গত ১১ জানুয়ারি সাবেক সংসদ সদস্য এনামুল হক জজ মিয়ার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশীয় বেশকিছু মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তার রাজনেতিক ক্যারিয়ার নিয়ে উল্লেখ করাএকটি তথ্য রিউমর স্ক্যানার টিমের নজরে এসেছে।
গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে যা দাবি করা হচ্ছে
সদ্য প্রয়াত এনামুল হক জজ মিয়া ১৯৮৩ সালে ময়মনসিংহ-১০ গফরগাঁও আসন হতে জাতীয় পার্টির সমর্থনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
উল্লিখিত দাবিতে দেশীয় মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন; নয়াদিগন্ত, জনকণ্ঠ, ইনকিলাব, যায়যায়দিন, দৈনিক আমাদের সময়, আজকের পত্রিকা, মানবকণ্ঠ, চ্যানেল২৪, আর টিভি, নাগরিক টিভি, বাংলা ট্রিবিউন, বাংলানিউজ২৪, ঢাকা পোস্ট, ডেইলি সান, নয়া শতাব্দী, রাইজিং বিডি, বিডি২৪লাইভ, খোলা কাগজ, বাংলাদেশ টুডে, পূর্ব-পশ্চিম এবং সাম্প্রতিক দেশকাল।
একই দাবিতে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন; জাগোনিউজ২৪, কালবেলা, বার্তা বাজার, ঢাকা টাইমস, বাংলাদেশ জার্নাল।
ফ্যাক্টচেক
এনামুল হক জজ মিয়া ১৯৮৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হননি বরং তিনি ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়নি।
১৯৮৩ সালে কি বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল?
কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘ডয়েচে ভেলে’ এর ওয়েবসাইটে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময় হতে শুরু করে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কাল উল্লেখ রয়েছে।
- প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ ১৯৭৩
- দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ ১৯৭৯
- তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ ১৯৮৬
- চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ ১৯৮৮
- পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ ১৯৯১
- ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ ১৯৯৬
- সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ ১৯৯৬
- অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ ২০০১
- নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ ২০০৮
- দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ ২০১৪
এছাড়া, সর্বশেষ ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাস নিয়ে নিয়ে দেশীয় মূলধারার গণমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন ইউটিউব চ্যানেল, সমকাল এবং বাংলাদেশ প্রতিদিন এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর সময়কাল সম্পর্কে একই তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
এনামুল হক জজ মিয়া কবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন?
জাতীয় সংসদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এর তথ্য মত এনামুল হক জজ মিয়া তৃতীয় এবং চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১০ গফরগাঁও আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তৃতীয় এবং চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো যথাক্রমে ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে। অর্থাৎ এনামুল হক জজ মিয়া ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সমর্থনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচন হন।
উল্লেখ্য, তৃতীয় সংসদের মেয়াদকাল ছিল ১ বছর ৫ মাস এবং চর্তুথ সংসদের মেয়াদকাল ছিল ২ বছর ৭ মাস। অর্থাৎ প্রয়াত এনামুল হক জজ মিয়া সর্বমোট ৪ বছর সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৮৩ সালে কি এনামুল হক জজ মিয়ার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ছিল?
১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৮৩ সালের পূর্বে ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে হিসেবে ১৯৮৩ সালে এনামুল হক জজ মিয়ার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না।
তাছাড়া, সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি এনামুল হক জজ মিয়া ১৯৮৩ সালে জাতীয় পার্টির সমর্থনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠাই হয় ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এবং ওই বছর প্রথমবারের মত বাংলাদেশের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল হিসেবে জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার ৩ বছর পূর্বে ওই রাজনৈতিক দলের সমর্থনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার দাবিটিও কাল্পনিক এবং ভিত্তিহীন।
মূলত, সদ্য প্রয়াত এনামুল হক জজ মিয়া তৃতীয় ও চর্তুথ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যথাক্রমে ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে ময়মনসিংহ-১০ গফরগাঁও আসন হতে জাতীয় পার্টির সমর্থনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে সম্প্রতি তার মৃত্যুকে কেন্দ্র বেশ কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হচ্ছে ‘এনামুল হক জজ মিয়া ১৯৮৩ সালে জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়নি।
প্রসঙ্গত, এক সময়ের সেনা কর্মকর্তা, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের পালিত মেয়ের জামাই এবং পরবর্তীতে এরশাদের সরকারের আমলে পরপর দুই দুইবারের নির্বাচিত এমপি এনামুল হক জজ মিয়া তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তিন মেয়েকে নিজের প্রায় সব সহায়-সম্পত্তি লিখে দেন। শেষ সম্বল গফরগাঁও পৌর শহরে থাকা ১২ শতাংশ জমি মসজিদের নামে দান করে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যান তিনি। পরবর্তীতে তৃতীয় স্ত্রী এবং এক শিশু সন্তান নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় মানবেতর জীবনযাবন করছিলেন এনামুল। সর্বশেষ তার ঠাঁই হয়েছিলো ভূমিহীনদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে। আর এই আশ্রয়ণ প্রকল্পেই গত ১১ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
সুতরাং, এনামুল হক জজ মিয়া ১৯৮৩ সালে জাতীয় পার্টির সমর্থনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- ওয়েবসাইট- বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
- ওয়েবসাইট- জাতীয় পার্টি
- ডয়েচে ভেলে- বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস
- ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন- ৪৭ বছরে বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস
- সমকাল- একনজরে বিগত ১০ সংসদ নির্বাচন
- বাংলাদেশ প্রতিদিন- ১৯৭৩-২০১৪: কেমন ছিল দশ সংসদ নির্বাচন
- ডিবিসি নিউজ- দুইবারের এমপির ঠাঁই আশ্রয়ন প্রকল্পে
- সমকাল- থেমে গেল লড়াকু সাবেক এমপি জজ মিয়ার জীবনগাড়ি