সম্প্রতি, জার্মানির একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে যাতে দাবি করা হচ্ছে, মা-বাবা সমকামিতাকে হারাম বলার কারণে সন্তানকে তাদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলেছে জার্মান প্রশাসন।
কী আছে ভিডিওতে?
০৪:১২ মিনিটের ভাইরাল ভিডিওটি বাংলাদেশে ছড়াতে শুরু করে গত ২৯ এপ্রিল। ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পোশাকের পেছনে Polizei ( পুলিশ শব্দের জার্মান অর্থ) নাম লেখা কিছু ব্যক্তিসহ সাদা পোশাকের (civil dress) কিছু ব্যক্তি একটি শিশুকে টেনে হিঁচড়ে বাসা থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। বোরকা পরিহিত দুইজন নারী তাদের বাধা দিতে চাইলেও পুলিশ সাড়া দেয়নি। ভিডিওটি ধারণ করেছেন একজন পুরুষ। তার চেহারা দেখা না গেলেও তার আর্তনাদ শুনে তিনিও উক্ত পরিবারের সদস্য বলে প্রতীয়মান হয়।
ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিরা জার্মান ভাষায় কথা বলার কারণে তাদের মধ্যে ঠিক কী আলোচনা হচ্ছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
কিন্তু বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে “সন্তান স্কুলে গিয়েছে বলেছে, তার বাবা-মা বলেছেন, সমকামিতা ইসলামে হারাম। তাই তাকে বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে জার্মান প্রশাসন।” শীর্ষক ক্যাপশন ব্যবহার করা হয়েছে।
উক্ত ক্যাপশন ব্যবহার করে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে ইউটিউবের কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, জার্মান পুলিশ সমকামিতা বিষয়ক কারণে এক শিশুকে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ জানিয়েছে, উক্ত ঘটনার সাথে সমকামি বা ইসলামের কোনো যোগসূত্র নেই।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত সবচেয়ে ভাইরাল হওয়া পোস্টটি খুঁজে বের করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। Frontier Daily নামের ফেসবুক পেজটি প্রকাশিত ভিডিওটি (আর্কাইভ) এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত ২৬ হাজার বার শেয়ার হয়েছে। ভিডিওটি দেখেছে অন্তত ৩৫ লক্ষ মানুষ। ভিডিওর প্রায় পাঁচ হাজার কমেন্ট বিশ্লেষণ করার পর বাংলাদেশি মডেল মাকুসদা আক্তার প্রিয়তির একটি কমেন্ট নজরে আসে আমাদের। তিনি একজনকে মেনশন করে তার কাছে ভিডিওটিতে কী বলা হয়েছে তা জানতে চেয়েছেন। জবাবে মোনাজ হক নামের উক্ত ব্যক্তি জানান, “তারা জার্মান ও তুর্কি ভাষায় যা বলছে তাতে যা বুঝলাম, পিতা মাতা বাচ্চ্চার সাথে দূর্ব্যাবহার করে মারপিট করে সেটা সেই বাচ্ছা স্কুলে শিক্ষককে বলেছে, তাই ফ্যামিলি আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাচ্চার নিরাপত্তার জন্যে পরিবার থেকে আলাদা করে সোসাল স্টেশনে নিয়ে যাচ্ছে। ক্যাপশনে যা লেখ হয়েছে তা সত্য নয়।” মোনাজ হক জার্মানিতে বসবাসরত একজন সংবাদ কর্মী।
জার্মান ভাষা জানেন এমন একাধিক কমেন্টেই একই মত দেওয়া হয়েছে উক্ত পোস্টে।
পরবর্তীতে অনুসন্ধানে করতে গিয়ে টুইটারে شؤون إسلامية নামক একটি অ্যাকাউন্টে একই ভিডিও (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোর ক্যাপশনের সাথে এই টুইটের ক্যাপশনে ভিন্নতা দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
টুইটের ক্যাপশনে আরবি ভাষায় যা লেখা রয়েছে তার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, জার্মান ফোর্স মুসলিম পরিবারের শিশুদের অপহরণ করছে। ইয়ুথ ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন এই কাজের অগ্রভাগে থাকলেও তাদের সহায়তা করছে জার্মান পুলিশ।
এই টুইটটি একই দিন (২৮ এপ্রিল) Bushra Shaikh নামে এক নারী শেয়ার,(আর্কাইভ) করেছেন। টুইটের ক্যাপশনে তিনি দাবি করেন, “একটি অল্প বয়স্ক ছেলেকে শিশু সুরক্ষা পরিষেবা এবং পুলিশ জোর করে তার পরিবার থেকে সরিয়ে দিয়েছে৷ স্কুল থেকে জানানো হয়েছিল যে তাকে শেখানো হচ্ছে যে ইসলামে সমকামিতা এবং ট্রান্স গ্রহণযোগ্য নয়। মতাদর্শের পার্থক্য বিপদ বা অপব্যবহার নয়।”
এই টুইটের ক্যাপশনের সাথে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোর ক্যাপশনের মিল পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, একই ঘটনার বিষয়ে দুইটি দাবি সামনে এসেছে।
জার্মানির ব্রেমারহেভেন শহরের পুলিশের অফিশিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে Bushra Shaikh এর টুইটেই এই প্রসঙ্গে একইদিন (২৮ এপ্রিল) রিপ্লে করা হয়।
ব্রেমারহেভেন পুলিশ জানায় (আর্কাইভ), ঘটনাটি ব্রেমারহেভেনেই ঘটেছে এবং এ বিষয়ে পুলিশ অবগত রয়েছে। তারা ভিডিওটি সংশ্লিষ্ট শাখায় প্রেরণ করেছেন।
ঐদিনই (২৮ এপ্রিল) ব্রেমারহেভেন পুলিশের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ব্রেমারহেভেনে একটি পুলিশ অভিযানের সাথে সম্পর্কিত, অপারেশনের একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। ভিডিওটি ব্রেমারহেভেন পুলিশের কাছে পরিচিত এবং তা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
আমরা আপনার বোঝার জন্য অনুরোধ করছি যে আমরা বর্তমান পরিস্থিতি এবং আমাদের তথ্যের বর্তমান স্তরের কারণে আর কোনো তথ্য দিতে পারি না। আমরা জল্পনা-কল্পনায় অংশ নিতে চাই না। অনুগ্রহ করে এই জল্পনা ছড়িয়ে আমাদের কাজে বাধা দেবেন না।”
টুইট এবং সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২৮ এপ্রিল শিশুটিকে নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার মূল কারণ পরিষ্কার করেনি সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ।
তবে পরের দিন (২৯ এপ্রিল) আরেকটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ব্রেমারহেভেন পুলিশ জানায়, “যুব কল্যাণ অফিস এবং ব্রেমারহেভেন পুলিশের যৌথ অভিযানের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, যার বিষয়ে বিভিন্ন মিথ্যা দাবিসহ মন্তব্য করা হয়েছে। ভিডিওটিতে দুটি শিশুর যত্ন নেওয়ার জন্য আদালতের আদেশের একটি ছোট অংশ দেখানো হয়েছে। এ অভিযানে যুব কল্যাণ অফিসকে সহযোগিতা করে পুলিশ। শিশুদের যত্ন নেওয়া সর্বদা শেষ অবলম্বন এবং শুধুমাত্র গুরুতর কারণ থাকলেই ঘটে। আমরা আপনার বোঝার জন্য অনুরোধ করছি যে, পরিবার এবং শিশুদের সুরক্ষার জন্য, আমরা এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারি না। আমরা সচেতন যে ভিডিওটি মানসিকভাবে বিরক্তিকর। অনুগ্রহ করে মিথ্যা তথ্য ও দাবি ছড়াবেন না।”
অর্থাৎ, যথেষ্ট গুরুতর একটি বিষয় বলেই সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ শিশুটিকে তাদের হেফাজতে নিয়েছে বলে দাবি করেছে। কিন্তু ঠিক কী কারণে তাকে হেফাজতে নেওয়া হলো সে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি।
এই বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধান করতে গিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরগুলো পড়ে দেখেছে।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ‘Anadolu Agency’ কর্তৃক গত ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও উক্ত ঘটনার সাথে সমকামি ইস্যুর বিষয়টি উঠে এসেছে৷ পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও আনাদোলু বলছে, এ বিষয়ে যুব কল্যাণ অফিসের তাৎক্ষণিক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে জর্ডানের সংবাদমাধ্যম ‘Roya News’ এর একই দিন (২৯ এপ্রিল) প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ক্লিপ বিশ্লেষণ করে রয়া নিউজ দেখেছে, শিশুটির বারবার চিৎকার শোনা গিয়েছিল, প্রতিবেশীর এমন অভিযোগের ভিত্তিতে শিশুটিকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
রয়া বলছে, অভিযোগের ভিত্তিতে শিশুটি যাতে সহিংসতার শিকার না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশকে পদক্ষেপ নিতে এবং বিষয়টি তদন্ত ও সমাধান না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে তাকে।
ভিডিওতে, আরব মহিলা কর্তৃক পুলিশকে বলতে শোনা যায়, শিশুটি “মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক শক”-এ ভুগছে, যার ফলে সে চিৎকার করে এবং মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়।
তিনি আরও বলেছিলেন, পুলিশ যা করছে তাতে শিশুটির ক্ষতি হতে পারে। রয়া তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, জার্মান আইন অনুসারে, যদি কেউ সহিংসতার শিকার হয় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা দেওয়া হলে, কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে হবে যাতে মানুষকে রক্ষা করা যায় এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
এ বিষয়ে জানতে জার্মানির ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা ‘dpa Deutsche Presse-Agentur GmbH’ এর সাথে যোগাযোগ করলে তাদের পক্ষ থেকে রিউমর স্ক্যানার টিমকে জানানো হয়, তারা উক্ত ঘটনার সাথে সমকামিতার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা সে বিষয়ে পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। ব্রেমারহেভেনের পুলিশের একজন মুখপাত্র তাদের জানিয়েছেন, ঘটনাটির সাথে LGBTQ বা ইসলামের কোনো সম্পর্ক থাকার দাবিটি অবশ্যই সত্য নয়।
মূলত, সম্প্রতি জার্মানিতে এক শিশুকে জার্মান পুলিশ তার মা-বাবার কাছ থেকে আলাদা করে নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার সময়ে ধারণকৃত একটি ভিডিওর ক্যাপশনে দাবি করা হয়, মা-বাবা সমকামিতাকে হারাম বলার কারণে সন্তানকে তাদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলেছে জার্মান পুলিশ। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত ঘটনার সাথে সমকামি বা ইসলামের কোনো যোগসূত্র নেই। স্থানীয় পুলিশের বরাতে জার্মানির ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা ‘dpa Deutsche Presse-Agentur GmbH’ রিউমর স্ক্যানারকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সুতরাং, জার্মান পুলিশ সমকামিতা সংশ্লিষ্ট কারণে এক শিশুকে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Bremerhaven Police: Tweet
- Bremerhaven Police: OPERATIONS IN BREMERHAVEN – POLICE INFORMED
- Bremerhaven Police: VIDEO – OPERATION BY THE OFFICE FOR YOUTH, FAMILY AND WOMEN AND THE POLICE
- Statement from dpa Deutsche Presse-Agentur GmbH
- Roya News: German police investigate video of boy being taken away from family
- Rumor Scanner’s own analysis