সম্প্রতি, “হস্তক্ষেপ বিরোধী হলেও নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসা নীতির বিরোধিতা করবে না চীন” শীর্ষক একটি তথ্যকে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের মন্তব্য দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ভিসানীতির বিরোধিতা না করা নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন কোনো মন্তব্য করেননি বরং তাঁর ভিন্ন একটি মন্তব্যকে বিবৃত করে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
গুজবের সূত্রপাত
অনুসন্ধানের শুরুতে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে ‘Voice Bangla’ নামের একটি ফেসবুক পেজে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ‘নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসা নীতির বিরোধিতা করবে না চীন!’ শীর্ষক শিরোনামে ও থাম্বনেইলে প্রকাশিত ৬ মিনিট ২৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
আলাচিত দাবিটির যাচাইয়ের জন্য ভিডিওটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। ভিডিওটির শুরুতেই মোস্তফা ফিরোজ দৈনিক মানবজমিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম পড়ে শোনান। শিরোনামটি ছিল ‘রাষ্ট্রদূত জানালেন- হস্তক্ষেপ বিরোধী বাংলাদেশের অবস্থানে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যাবে চীন।’
শিরোনাম পড়ে শোনানোর পরই এই বিষয়ে মত দিয়ে তিনি বলেন, ‘হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন(রাষ্ট্রদূত) কিন্তু নির্বাচন নিয়ে কথা বলেননি। এটা একটা ইঙ্গিত দেয় সম্ভবত নির্বাচন নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চায় না চীন।’
এরপর মানবজমিনের পুরো প্রতিবেদনটি পড়ে শোনান তিনি। প্রতিবেদনটি পড়ার পর এ বিষয়ে তার নিজস্ব মতামত দিতে গিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিষয়ে চীন ও রাশিয়ার নিকট অতীতের অবস্থানকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে তিনি বলেন, এটা হতে পারে, চীন হয়তো বুঝতে পেরেছে বাংলাদেশে একটি পরিবর্তন আসন্ন। পরিবর্তন যদি হয় তাহলে পরবর্তী সরকার যে ই আসুক না কেন তার সঙ্গে চীন কাজ করবে।
অর্থাৎ, ভিডিওটিতে কোথাও সরাসরি ‘নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসা নীতির বিরোধিতা করবে না চীন’ শীর্ষক দাবিটি চীনের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য হিসেবে প্রচার করা হয়নি এবং ভিডিওটির শিরোনামে ও থাম্বনেইলে উক্ত দাবিটি উল্লেখ করা হলেও উভয়ই স্থানের কোথাওই এটিকে রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য বলে উল্লেখ করা হয়নি বরং শিরোনামের শেষে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, ভিডিওটিতে সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ বিরোধী বাংলাদেশের অবস্থানে চীনের সমর্থনের বিষয়ে দেশটির রাষ্ট্রদূতের দেওয়া একটি বক্তব্য বিশ্লেষণ করেছেন এবং এ বিষয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করে বেশ কিছু কথা বলেছেন। এছাড়া, মতামতে তিনি ‘ইঙ্গিত দেয়’, ‘সম্ভবত’, ‘হয়তো’ ও ‘যদি হয়’ এর মতো শব্দদ্বয় উল্লেখ করেছেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই ভিডিওটি প্রকাশেরই পরই ‘নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসা নীতির বিরোধিতা করবে না চীন’ শীর্ষক তথ্যটি চীনের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে, কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে মানবজমিনের অনলাইন সংস্করণে গত ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আলোচিত প্রতিবেদনটি খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরোধিতায় বেইজিং অব্যাহতভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন ঢাকাস্থ চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত রিসিপশন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত বলেন, জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরোধিতায় চীন ঢাকাকে সমর্থন করে, যাতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে এবং উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে পারে।
প্রতিবেদনেের কোথাও ‘হস্তক্ষেপ বিরোধী হলেও নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসা নীতির বিরোধিতা করবে না চীন’ শীর্ষক তথ্য উল্লেখ নেই।
পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর ওয়েবসাইটে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ‘চীন ‘বহিরাগত হস্তক্ষেপের’ বিরোধীতায় বাংলাদেশকে সমর্থন করে : রাষ্ট্রদূত’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদন থেকেও চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এর বক্তব্যের বিষয়ে একই তথ্য জানা যায়।
অর্থাৎ, উপরোক্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন “হস্তক্ষেপ বিরোধী হলেও নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসা নীতির বিরোধিতা করবে না চীন” শীর্ষক কোনো মন্তব্য করেননি।
মূলত, গত ২৫ সেপ্টেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত রিসিপশন অনুষ্ঠানে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরোধিতায় বেইজিং অব্যাহতভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে যাবে বলে জানান ঢাকাস্থ চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। তার এই বক্তব্য নিয়ে দৈনিক মানবজমিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে নিজের ফেসবুক পেজ Voice Bangla তে প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। পরবর্তীতে মোস্তফা ফিরোজের মতামতের ওপর ভিত্তি করে উক্ত ভিডিওর শিরোনাম ও থাম্বনেইলে ব্যবহৃত ‘হস্তক্ষেপ বিরোধী হলেও নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসা নীতির বিরোধিতা করবে না চীন’ শীর্ষক মন্তব্যটিকে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের মন্তব্য দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়। তবে অনুসন্ধানে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের এমন কোনো মন্তব্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার গত ২২ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।
উল্লেখ্য, পূর্বেও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের মন্তব্য দাবিতে ভুয়া তথ্য প্রচার করা হলে সেসময় বিষয়টি নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, “হস্তক্ষেপ বিরোধী হলেও নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসা নীতির বিরোধিতা করবে না চীন” শীর্ষক একটি তথ্যকে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের মন্তব্য দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Voice Bangla Facebook: Video Post
- Manab Zamin: রাষ্ট্রদূত জানালেন- হস্তক্ষেপ বিরোধী বাংলাদেশের অবস্থানে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যাবে চীন
- BSS: বহিরাগত হস্তক্ষেপের’ বিরোধীতায় বাংলাদেশকে সমর্থন করে : রাষ্ট্রদূত
- Rumor Scanner’s Own Analysis