সম্প্রতি, ভারতের ওড়িশা রাজ্যে ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য মুসলিমদের দায়ী করে একটি ছবির সাথে কয়েকটি দাবি সম্বলিত তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমনকিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)
যা দাবি করা হচ্ছে
দুর্ঘটনাস্থলের পাশের একটি স্থাপনাকে মসজিদ হিসেবে চিহ্নিত করা একটি ছবি শেয়ার করে দুর্ঘটনার পেছনে মুসলিমদের দায়ী করে দেওয়া পোস্টটিতে লেখা হয়,
“ষড়যন্ত্রের গন্ধ, বালেশ্বরে চেন্নাই গামী ট্রেনের ভয়াবহ দূর্ঘটনাটি আমার এই অবধি স্বাভাবিক মনে হয় নি! এখনো আমি কনফিন্ডেন্সলি কিছুই বলতে চাই না কারণ এটা অনেক সেনসিটিভ ইস্যু! তবে এই ঘটনায় তিনটি পয়েন্ট যুক্ত করছি–
১. দিনটি শুক্রবার ছিল!
২. বালেশ্বরে যে স্থানে ভয়াবহ ট্রেন দূর্ঘটনা হয়েছে তার পাশেই রয়েছে মায়ানমার থেকে আগত প্রায় ২ হাজার রোহিংগা মুসলিমের বাস! আপনারা ছবিতে লাল মার্ক করা দেখবেন রোহিংগাদের জন্য পাশেই তৈরী হয়েছে বৃহৎ মসজিদ!
৩. দূর্ঘটনায় আক্রান্ত ট্রেনের স্টেশন মাষ্টার ছিল মোহাম্মদ শরিফ! মানলাম এটা দূর্ঘটনায় ছিল তবে আজ ৩ দিন ধরে মোহাম্মদ শরিফ পালাতক কেন?? কিসের ভয়ে পালাতক!উত্তর খুজোন পেয়ে যাবেন!”
অর্থাৎ,এখানে পাশের স্থাপনাকে চিহ্নিত করে সেটিকে মসজিদ এবং স্টেশন মাস্টার হিসেবে মোহাম্মদ শরিফ নামের একজন মুসলিম কে দাবি করা হয়েছে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ওড়িশা সাম্প্রতিক ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলের পাশে মসজিদ হিসেবে দাবি করা স্থাপনাটি কোনো মসজিদ নয় বরং এটি একটি ইসকন মন্দির এবং ওইদিন ট্রেন দুর্ঘটনার সময়ে মোহাম্মদ শরিফ নামের কোনো মুসলিম নয় বরং এসবি মোহন্তি নামের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার উক্ত দুর্ঘটনা স্থানের নিকটবর্তী স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন।
অনুসন্ধানের শুরুতে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের ওয়েবসাইটে গত ০৩ জুন প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দুর্ঘটনাস্থলের আলোচিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।

পরবর্তীতে ভারতীয় সংবাদ পোর্টাল Newslaundry এর ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে রিপোর্টার উক্ত স্থাপনাকে মসজিদ দাবির বিষয়টিকে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে খণ্ডণ করেছেন এবং নিশ্চিত করেছেন এটি একটি ইসকন মন্দির। ভিডিওতে মন্দিরটি দেখানোর পাশাপাশি উক্ত মন্দিরের প্রমুখ এর বক্তব্যও নেয়া হয়েছে। মন্দির কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে মন্দিরটির প্রমুখ ভিডিওতে এটিকে ইসকন মন্দির বলে নিশ্চিত করার পাশাপাশি মন্দিরের ইতিহাস নিয়েও বলেছেন।

পরবর্তীতে অনুসন্ধানে ওডিশা পুলিশের ভেরিফাইড টুইটার অ্যাকাউন্টে উক্ত দাবিটির বিষয়ে গত ০৪ জুন প্রকাশিত একটি টুইট খুঁজে পাওয়া যায়। টুইটে বলা হয়, ‘এটি লক্ষ্য করা গেছে যে কিছু সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল বালাসোরের মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনাতে বাজেভাবে সাম্প্রদায়িক রঙ দিচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।’

উক্ত টুইটে ট্রেন দুর্ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় সাম্প্রদায়িক গুজব ছড়ানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারিও দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে ভারতীয় গণমাধ্যম New18 Hindi-র ইউটিউব চ্যানেলে গত ০৩ জুন প্রকাশিত উক্ত দুর্ঘটনাস্থানের একটি ড্রোন ভিডিও ফুটেজ খুঁজে পাওয়া যায়। ড্রোন ফুটেজে দুর্ঘটনাস্থলের পাশে মসজিদ দাবিকৃত স্থাপনাটি দেখা যায় এবং সেটি ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় এটি একটি মন্দির।

পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যম ISKCON ODISHA নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর উক্ত মন্দিরের একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটি থেকে জানা যায়, এটি ওডিশার বাহানাগা ইসকন মন্দির।

গুগল ম্যাপে লোকেশন সার্চ করেও রেললাইনের পাশের সেই স্থাপনাটি বাহানাগা ইসকন মন্দির হিসেবে নিশ্চিত হওয়া যায়।

পোস্টগুলোতে দ্বিতীয় আরেকটি দাবিতে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ট্রেনের স্টেশন মাষ্টার ছিল মোহাম্মদ শরিফ নামের একজন মুসলিম।

তবে ওডিশার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম KALINGA TV-র ওয়েবসাইটে গত ০৩ জুন প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দুর্ঘটনার দিন এর নিকটবর্তী স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার এসবি মোহন্তি। মোহাম্মদ শরিফ নামের কোনো স্টেশন মাস্টার উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত থাকার সত্যতা পাওয়া যায়নি।

অর্থাৎ, উপরোক্ত তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, উক্ত দাবিতে প্রচারিত তথ্যগুলো সঠিক নয়।
মূলত, গত ০২ জুন ভারতের ওড়িশা রাজ্যে একটি ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। ভারতের ওডিশা রাজ্যের ভয়াবহ এ ট্রেন দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৮০ জন নিহত এবং এক হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিষয়টিতে সাম্প্রদায়িক রঙ যোগ করে দুর্ঘটনার পাশের একটি মন্দিরকে মসজিদ এবং অমুসলিম স্টেশন মাস্টার এসবি মোহন্তির পরিবর্তে স্টেশন মাস্টার হিসেবে মোহাম্মদ শরিফ নামের একজন মুসলিমের নাম প্রচার করে উক্ত দুর্ঘটনায় মুসলিমদের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে উল্লেখ করে ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে।
সুতরাং, ভারতের ওড়িশার ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলের একটি ইসকন মন্দিরকে মসজিদ এবং ওইদিন স্টেশনের দায়িত্বে থাকা অমুসলিম ব্যক্তিকে মুসলিম দাবিতে প্রচার ‘করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Newslaundry: Ground debunked of the false communal claim
- REUTERS: Deadly Indian rail crash shifts focus from new trains to safety
- Odisha Police Verified Twitter Account: Tweet
- NEWS18 Hindi:Odisha Train Accident: Drone camera से दिखा हादसे के बाद का भयानक मंजर | Balasore News Today
- ISKCON ODISHA: BAHANAGA ISKCON TEMPLE
- Google Map: Location
- Kalinga TV: Odisha train accident: Bahanaga Assistant Station Master is on the run, case registered
- Times of India: Coromandel express accident live: Injured Coromandel Express drivers stable