গত ৬ মে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে একাধিক বিস্ফোরণের খবর মেলে। ভারত দাবি করে, ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে এক অভিযানে তারা জইশ-ই-মোহাম্মদ ও লস্কর-ই-তইয়েবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। ভারতের সাম্প্রতিক উক্ত হামলার জবাবে পাকিস্তান গত ১০ মে সকালে পাল্টা অভিযান শুরু করে, যার নাম দেয় ‘অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস’। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কয়েক দিন ধরে সংঘর্ষ চলার পর গত ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, দেশ দুটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছে। এরই প্রেক্ষিতে অন্তত গত ১২ মে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ইনফোগ্রাফিক প্রচার করা হয়েছে যেখানে ভারত ও পাকিস্তান দুই পক্ষেরই ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।
দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তান জেট হারায়নি তবে ভারত ৬টি জেট হারিয়েছে। পাকিস্তানের বিমানঘাঁটি ৩ টি ও ভারতের ১১টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাকিস্তান ৭৮টি ও ভারত ৫৫৩টি ড্রোন হারিয়েছে। এছাড়াও সৈন্য, সাধারণ মানুষ, ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্তের বিষয়েও উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত ইনফোগ্রাফিকটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন প্রকাশ করেছে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ের পাক-ভারত সংঘাত বিষয়ে প্রচারিত ইনফোগ্রাফিকটি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন প্রকাশ করেনি বরং, ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় আলোচিত ইনফোগ্রাফিকটি তৈরি করে তাতে সিএনএনের লোগো সংযুক্ত করে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে সিএনএন কর্তৃক এরূপ কোনো ইনফোগ্রাফিক প্রচার হওয়ার সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, সিএনএনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাকাউন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করলেও আলোচিত ইনফোগ্রাফিকটি প্রচার হতে দেখা যায়নি।
তাছাড়া, আলোচিত ইনফোগ্রাফিকটিতে পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে সাম্প্রতিক সংঘাতে জয়ী বলা হলেও গত ১২ মে তারিখে সিএনএনের ওয়েবসাইটে “ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই নিজেদের বিজয়ী দাবি করেছে, কিন্তু সর্বশেষ এই সংঘাতে কেউ বিজয়ী নয়” শীর্ষক শিরোনামে একটি নিবন্ধ পাওয়া যায় যেখানে এক পর্যায়ে বলা হয়, “সিএনএন পূর্বে যেমন জানিয়েছিল, পাকিস্তান যখন দাবি করেছিল যে তারা ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, সেই সময়ের কাছাকাছি ভারতের পাকিস্তান সীমান্তবর্তী দুটি রাজ্যে দুটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র সিএনএন-কে জানায় যে, পাকিস্তান অন্তত একটি ভারতীয় রাফাল বিমান ভূপাতিত করেছে। কিন্তু ভারতীয় কর্মকর্তারা এখনো পর্যন্ত একটি বিমান হারানোর কথাও স্বীকার করতে নারাজ। এদিকে, ভারত নতুন স্যাটেলাইট ছবি প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে রানওয়ে এবং রাডার স্টেশনের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে, যা ভারতীয় প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের দাবি অনুযায়ী ভারতীয় বিমান হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। অর্থাৎ, ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতারা বিষয়টি নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করলেও, এই সংঘাতে কারও স্পষ্ট বিজয় নেই।” এছাড়াও, উক্ত সংঘাত নিয়ে দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের বলা কথার সংযুক্তিসহ নানা বিষয়ে উক্ত নিবন্ধে কথা বলা হয়।
এছাড়া, গত ৭ মে তারিখে সিএনএনে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি সামরিক সূত্র জানিয়েছে যে তারা “আত্মরক্ষার্থে” ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান এবং একটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, ভূপাতিত যুদ্ধবিমানগুলোর মধ্যে ফ্রান্সে তৈরি উন্নত মাল্টিরোল ফাইটার রাফালে জেট তিনটি, একটি মিগ-২৯ এবং একটি এসইউ-৩০ ফাইটার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একজন স্থানীয় বাসিন্দা ও একজন সরকারি কর্মকর্তা সিএনএন-কে জানান, ভারত-শাসিত কাশ্মীরে একটি অজ্ঞাত যুদ্ধবিমান একটি স্কুল ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়েছে। এএফপি সংবাদ সংস্থা প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, একটি লাল ইটের ভবনের পাশে একটি মাঠে বিমানটির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। তবে ছবিগুলো দেখে স্পষ্ট নয় যে, বিমানটি কোন দেশের। সিএনএন এই দাবি স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারেনি।
এছাড়াও, আরো নানা সময়ে সিএনএন ভারত পাকিস্তান সংঘাত বিষয়ে নানা প্রতিবেদন বা নিবন্ধ প্রকাশ করেছে কিন্তু আলোচিত ইনফোগ্রাফিকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
তাছাড়া এ বিষয়ে অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান লিড স্টোরিজের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে গত ১২ মে তারিখে প্রকাশিত একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, লিড স্টোরিজ এ বিষয়ে সিএনএনের মুখপাত্র লরেন কোনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে এই গ্রাফিকটি ভুয়া/জাল এবং এটি সিএনএন-এর প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদন নয়।”
সুতরাং, সাম্প্রতিক সময়ের পাক-ভারত সংঘাতের পরিসংখ্যান বিষয়ে সিএনএনের নামে প্রচারিত ইনফোগ্রাফিকটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- CNN – India and Pakistan both claim victory. But this latest conflict has no winners
- CNN – India launches strikes deep inside Pakistan and Pakistan claims 5 Indian jets shot down, in major escalation
- Lead Stories – Fact Check: CNN Did NOT Air Graphic Saying ‘Trump Helps Curb India’s Losses’ With Stats Showing India Losing In Conflict With Pakistan