সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে নড়াইলে দীপ্ত সাহা নামে এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী তরুণের মরদেহের ছবি প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, ছেলেটি একটি হিন্দু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং রাতে কীর্তন করে মন্দির থেকে ফেরার সময় তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।

টুইটারে প্রচারিত এমন কিছু টুইট দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, নড়াইলে রাতে কীর্তন করে মন্দির থেকে ফেরার সময় দীপ্ত সাহা নামের হিন্দু ধর্মাবলম্বী তরুণকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয় বরং দীপ্ত সাহাকে তার চার সঙ্গীরাই মাদকের টাকা জোগাড় করার জন্য শ্বাসরোধ করে হত্যা করে এবং তার সঙ্গীদের মধ্যে তিনজনই হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘নড়াইলে পুকুরে ভাসছিল কলেজছাত্রের লাশ‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, নড়াইল সদর উপজেলার হুগলাডাঙ্গা শ্মশানের পাশের একটি পুকুর থেকে দীপ্ত সাহা নামে এক ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দীপ্ত নড়াইল সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
প্রতিবেদনটিতে পরিবার ও পুলিশ সূত্রে আরও বলা হয়, শুক্রবার বিকেলে বাড়ি থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন দীপ্ত সাহা। রাতে তাঁকে হুগলাডাঙ্গা বাজারে একটি অনুষ্ঠানের পাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখেন স্থানীয় লোকজন। পরে রাতে তিনি বাড়িতে না ফেরায় পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। শনিবার বেলা ১১টার দিকে হুগলাডাঙ্গা শ্মশানের পাশে একটি পুকুরে তাঁর লাশ ভাসতে দেখেন এলাকাবাসী। খবর পেয়ে দুপুরে পুলিশ এসে লাশটি উদ্ধার করে।

পরবর্তীতে Somoy TV এর ওয়েবসাইটে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘নড়াইলের দীপ্ত সাহা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন, গ্রেফতার ৪ জন’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, নড়াইলের দীপ্ত সাহা (২২) হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন ও হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে চার জনকে গ্রেফতার করেছে যশোর পিবিআই। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, সুমন সরকার (৩০), সজীব কুমার বিশ্বাস (২২), আকাশ রায় (২১) ও সাদ্দাম হোসেন (৩২)। গ্রেফতারকৃতরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এসময় তাদের থেকে দীপ্ত সাহার মোটরসাইকেলও উদ্ধার করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে পিবিআই যশোরের পুলিশ সুপার রেশমা শারমিনকে উদ্ধৃত করে আরও বলা হয়, ‘আসামি সুমন সরকার, সজীব কুমার বিশ্বাস, আকাশ রায় ও ভিকটিম দীপ্ত সবাই মাদকাসক্ত। তারা একসঙ্গেই মাদক সেবন করতো। গ্রেফতারকৃদের টাকা প্রয়োজন হলে তারা দীপ্তকে হত্যা করে তার মোটরসাইকেল ছিনতাই করার পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী তারা দীপ্তকে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মোবাইল ফোনে ঘটনাস্থলে আসতে বলে। দীপ্ত আসলে আসামিরা দীপ্তকে গাঁজা বানাতে দেয়। দীপ্ত গাঁজা বানাতে ব্যস্ত থাকাকালে আসামি আকাশ ও সজীব দীপ্তর গলায় পেছন থেকে দড়ি দিয়ে ফাঁস লাগায়। দড়ির এক প্রান্ত আকাশ ও অপর প্রান্ত সজীব টেনে ধরে দীপ্তর মৃত্যু নিশ্চিত করে। হত্যার পর দীপ্তর লাশ পাশের পুকুরে ফেলে দেয় তারা।’
পাশাপাশি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন, যশোরের ফেসবুক পেইজ PBI Jashore গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পিবিআই, যশোর ও নড়াইল জেলা পুলিশের অভিযানে ২৪ ঘন্টার মধ্যে নড়াইলে দীপ্ত সাহা হত্যা মামলার রহস্য উন্মোচন-আসামী গ্রেফতার এবং লুন্ঠিত মোটরসাইকেল উদ্ধার। শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়।

পোস্টটি থেকে জানা যায়, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকাল অনুমানিক ৫ টার সময় দীপ্ত সাহা (২২), নিজ বাড়ি হতে পাশ্ববর্তী হোগলাডাঙ্গা পূর্বপাড়া আড়ংখোলায় নামযজ্ঞ অনুষ্ঠান দেখার কথা বলে তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেল সহ বের হয়ে যায়। পরদিন নড়াইল সদর থানাধীন হোগলাডাঙ্গা গরানের মাঠ হাজরাতলা মহাশ্মশ্বানের উত্তর পার্শ্বে জনৈক উত্তম বিশ্বাস এর লীজকৃত মাছের ঘেরে পানির মধ্য হতে দীপ্ত সাহা (২২) এর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। উক্ত ঘটনায় পিবিআই, যশোর জেলার জিডি নং-২৫৫, মূলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ ছায়া তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে।

ছায়া তদন্তে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ০১। সুমন সরকার(৩০), পিতা-শিশির সরকার, ০২। সজীব কুমার বিশ্বাস (২২), পিতা-সরোজিত বিশ্বাস, ০৩। আকাশ রায়(২১), পিতা-গৌতম রায়, সর্বসাং-গোপালপুর, থানা-নড়াইল সদর, জেলা-নড়াইলগণ হত্যাকান্ডের সহিত জড়িত মর্মে সন্দেহ হলে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়াও আসামী মোঃ সাদ্দাম হোসেন বদির(৩২), পিতা-মৃত মিরাজ সিকদারকে নড়াইল জেলা পুলিশ ভিকটিম মৃত দীপ্ত সাহা এর খোয়া যাওয়া মোটরসাইকেলসহ গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদে আসামীরা মাদকের টাকার জন্য হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, নড়াইলে দীপ্ত সাহা হত্যার সাথে সাম্প্রদায়িক কোনো বিষয় জড়িত নেই। বরং নেশার টাকার জন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীও জড়িত ছিল বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক তদন্তে প্রতীয়মান হয়েছে।
মূলত, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকালে দীপ্ত সাহা (২২), নিজ বাড়ি হতে পাশ্ববর্তী হোগলাডাঙ্গা পূর্বপাড়া আড়ংখোলায় নামযজ্ঞ অনুষ্ঠান দেখার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। তবে পরবর্তীতে একটি মাছের ঘের থেকে তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে টুইটারে দীপ্ত সাহা একটি হিন্দু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং রাতে কীর্তন করে মন্দির থেকে ফেরার সময় তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, দীপ্ত সাহা হত্যার সঙ্গে ধর্মীয় কোনো বিষয় জড়িত ছিল না। বরং তার তিন হিন্দু ধর্মাবলম্বী বন্ধু সহ একজন মুসলিম তরুণ মাদকের টাকা জোগাড় করতে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়৷
সুতরাং, নড়াইলে রাতে কীর্তন করে মন্দির থেকে ফেরার পথে দীপ্ত সাহা নামে এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী তরুণকে ধর্মীয় কারণে শ্বাসরোধ করে হত্যার দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।