Patients Deal with Questionable Cancer Treatments” শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধের ২৯৪তম পৃষ্ঠার বরাতে প্রতিবেদনটিতে জানানো হয়, পৃথিবীতে ক্যান্সারমুক্ত সমাজ বসবাস করছে, এটা একটি পৌরাণিক কথা বা মিথ। নিবন্ধটিতে এছাড়াও বলা হয়, হুনজা জনগোষ্ঠীকে সাধারণত এই মিথের প্রবক্তা ধরা হয়৷ কিন্তু, উক্ত এলাকায় চিকিৎসাবিষয়ক সুযোগ-সুবিধার অভাবে এই দাবিটি যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে, বলা হয় যে, ১৯৫০ এর মধ্যকালীন সময়ে Kyoto University থেকে একটি টিম উপত্যকাটিতে রিসার্চ করতে যায় এবং সেখানকার কিছু অধিবাসীদের মধ্যে ক্যান্সার পাওয়া যায়৷ 

তাছাড়া, এ বিষয়ে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি’তে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে জাপানি রিসার্চার কিনজি ইমানিশির লেখা বই Personality and Health in Hunza Valley এর বরাতে জানানো হয়, ১৯৫৫ সালের একটি অভিযানে তিনি হুনজা উপত্যকায় বসবাসকারী কমপক্ষে ১০ জনের মধ্যে টিউমার দেখা যাওয়ার বিষয়টি নথিবদ্ধ করেন। উক্ত রিসার্চার বলেন, হুনজা উপত্যকার বসবাসকারীরা ক্যান্সারমুক্ত দাবিটি ভিত্তিহীন।

এছাড়া, আমেরিকান সাংবাদিক জন টিয়ার্নি যখন হুনজা উপত্যকায় গিয়েছিলেন, তখন তিনি হুনজা উপত্যকায় বসবাসকারীদেরকে ব্রঙ্কাইটিস, টিউবারকিউলোসিস, আমাশয়, ম্যালেরিয়া, টিটেনাসের পাশাপাশি ক্যান্সারে ভুগতেও দেখেছিলেন মর্মে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশ করা নিজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন।

তাছাড়া, দাবিতে বলা হয় এপ্রিকট খাওয়ার ফলে হুনজা উপত্যকার অধিবাসীদের মধ্যে ক্যান্সার বা টিউমার দেখা যায় না। কিন্তু, হুনজা উপত্যকার অধিবাসীদের মধ্যে ক্যান্সার বা টিউমার দেখা যাওয়ার পক্ষে ইতোমধ্যেই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া, এএফপির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এপ্রিকট ফল খাওয়ার ফলে হুনজারা ক্যান্সার থেকে মুক্ত থাকার দাবিটি ১৯৮০ সালের দিকেই খণ্ডন করা হয়।

অধিকন্তু, এপ্রিকট ফল ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকরী, দাবিটির পক্ষেও চিকিৎসাবিজ্ঞান উল্লেখযোগ্য কোনো প্রমাণ পায়নি। Cancer Research UK এর একটি নিবন্ধ অনুসারে, ভিটামিন বি১৭ বলতে অ্যামিগড্যালিন নামের একটি পদার্থ বুঝায় যা প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভিদে পাওয়া যায়, যার মধ্যে এপ্রিকট বীজও রয়েছে। অ্যামিগড্যালিন বা এর কৃত্রিম রূপ লেট্রাইলকে ক্যান্সারের চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করলে তাতে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। লেট্রাইল যখন শরীরের দ্বারা প্রসেস হয়, এটি সায়ানাইডে রূপান্তরিত হয়৷ সায়ানাইড এক প্রকারের বিষ যা ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে কাজ করে বলে মনে করা হতো। কিন্তু, লেট্রাইট ক্যান্সার নিরাময় করতে পারে, এর পক্ষে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। তাছাড়া, উক্ত নিবন্ধে বলা হয়েছে, লেট্রাইলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে জ্বর, মাথাব্যথা, স্নায়ু ক্ষতি এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। 

২০১৬ সালে ইউরোপীয়ান ফুড সেফটি অথোরিটি একটি বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে সতর্ক করে জানায়, তিনটির বেশি এপ্রিকট শস্য খাওয়া সায়ানাইডের নিরাপদ গ্রহণ মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাছাড়া, এটির নামে ভিটামিন শব্দ থাকলেও এটি আসলে কোনো ভিটামিন নয়। 

এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ এর অধীনস্থ বা অংশ প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউটের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লেট্রাইল/অ্যামিগড্যালিন/ভিটামিন বি১৭ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকরী নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের অন্যান্য সংস্থা যেমন সিঙ্গাপুর ফুড এজেন্সি কাঁচা এপ্রিকট শস্য খাওয়ার ঝুঁকির বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সতর্ক করেছে। দ্য ক্যান্সার কাউন্সিল নামের অস্ট্রেলিয়ার একটি নন প্রফিট সংস্থা এপ্রিকটকে ক্যান্সারের চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করতে বিশেষভাবে মানা করেছে। তারা জানিয়েছে, অতিরিক্ত পরিমাণে এপ্রিকট খাওয়ার কারণে ক্যান্সার থেকে প্রতিকার তো হবেই না, পাশাপাশি এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। এছাড়া, ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড কাঁচা এপ্রিকট শস্য বা বীজ বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে হুনজা উপত্যকার অধিবাসীরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়না এবং এপ্রিকট ঝাওয়ার ফলে তারা ক্যান্সারের আক্রান্ত হয় না দাবিটি সত্য না। বরং তারা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে এবং এপ্রিকট নামের যে ফলকে ক্যন্সার না হওয়ার জন্য ক্রেডিট দেওয়া হয়, সেটিও ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকরী নয়, বরং অতিরিক্ত পরিমাণে এপ্রিকট খেলে তা শরীরের জন্য গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে।

হুনজা উপত্যকার অধিবাসী নারীরা কি ৬৫ থেকে ৯০ বছর পর্যন্ত গর্ভধারণ করতে পারে?

হুনজাদের সম্পর্কে আরেকটি প্রচলিত দাবি হলো হুনজারা ৬৫ বছর বা তার পরও যুবতী থাকে এবং অনায়াসেই গর্ভধারণ করতে পারে৷ 

এই দাবির পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে, এই দাবিটি হুনজার বাইরে বসবাসকারী বিশ্ববাসীদের জন্যেও একদম অসম্ভব বলা যায়না তবে বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী বেশ বিরল। মূলত, গর্ভধারণের সুনির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই৷ তবে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণ জটিল হয়ে যায় এবং গর্ভধারণের হার কমে যায়। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রাকৃতিকভাবে সবচেয়ে বেশি বয়সে গর্ভধারণ করেছেন যুক্তরাজ্যের ডন ব্রুক। ১৯৯৭ সালে ৫৯ বছর বয়সে তিনি গর্ভধারণ করেছেন। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ চ্যানেল সিএনএনে ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৬৭ বছর বয়সে চীনের একজন অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং তিনি একটি মেয়ে শিশুর জন্ম দিয়েছেন। তাই, বেশি বয়সে সন্তান জন্ম দেওয়া একদম অসম্ভব নয় তবে তা বেশ বিরল।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন হেলথকেয়ার মিডিয়া পাবলিশিং কোম্পানি মেডিসিন নেটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই৷ তবে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে গর্ভধারণ করা জটিল হয়ে যায়। সাধারণত মেনোপজের ৫ থেকে ১০ বছর আগে থেকেই একজন নারীর গর্ভধারণ করার ক্ষমতা কমে যায়। মেনোপজেরও কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই৷ মেনোপজের গড় বয়স ৫১ বছর ধরা হয়৷ তবে, আগে থেকে কারোর মেনোপজের বয়সসীমা অনুমান করার সুযোগ নেই৷ এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৪৫ এবং ৫৫ বছর বয়সের মধ্যকার সময়ে ঘটে থাকলেও কারোর ক্ষেত্রে ৩০ বছরের কাছাকাছি সময়ে আবার কারোর ক্ষেত্রে এটি ৬০ বছরও হতে পারে। এক বছর চেষ্টার পর, ৪০ বছরের বেশি বয়সী কোনো নারীর জন্য গর্ভধারণের ক্ষমতা প্রায় ৪৪%, অপরদিকে ৩০ বছরের কম বয়সে গর্ভধারণের এই সম্ভাবনা প্রায় ৮৫%।

Photo : Medicine Net

অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে গর্ভধারণের কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে গর্ভধারণ নারীদের জন্য কঠিন এবং জটিল হয়ে যায়, কারো কারো ক্ষেত্রে অসম্ভবও হয়ে যেতে পারে৷

মূলত, পাকিস্তানের গিলগিট-বালতিস্তানের উত্তর অঞ্চলের পাহাড়ি একটি উপত্যকা হচ্ছে হুনজা উপত্যকা। এখানকার অধিবাসীদের নিয়ে নানাসময়ে কিছু দাবি প্রচার করা হয়।  দাবিগুলো হচ্ছে, হুনজা উপত্যকার মানুষদের গড় আয়ু ১০০ থেকে ১২০ বছর, কেউ কেউ ১৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচে; এখনকার মানুষদের কখনও ক্যান্সার, টিউমার বা কোনো রোগ হওয়ার কেউ প্রমাণ পায়নি, কারণ তারা এপ্রিকট নামের একটি ফল খায় যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকরী ; এখনকার নারীরা ৬৫ থেকে ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত যৌবন ধরে রাখতে পারে এবং অনায়াসেই গর্ভধারণ করতে পারে৷ কিন্তু, রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, এর কোনো দাবির পক্ষেই নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই৷ হুনজা উপত্যকার অধিবাসীদের মধ্যে বয়স বাড়িয়ে বলার প্রবণতা দেখা যায় এবং তারা অশিক্ষিত হওয়ার কারণে তাদের আসল জন্মতারিখ তারা জানে না এবং তাদের জন্মসনদও নেই। তাছাড়া, জাপানি রিসার্চার ও আমেরিকান সাংবাদিক যারা তাদের এলাকায় ভ্রমণ করেছেন, তারা হুনজা অধিবাসীদের মধ্যে ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগ দেখতে পেয়েছেন। ৬৫ থেকে ৯০ বছর বয়সে হুনজা উপত্যকার নারীদের গর্ভধারণের পক্ষেও কোনো বিশ্বস্ত সূত্রে তথ্যপ্রমাণ নেই।

সুতরাং, হুনজা উপত্যকা সম্পর্কে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত এই দাবিগুলো ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img