খুনের আসামী হয়ে ৭ বছর বয়সী শিশুর জেলে যাওয়ার ভুয়া তথ্য প্রচার

অন্তত ২০২৩ সাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুলিশের পোশাক পরিহিত এক নারীর সাথে এক শিশুর ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, শিশুটির বয়স ৭ বছর এবং সে খুনের আসামী হয়ে জেলে আছে।

৭ বছর

উক্ত দাবিতে চলতি বছরে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এবং এখানে (আর্কাইভ)।

উক্ত দাবিতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত ভিডিওটিতে দেখানো শিশুটি খুনের আসামী হয়ে জেলে থাকার দাবিটি সঠিক নয় বরং চটকদার শিরোনামে উক্ত ভিডিও প্রচার করা হলেও ভিডিওটি পর্যবেক্ষণে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে, সে কোনো অপরাধ করেনি এবং তার জেলও হয়নি।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে উক্ত ভিডিওতে পুলিশের পোশাক পরিহিত এক নারীর সাথে এক শিশুকে দেখা যায়। শিশুটিকে ক্যামেরার পেছনে থাকা অপর এক ব্যক্তির (পুরুষ) বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে শোনা যায়।

কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে Dipa akter নামের একটি ফেসবুক পেজে সম্ভাব্য প্রথম পোস্ট হিসেবে ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত উক্ত ভিডিওটি (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়।

এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া অবধি ভিডিওটি প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ বার দেখা হয়েছে। ভিডিওটিতে প্রায় ৩ লাখ ২১ হাজার পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। ভিডিওটি শেয়ার করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার বার। ভিডিওটির মন্তব্যঘর ঘুরে অধিকাংশ নেটিজেনকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায়।

Screenshot: Facebook

ভিডিওটি পর্যবেক্ষণে ক্যামেরার পেছনে থাকা ব্যক্তির (পুরুষ) সাথে শিশুটির কথোপকথনে তাকে অপরাধী বলে মনে হয় এমন কোনো শব্দ বলতে শোনা যায়নি। শিশুটি জানায়, তার নাম রায়হান শেখ। বাড়ি টুঙ্গিপাড়া। পড়াশোনা করে প্লে’তে। 

সেখানে কথোপকথনের এক পর্যায়ে ক্যামেরার আড়ালে থাকা ব্যক্তি শিশুটিকে জিজ্ঞেস করেন, শিশুটি বড় হয়ে কী হতে চায়। জবাবে শিশুটি বলে, সে পুলিশ হতে চায়। তার পুলিশ ভালো লাগে। এরপর ওই ব্যক্তি তাকে পুলিশকে ভয় লাগে কিনা জিজ্ঞেস করলে শিশুটি না সূচক উত্তর দেয়। এরপর ক্যামেরার আড়ালে থাকা ব্যক্তি তাকে বলেন, “তোমার তো ভয় (পুলিশের অস্ত্র) পাওয়ার কিছু নাই। তুমি তো অপরাধ করো নাই। ভয় পাবে অপরাধীরা। তোমরা ভালোবাসবা পুলিশকে।” এরপরের কথোপকথন থেকে জানা যায়, শিশুটি সেখানে তার নানাবাড়ি বেড়াতে এসেছে।

অর্থাৎ, শিশুটি যে অপরাধী নয় তা তাদের কথোপকথনের মাধ্যমেই স্পষ্ট। 

তাছাড়া, পেজটির ট্র‍ান্সপারেন্সি সেকশনে গিয়ে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর পেজটি খোলা হয়েছে। এর ছয় দিন পর উক্ত ভিডিওটি আপলোড করা হয়।

Screenshot: Facebook

অর্থাৎ, উক্ত পেজ থেকে আলোচিত শিশুর ভিডিওটি চটকদার শিরোনামে আপলোড করা হয়; যা পরবর্তীতে কপি-পেস্ট হয়ে আসল দাবিতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

তাছাড়া, গণমাধ্যম বা অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে সাত বছর বা তার কাছাকাছি বয়সের কোনো শিশু খুনের আসামী হয়ে জেলে যাওয়ার বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। 

এছাড়াও, বাংলাদেশের বিদ্যমান শিশু আইন (২০১৩) অনুযায়ী ৭ বছর বয়সী কোনো শিশুকে কোনো অবস্থাতেই গ্রেফতার করার নিয়ম নেই।

Screenshot: Laws of Bangladesh

তাছাড়া, ২০১৩ সালের শিশু আইনের ৪ নং ধারা অনুসারে, ১৮ বছর পর্যন্ত সবাই শিশু হিসেবে গণ্য হবে। ৩৩ (১) ধারামতে, অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো শিশুকে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কারাদণ্ড দেওয়া যাবে না। আর ৩৪ (১) ধারা অনুযায়ী, কোনো শিশু মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধে দোষী প্রমাণিত হলে শিশু আদালত তাকে অনূর্ধ্ব ১০ বছর এবং অন্যূন তিন বছর মেয়াদে আটকাদেশ দিয়ে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখার আদেশ দিতে পারবেন।

অর্থাৎ, উপরোক্ত তথ্য উপাত্ত থেকে এটা স্পষ্ট যে, আলোচিত ভিডিওটিতে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয়।

মূলত, অন্তত ২০২৩ সাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুলিশের পোশাক পরিহিত এক নারীর সাথে এক শিশুর ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, শিশুটির বয়স ৭ বছর এবং সে খুনের আসামী হয়ে জেলে আছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, চটকদার শিরোনাম ব্যবহার করে উক্ত ভিডিও প্রচার করা হলেও ভিডিওটি পর্যবেক্ষণে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে, শিশুটি কোনো অপরাধ করেনি বা জেলও হয়নি। বাংলাদেশে বিদ্যমান শিশু আইন (২০২৩) অনুযায়ী, ৭ বছর বয়সী কোনো শিশুকে গ্রেফতার বা জেলে দেওয়ার বিধান নেই। শিশুটি অপরাধী হিসেবে গণ্য হলেও তাকে জেলে না পাঠিয়ে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখা হতো।

সুতরাং, ৭ বছর বয়সী শিশুটি খুনের আসামী হয়ে জেলে আছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img