ভারতের সেভেন সিস্টার্সে যাওয়া গ্যাস লাইন বন্ধের দাবিটি গুজব  

স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ বন্যা দেখছে বাংলাদেশ। বাঁধ খুলে দেওয়ার অভিযোগ এনে বন্যার এই পরিস্থিতির জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে ভারতকে দায়ী করা হচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশ থেকে সরবরাহ করা গ্যাস লাইনের সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। একই দাবিতে একটি ভিডিও-ও প্রচার করা হয়েছে, যা দেখিয়ে বলা হচ্ছে, গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের দৃশ্য এটি। 

গ্যাস লাইন বন্ধের

উক্ত দাবিতে ফেসবুকের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

ভিডিওটি ব্যবহার করে ফেসবুকের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

একই দাবিতে ইউটিউবের ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

একই দাবিতে টিকটকের ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে এক্সের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে ভারতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার যে দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে তা সঠিক নয় বরং বাংলাদেশ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস ভারতে রপ্তানি হয় না। তবে এলপি গ্যাস রপ্তানি হলেও তার সরবরাহ বন্ধ হওয়ার কোনো তথ্য নেই। যে ভিডিওটি প্রচার করা হচ্ছে তাও দুই বছরের পুরোনো এবং ভিন্ন ঘটনার৷ 

রিউমর স্ক্যানার এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দেখতে পায়, এই দাবিটি ছড়াচ্ছে একটি এক্স পোস্ট এবং একটি ভিডিওকে কেন্দ্র করে৷ আয়রন ক্ল্যাড নামের এক্স অ্যাকাউন্টটি থেকে গত ২৫ আগস্ট করা এক পোস্টে দাবি করা হয়, “ভারতের সেভেন সিস্টারে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ।” এই পোস্টে প্রাকৃতিক নাকি এলপি গ্যাস তা অবশ্য পরিস্কার করা হয়নি। আমরা যাচাই করে দেখেছি, এই অ্যাকাউন্টটি নিয়মিতই অপতথ্য ছড়িয়ে থাকে। 

আলোচিত পোস্টটির পর অ্যাকাউন্টটি থেকে আরেক পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, “ভারত সরকার সকল এনজিওকে বলেছে বাংলাদেশে যাতে কোনো ত্রাণ সহায়তা না পাঠানো হয়।” আদতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো নির্দেশনাই আসেনি। ভারতের একজন ফ্যাক্টচেকারও রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছেন, এমন কোনো খবর তাদেরও চোখে পড়েনি। তিনি বলছিলেন, “কূটনীতিক দোনামনা থাকলেও এমন পরিস্থিতিতে এই ধরনের কোনও নির্দেশনা বা সিদ্ধান্ত অবাস্তব মনে হয়। আজগুবি। সার্চ করেও এই এক্স পোস্ট ছাড়া এই সংক্রান্ত আর কিছু দেখলাম না।”

এই অ্যাকাউন্টটি থেকে নিয়মিত অপতথ্য ছড়ানোর দরুন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এই অ্যাকাউন্টটি ব্যান করে দেওয়া হয়েছে। দেশটির দুইজন ফ্যাক্টচেকার বিষয়টি রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছেন। 

একই দাবিতে যে ভিডিওটি ছড়াচ্ছে, তার বিষয়ে অনুসন্ধানে ইউটিউবের একটি বাংলাদেশি চ্যানেলে ২০২২ সালের ০৭ মার্চ প্রকাশিত একই ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটির বিষয়ে চ্যানেলটি উল্লেখ করেছে, এটি তেল এবং গ্যাস লাইনে অভ্যন্তরীণ ক্ল্যাম্প ইনস্টল করার দৃশ্য। অর্থাৎ, এটা নিশ্চিত যে দৃশ্যটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়। 

গ্যাস সরবরাহ বন্ধের দাবিটি নিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, ২০২২ সালের জুনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ৮২ মেট্রিক টন তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপি) ভারতে পাঠানো হয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর চাহিদা মেটাতে ৮ জুন এসব গ্যাস ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনের অধীনে ত্রিপুরা রাজ্যের বিশালগড়ের প্লান্টে সরবরাহ করা হয়। 

২০২২ সালের পর আর এলপি গ্যাস পাঠানো হয়েছে কিনা এ বিষয়ে গণমাধ্যম সূত্রে কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। এ বিষয়ে সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্মসচিব শামীমা ফেরদৌস রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, ২০১৭ সালে নেপালসহ ভারতীয় সেভেন সিস্টার্স স্টেটসমূহে ৫০ হাজার মেট্রিক টন এলপি গ্যাস রপ্তানির অনুমতির জন্য সরাসরি জ্বালানি  ও খনিজ সম্পদ বিভাগে ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড আবেদন করে। পরবর্তীতে তাদের অনাপত্তি প্রদান করা হয়। এর মধ্যে ২০২৩ সালেও প্রায় ৪৭ হাজার মেট্রিক টন পাঠাতে না পারায় আবারও অনাপত্তিপত্র চাওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় সে বছরের ১২ জুলাই ফের অনাপত্তিপত্র দেয়। 

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পাওয়া নথি থেকে জানা যাচ্ছে, অপর কোম্পানি বিএম এনার্জি লিমিটেড ২০২১ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ১৫ হাজার মেঃ টন এলপিজি রপ্তানি করতে অনাপত্তি চাইলে তাদেরও অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালে অনাপত্তি পত্রের মেয়াদ বৃদ্ধি প্রদান করার জন্য কোম্পানিটির অনুরোধের প্রেক্ষিতে সেসময় ফের অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়৷ তবে বেক্সিমকোর বিষয়ে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই বলে এই সূত্রটি আমাদের নিশ্চিত করেছে।  

তবে ভারতে বাংলাদেশ থেকে কখনোই প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করা হয়নি। এ বিষয়টি রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোঃ নূরুল আলম। 

সুতরাং, ভারতের সেভেন সিস্টার্সে যাওয়া গ্যাস লাইন বন্ধ দাবিতে ভাইরাল বিষয়টি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img