আল জাজিরার ভুয়া সূত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ৭ দিনের মধ্যে পদত্যাগপত্র জমা দিতে বলার গুজব

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা হারায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। ০৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে অনেকেই নানারকম তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় নিজেও দাবি করেছিলেন, “শেখ হাসিনা এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।” সর্বশেষ শেখ হাসিনার কল রেকর্ড দাবিতে ফাঁস হওয়া একটি কল রেকর্ডে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, সাংবিধানিকভাবে শেখ হাসিনা এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়মানুযায়ীভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেননি। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরাকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে, “জাতিসংঘ থেকে ৭ দিনের মধ্যে পদত্যাগপত্র জমা চাইছে, না দিতে পারলে সেনাবাহিনীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে! ভারত, রাশিয়া, চীন জাতিসংঘ তে সব ঠিক করে ফেলছে! জাতিসংঘ শর্ত আরোপ করা সাথে সাথে অন্তবর্তী সরকার বাতিল হয়ে যাবে, তখন সেনাপ্রধান ক্ষমতা নিয়ে শেখ হাসিনাকে দেশে এনে ক্ষমতা বুজিয়ে দিবে!”

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

উক্ত দাবিতে এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ৭ দিনের মধ্যে পদত্যাগপত্র জমা দিতে বলেছে জাতিসংঘ শীর্ষক দাবিতে আল জাজিরা কোনো সংবাদ প্রচার করেনি। জাতিসংঘ এমন কোনো নির্দেশ দেয়নি৷ তাছাড়া, চীন, রাশিয়া এবং ভারত কেউই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরোধিতা করেনি বরং প্রত্যেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অভিনন্দন বা শুভকামনা জানিয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরায় আলোচিত দাবির স্বপক্ষে এমন কোনো সংবাদ প্রচার হওয়ার পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ আল জাজিরায় বাংলাদেশ নিয়ে গত এক মাসে প্রকাশিত সংবাদগুলোতেও এরকম কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি৷ বাংলাদেশ নিয়ে আল জাজিরায় প্রকাশিত সর্বশেষ সংবাদ বা প্রতিবেদনের অনুসন্ধান করলে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রায় ২৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের একটি স্ট্রিম বা শো পাওয়া যায় যা বিগত সরকার ক্ষমতা হারানোর এক মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশ করা হয়৷ ভিডিওটিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম, প্রত্যাশাসহ নানা বিষয়ে বাংলাদেশি ছাত্র আন্দোলনকারীসহ একাধিক ব্যক্তির মতামতও প্রচার করা হয়৷ তবে, ভিডিওটিতে আলোচিত দাবিটির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এছাড়া, আল জাজিরায় অধিকতর অনুসন্ধান করলে বাংলাদেশ সম্পর্কিত গত ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে আরেকটি প্রতিবেদন পাওয়া যায় যেখানে মূলত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে গুম, নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়৷ উক্ত প্রতিবেদনেও আলোচিত দাবির স্বপক্ষে কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

তাছাড়া, প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে অন্য কোনো গণমাধ্যম সূত্রেও আলোচিত দাবির স্বপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বরং বাংলাদেশি গণমাধ্যম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের গত ৬ সেপ্টেম্বর তারিখের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে সাত সদস্যবিশিষ্ট দল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে অনুসন্ধান করলে বাংলাদেশে থাকা রাশিয়ার দূতাবাসের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, গত ২৭ আগস্ট তারিখে ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করে ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানান এবং একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার পুনরাবৃত্তি করেন।

তাছাড়া, বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টারের গত ০৯ আগস্ট তারিখের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চীন স্বাগতম জানিয়েছে এবং চীন জানিয়েছে তারা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ না করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একইসাথে বাংলাদেশ ও চীনের বন্ধুত্বের সম্পর্ককেও তারা গভীর এবং দীর্ঘ বলে জানায়। সাম্প্রতিক সময়ে নির্ভরযোগ্য বা গণমাধ্যম সূত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চীনের বিরোধিতার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজের এক্স অ্যাকাউন্টে গত ০৮ আগস্ট তারিখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে শুভকামনা জানান এবং ভারত বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে দুই দেশের উন্নতির জন্য কাজ করা চলমান রাখবে বলেও জানান। সাম্প্রতিক সময়ে নির্ভরযোগ্য বা গণমাধ্যম সূত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ভারত সরকারেরও বিরোধিতার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।

অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে রাশিয়া, চীন এবং ভারত প্রতিটি দেশই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অভিনন্দন বা শুভকামনা জানিয়েছে এবং একসাথে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে৷ 

উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের একটি সাক্ষাতের ভবিষ্যত নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠানোর মতো জটিল আলোচনা এড়াতেই হয়তো নরেন্দ্র মোদি সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছেন না। তবে, কোথাও আলোচিত দাবিটির উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

সুতরাং, রাশিয়া, চীন ও ভারতের সুপারিশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ৭ দিনের মধ্যে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে জাতিসংঘ শীর্ষক দাবিতে আল জাজিরা সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মর্মে প্রচারিত তথ্যটি ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img