সম্প্রতি ‘তাকিয়া। আমার ছোট বোন। সে সিভিল অ্যাভিয়েশন স্কুল, শাহীনবাগ, তেজগাঁও এর ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী । গত ১৯ তারিখ বাসার শিক্ষককে গেটের চাবি দিতে গিয়ে ৫ তলার ছাদ থেকে নিচে পড়ে যায়। আমাদের বাবা স্বল্প বেতনের চাকরি করে। তাকিয়া বর্তমানে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে। ওর চিকিৎসার খরচ চালানোর মতো অবস্থা বাবার নেই।’ শীর্ষক দাবিতে চিকিৎসার জন্য অর্থ চেয়ে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকার সিভিল অ্যাভিয়েশন স্কুলের শিক্ষার্থী তাকিয়া আক্তারের চিকিৎসার জন্য অর্থ চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে তাকিয়া আক্তার ২০২২ সালের অক্টোবরেই মারা যান। তবে প্রতারণার উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টসহ লেনদেনের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে তাকিয়ার নামে অর্থ চাওয়া হচ্ছে।
অনুসন্ধান যেভাবে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত পোস্টগুলোর সূত্রে জানা যায়, তাকিয়া আক্তার ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছে এবং এই হাসপাতালের ঠিকানা দেওয়া আছে 77/A পান্থপথ, ঢাকা ১২১৫।
তবে গুগল ম্যাপ অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের অবস্থান ৭৪জি/৭৫, পি-কক স্কয়ার, নিউ এয়ারপোর্ট রোড, ঢাকা১২১৫। অপরদিকে 77/A পান্থপথ, ঢাকা ১২১৫ তে এই নামের কোনো হাসপাতাল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
একইসাথে পোস্টগুলোর সূত্রে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ‘Case Summary ON 6-19-23‘ শীর্ষক একটি চিকিৎসা সম্পর্কিত নথির ছবি খুঁজে পাওয়া যায়।
এই নথির সূত্র ধরে ইউনিভার্সাল হাসপাতাল প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
তাদের কাছে হাসপাতালে এই নামে রোগী আছে কি না এই বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতাল প্রশাসন রিউমর স্ক্যানারকে জানায়, হাসপাতালটিতে বর্তমানে এই নামে কোনো রোগী নেই। তবে উক্ত নামে ইতোপূর্বে একজন রোগী ভর্তি করা হয়েছিল, পরবর্তীতে তাকে এই হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফেসবুকে দেওয়া হাসপাতালের ঠিকানাটিও ভুল বলে নিশ্চিত করে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উক্ত তথ্যের বরাতে রিউমর স্ক্যানার টিম ফেসবুকে তথ্যটি নিয়ে অধিকতর অনুসন্ধান করে। এতে দেখা যায়, অন্তত ২০২২ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকিয়া আক্তারের নামে অর্থ সাহায্য চেয়ে করা পোস্টগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে।
সেই সময় থেকে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
উক্ত পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পোস্টগুলোতে সংযুক্ত ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ‘Case Summary’ এর তারিখগুলো পরিবর্তন করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তারিখ বসানো হয়েছে।
এছাড়া সময়ে সময়ে অর্থ সহায়তার জন্য দেওয়া পোস্টগুলোতে ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার ও ব্যাংক হিসাবের নাম্বারেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।
রিউমর স্ক্যানার টিম বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানের এই পর্যায়ে সাম্প্রতিক সময়ে তাকিয়ার নামে সাহায্য চেয়ে করা পোস্টগুলোতে সংযুক্ত নাম্বারে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে পোস্টগুলোতে প্রদত্ত একটি নাম্বারে দেওয়া কল রিসিভ করার পর তাকিয়ার ব্যাপারে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হলে সাথে সাথে কলটি কেটে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এই নাম্বারসহ আরও পোস্টগুলোতে সংযুক্ত আরেকটি নাম্বারে (01833527107, 01619741760) একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও আর সংযোগ পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাকিয়া আক্তারের বাবা মুহাম্মদ তারেককে খুঁজে পাওয়া যায়।
তার কাছে তাকিয়া আক্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, বিষয়গুলো আসলে আমার ও আমার পরিবারের জন্য বিব্রতকর। তাকিয়া ২০২২ সালের অক্টোবরে মারা গেছে। তারপরও কতিপয় মানুষ প্রতারণার জন্য এভাবে সাহায্য তুলছে।
মূলত, রাজধানীর সিভিল অ্যাভিয়েশন স্কুলের ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাকিয়া আক্তার ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট বাসার ছাদ থেকে পড়ে আহত হলে তাকে রাজধানীর ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই বছরের অক্টোবরে তাকিয়া মারাও যান বলে জানান তার বাবা মুহাম্মদ তারেক। তবে তার জীবিত থাকার সময়ে আর্থিক সাহায্য চেয়ে করা পোস্টের সূত্রে ২০২২ সালের অক্টোবর পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করে আর্থিক সাহায্য চাওয়া হয়। সম্প্রতি এরই ধারাবাহিকতায় পুনরায় তাকিয়ার চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
সুতরাং, ঢাকার সিভিল অ্যাভিয়েশন স্কুলের শিক্ষার্থী তাকিয়া আক্তারের চিকিৎসার জন্য অর্থ চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক এবং মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner Own Investigation
- Contact with Universal Medical College and Hospital
- Contact with Takiya Akter’s Father