পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাপের জীবাশ্ম দাবিতে পাথর খন্ডের ছবি প্রচার

সম্প্রতি “পাওয়া গেল সবচেয়ে বড় সাপের জীবাশ্ম! হতবাক বিজ্ঞানীরা” শীর্ষক শিরোনামে কয়েকটি ছবিসহ একটি পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছবিগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাপের জীবাশ্মের  নয় বরং থাইল্যান্ডের ফু লাংকা ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত নাকা গুহা এবং লাওসের উদমসাই অঞ্চলে অবস্থিত ভিন্ন ভিন্ন পাথরখন্ডের ছবিকে প্রযুক্তির সহায়তায় এডিট করে এবং একত্রিত করে পোস্টের মাধ্যমে দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে। 

দাবি পর্যালোচনা

গত ৩০ মার্চ Infobidz (আর্কাইভ) নামক একটি ফেসবুক পেইজ থেকে “পাওয়া গেল সবচেয়ে বড় সাপের জীবাশ্ম! হতবাক বিজ্ঞানীরা।” শীর্ষক শিরোনামে ছবি সহ পোস্টটি পাওয়া যায়। পোস্টটির সাথে একটি সংবাদের লিংক-ও জুড়ে দেওয়া হয়। 

Image: Facebook

পরবর্তীতে সংবাদের লিংকে ক্লিক (আর্কাইভ) করলে দেখা যায়, নিউজটির প্রথমদিকে বলা হয়েছেঃ “থাইল্যান্ডের বুয়েংকান প্রদেশের বুয়েং খং জেলায় অবস্থিত নাকা গুহার একটি পাথর ঠিক সর্পাকৃতির মতো দেখতে। পাথরের গা সাপের খোলসের মতো এবং পাথরের মুখটি দেখতে হুবুহু সাপের মতো। কিন্তু একটু পরেই আবার বলা হচ্ছে একটি সাপ কয়েক মিলিয়ন কয়েক মিলিয়ন বছর সেখানে ক্ষুদার্ত থেকে এরপর সে সেখানেই মারা যায়।”

আবার নিউজের প্রথম প্যারাগুলোতে উক্ত পাথরগুলো থাইল্যান্ডের নাকা গুহায় অবস্থিত বলা হলেও সর্বশেষ অনুচ্ছেদ-এ আবার খনিজ সম্পদ বিভাগের গবেষকদের একটি দল থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুড়ি প্রদেশে একটি চুনা পাথরের গুহায় খুঁজে পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ২৬ ফুট দৈর্ঘ্য, ১৫০০পাউন্ড ওজন এবং ৭০ মিলিয়ন বছর পুরোনো সাপের ফসিল দাবি করা হয়।

আবার নিউজের প্রথম প্যারাগুলোতে উক্ত পাথরগুলো থাইল্যান্ডের নাকা গুহায় অবস্থিত বলা হলেও সর্বশেষ অনুচ্ছেদ-এ আবার খনিজ সম্পদ বিভাগের গবেষকদের একটি দল থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুড়ি প্রদেশে একটি চুনা পাথরের গুহায় খুঁজে পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ২৬ ফুট দৈর্ঘ্য, ১৫০০পাউন্ড ওজন এবং ৭০ মিলিয়ন বছর পুরোনো সাপের ফসিল দাবি করা হয়। 

ছবি অনুসন্ধান

তবে উক্ত নিউজটিতে যেহুতু একই সাথে দুইটি স্থানের নাম দিয়ে সাপের ন্যায় দেখতে পাথরকে জীবাশ্ম দাবিতে প্রচার করা হয়েছে তাই এই দুটি স্থান সম্পর্কেই আলাদা আলাদা অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম।

Collage by Rumorscanner

প্রথমত, ভাইরাল হওয়া ফেসবুক পোস্টটিতে থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশে ৭০ মিলিয়ন বছর পুরোনো জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে বলা হলে সেটিতে কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের উল্লেখ করা হয়নি এবং বিস্তর অনুসন্ধান করেও কোনো গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যমে এবং বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট থেকে উক্ত বিষটি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি।  

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, থাইল্যান্ডে বুয়েং কান (Bueng kan) প্রদেশের ফু লাংকা ন্যাশনাল পার্কে ‘নাকা’ নামের একটি গুহা রয়েছে যেই গুহার পাথর খন্ডগুলো দেখতে অনেকটা সাপের আঁশের মতো। 

প্রচারিত ছবিগুলোর রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে কয়েকটি ছবিতে ফটগ্রাফারের নাম পাওয়া যায়। নাম ধরে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধান করে টুইটারে কয়েকটি ছবিসহ একটি টুইট পাওয়া যায়। টুইটের ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়তকা “Beungkan #Tham Naka Buengkan #Phu Langka চমৎকার এই চিত্রগুলি দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। এবং সবগুলো ছবি আমার তোলা, আপনি যদি এটি ব্যবহার করতে চান, অনুগ্রহ করে ফটোগ্রাফারকেও ক্রেডিট দিন।” এখানে হ্যাশট্যাগে নাকা সহ যেসকল নাম ব্যবহার করা হয়েছে তা থাইল্যান্ডের নাকা গুহার সাথে সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ এই ছবিগুলো নাকা গুহার।

Screenshot: Twitter/OrdSrikaew

অনুসন্ধানে দেখা যায়, দাবির ছবিগুলোর সাথে সাপের মাথার মতো পুরোপুরি নয় তবে অনেকটা সেরকম দেখতে যে ছবিটা প্রচার করা হচ্ছে সেটিও থাইল্যান্ডের নাকা গুহার।

Screenshot: www.infobidz.in

ছবিটি থাইল্যান্ডের নাকা গুহায় অবস্থিত হওয়ার স্বপক্ষে কিছু প্রমাণ দেখুন এখানে, এখানে

প্রায় হুবহু সাপের মাথার মতো দেখতে ছবিটি কোন জায়গার
Image: Internet

থাইল্যান্ডের নাকাগুহা সম্পর্কে বিস্তর অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ভ্রমণ বিষয়ক সাইট Journeying The Globe নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর “Naka Cave, Thailand: The Truth Behind the Legends of Snake Rock” শীর্ষক শিরোনামের একটি আর্টিকেল খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত আর্টিকেল উল্লেখ করা হয়েছে, নাকা গুহা (বা নাগা গুহা) থাইল্যান্ডের বুয়েং কান প্রদেশের, ‘বুয়েং খং লং’ জেলার ফু লাংকা জাতীয় উদ্যানে অবস্থিত। থাই ভাষায় নাকা মানে ‘সাপ’, এবং গুহাটির নাম হয়েছে এলাকার কিছু পাথরের গঠন থেকে, যা দেখতে সাপের আঁশযুক্ত চামড়ার মতো।

তাছাড়া আরো উল্লেখ করা হয়েছে, “সাম্প্রতিক সময়ে সাপের মাথার মতো দেখতে একটি বিশাল আকৃতির পাথর নাকা গুহার নামে প্রচারিত হচ্ছে, কিন্তু এটি প্রকৃতপক্ষে একটি ভিন্ন শিলার ছবি যা নাকা গুহায় নয় বরং থাইল্যান্ডের রাচাবুরি প্রদেশ থেকে দশ কিলোমিটার দূরে লাওসের (পার্শ্ববর্তী দেশ) একটি মরু অঞ্চলে অবস্থিত।” 

Screenshot Source: Journeying The Globe

এছাড়াও, বিজ্ঞান বিষয়ক সাইট Scienceinfo.net নামের একটি বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইটে প্রাদেশিক জনসংযোগ বিভাগের বরাতে একই কথা বলা হয় হয় যে, সাপের মাথায় ন্যায় দেখতে পাথরটি লাওসের উদমসাই অঞ্চলে অবস্থিত এবং সাপের আঁশের মতো (শরীরের মতো দেখতে অংশ) দেখতে নাগাগুহার পাথরখন্ডগুলো মূলত থাইল্যান্ডের বুয়েং কান প্রদেশের, বুয়েং লং জেলার ‘ফু লাংকা জাতীয় উদ্যান’-এ অবস্থিত। 

Screenshot Source: Scienceinfo.net

পরবর্তীতে সাপের মাথার ন্যায়, দেখতে এই পাথর খন্ডটি আসলেই লাওসে অবস্থিত নাকি থাইল্যান্ডের নাকা গুহায় সে ব্যাপারে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য কি-ওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতি ব্যাবহার করে থাইল্যান্ডের মূলধারার গণমাধ্যম MGR Online (Manager Daily 360 Degree) এর অনলাইন সংস্করণে ২০২০ সালের ২৮ মে প্রকাশিত “থাইল্যান্ডের পাত্তানিতেও একটি ‘সাপের মাথার মতো দেখতে পাথর’ রয়েছে। নেটিজেনরা লাওসের পাথরের ছবি “নাকা গুহা”র ছবি হিসেবে শেয়ার করেছে” (ভাবানুবাদ) শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot Source: MGR Online

উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “ইন্টারনেটে ‘Snake Head Rock’ নামের যে পাথরখন্ডটি নাকা গুহায় অবস্থিত বলে প্রচারিত হয়ে আসছে তা মূলত থাইল্যান্ড নয় বরং লাওসের (Lao PDR) উদমসাই প্রদেশে পাওয়া গিয়েছে। মূলত দুইটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানের ছবি একই সাথে প্রচার করা হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে থাইল্যান্ডের ‘বুয়েং কান পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্ট’।”

Screenshot Source: MGR Online (অনূদিত)

তাছাড়া, উপরের ছবিটি ব্যবহার করে ২৭ মে ২০২০ তারিখে থাইল্যান্ডের এফএম রেডিও FM91 Trafficpro এর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ কর্তৃক করা একটি পোস্টেও ‘বুয়েং কান পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্ট’ এর বরাতে বলা হয়েছে, সাপের মাথার ন্যায় দেখতে পাথর খন্ডটি লাওস (Lao PDR) এর উদমসাই প্রদেশে অবস্থিত। পরবর্তীতে তাদের ভেরিফাইড পেজে মেসেজ করলে-এ তারা বিষয়টি রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছে। 

 Screenshot from Facebook

তাছাড়া, প্রাসঙ্গিক কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে জানা যায়, ২০২০ সালের দিকে বেশকিছু আইডি থেকে সাপের মাথার ন্যায় দেখতে পাথর খন্ডটিকে থাইল্যান্ডের নাকা গুহায় পাওয়া গিয়েছে দাবিতে প্রচার করা হলে, ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা HoaxEye তাদের টুইটা অ্যাকাউন্ট থেকে উক্ত দাবিটিকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে টুইট করেছে এবং বলা হয়েছে ছবিটি থাইল্যান্ডের নাকা গুহায় নয় বরং লাওসে অবস্থিত। 

Screenshot from Twitter 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাওসের Just Go Out ທ່ຽວໃສກະໄດ້ নামক একটি পেজ থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সময়ে আলোচিত পাথরটির পাঁচটি ছবি আপ্লোড করা হয়েছে। এই পোস্টে ফেসবুকের লোকেশন হিসেবেও লাওস এর নাম দেখা যাচ্ছে। 

Screenshot: Facebook/Just Go Out ທ່ຽວໃສກະໄດ້

ছবি পাঁচটির একটি’র পোস্ট দেখুন এখানে

এছাড়াও, “Oudomxay ລົດເຊົ່າ-ພາທ່ຽວ” নামক লাওসের একটি ট্যুর এজেন্ট তাদের ফেসবুক পোস্টেও এই পাথরের ছবি প্রকাশ করেছে। পোস্টটি দেখুন এখানে। পরবর্তীতে ইন্সট্যান্ট মেসেজিং সার্ভিস হোয়াটসএপ এর মাধ্যমে তাদের কাছে জানতে চাইলে আলোচিত পাথরটি লাওসের বলে নিশ্চিত করেছেন।

Screenshot: Facebook/Oudomxay ລົດເຊົ່າ-ພາທ່ຽວ

অর্থাৎ, থাইল্যান্ডের ফু লাংকা ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত নাকাগুহা এবং লাওসের উদমসাই অঞ্চলে অবস্থিত অবস্থিত ভিন্ন ভিন্ন পাথরখন্ডের ছবিকে একত্রিত করে বিশ্বে সবচাইতে বড় সাপের ফসিল দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ভাইরাল হওয়া ফেসবুক পোস্টে সাপের মাথার ন্যায় যে ছবিটি ব্যাবহার করা হচ্ছে সেটি লাওসে অবস্থিত এবং সাপের আঁশের মতো দেখতে পাথরখন্ডগুলো মূলত থাইল্যান্ডের বুয়েং কান প্রদেশের, বুয়েং লং জেলার ‘ফু লাংকা জাতীয় উদ্যান’ এর নাকা গুহায় অবস্থিত অবস্থিত।

Image Collage: Rumor Scanner 
থাইল্যান্ডে কি প্রায় হুবহু সাপের মাথার মতো দেখতে পাথর আছে 

অনুসন্ধান অনুযায়ী থাইল্যান্ডেও প্রায় হুবহু সাপের মাথার মতো দেখতে পাথর আছে। তবে আলোচিত লাওসের পাথরটি এবং থাইল্যান্ডের পাথরটি দেখতে মোটেও একইরকম নয়। ইতোপূর্বে উল্লিখিত MGR Online এর প্রতিবেদনে এই বিষয়ে ধারণা দেওয়া আছে।

Screenshot: MGR Online

এছাড়াও “thailandtourismdirectory” সহ আরো বেশকিছু উল্লেখযোগ্য সাইটে অনেকটা সাপের মাথার মতো দেখতে ভিন্ন এই পাথরটিকে থাইল্যান্ডের পাত্তানি প্রদেশের সাই খাও ওয়াটারফল ন্যাশনাল পার্ক এ অবস্থিত হিসেবে উল্লেখ করেছে। দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। 

Collage: Rumorscanner

আলোচিত লাওসের পাথর খন্ড ও থাইল্যান্ডের পাথর খন্ডের পার্থক্য দেখুন নিচের ছবিতে

Collage: Rumorscanner
নাগা গুহায় সাপের আঁশের মতো দেখতে পাথরগুলো কি কোনো সাপের জীবাশ্ম?

থাইল্যান্ডের নাকা গুহায় সাপের আঁশের মতো দেখতে পাথরগুলো কি আসলেই কোনো সাপের জীবাশ্ম কিনা সে ব্যাপারে বিস্তারিত অনুসন্ধানে থাইল্যান্ডের ভ্রমণ বিষয়ক ওয়েবসাইট Thai Guider কর্তৃক  “Naka Cave Thailand Guide: Myths, Truths & Visit Details” শিরোনামে প্রকাশিত একটি আর্টিকেল খুঁজে পাওয়া যায়।

উক্ত আর্টিকেলে উল্লেখ করা হয়েছে, “যেহেতু পাথরগুলো বিশালাকার মতো দেখতে ফলে স্থানীয় লোকেরা বিশ্বাস করে যে পাথরগুলো “নাগা মিথ” এর সাথে সম্পর্কিত এবং কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে এটি আসলে লোককাহিনীর প্রাচীন সাপের দেহাবশেষ। যাইহোক, এটি কোনো আসল সাপ বা জীবাশ্ম সাপ নয়।

উক্ত আর্টিকেলে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, এখন পর্যন্ত বিবেচনা করা হয় যে বিশ্বের ওজনের দিক থেকে সবচেয়ে ভারী এবং বড় সাপটি রেকর্ড করা হয়েছে ৮.৪৩ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১.১১ মিটার চওড়া। অতএব, এই গুহাগুলির পাথরগুলি কোনো দৈত্যাকার ক্ষুধার্ত সাপ হতে পারে না। 

যদিও কেউ কেউ মনে করেন যে, মানুষ নিজে এই শিলাগুলি তৈরি করেছে এবং সাপের আঁশের মতো আকৃতির পাথরগুলো মূলত নাগার লোককাহিনী অনুসারে খোদাই করা হয়েছে। যাইহোক, যদি সাপের আঁশের মতো দেখতে শিলার প্যাটার্নটি খুব সাবধানে বিবেচনা করা হয়ে, তাহলে বুঝা যায় যে এটি মানুষের তৈরি নয়।”

Screenshot Source: Thai Guider

পরবর্তীতে থাইল্যান্ডের নাকা গুহার পাথর খন্ডগুলোর গঠন সম্পর্কে আরো বিস্তর অনুসন্ধানে, থাইল্যান্ডের মূলধারার গণমাধ্যম Bangkok Post কর্তৃক “Naga Cave closed indefinitely after being defaced by visitor” শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ফু লাংকা জাতীয় উদ্যান কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুসারে সাপের আঁশের মতো দেখতে এই পাথরখন্ডগুলো মূলত ১লক্ষ বছরের পুরোনো এবং দীর্ঘকাল ধরে সূর্যের তাপের পরিবর্তনের ফলে ক্ষয়ে যাওয়া এবং পানির প্রবাহের কারণে ক্ষয়কৃত এই পাথরগুলো এরকম সাপের আঁশের আকৃতি ধারণ করেছে। 

Screenshot Source: Bangkok Post

এছাড়া এশিয়া মহাদেশকেন্দ্রিক ভ্রমণ বিষয়ক সাইট’Travel News Asia’ কর্তৃক “Thailand to close Phu Langka National Park & Naka Cave” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও ফু লাংকা ন্যাশনাল পার্ক কর্তৃপক্ষের বরাতে একই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে রয়েছে।  

Screenshot Source: Travel News Asia

তাছাড়া, নাকা গুহার পাথরখন্ডগুলোর ভৌত গঠন সম্পর্কে আরো বিস্তর অনুসন্ধানে, থাইল্যান্ডের মূলধারার নিউজপোর্টাল MGR Online কর্তৃক “Ajarn Chet” reveals the answer to the source of the stone patterned with snake scales in Naka Cave. Geologically, this phenomenon is known as “sun cracking” শিরোনামে (অনুবাদিত) প্রকাশিত একটি আর্টিকেল খুঁজে পাওয়া যায়। 

থাইল্যান্ডের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় Chulalongkorn University এর বিজ্ঞান অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ‘Jessada Denduangboribhand’ এর বরাতে লেখা উক্ত আর্টিকেলে বলা হয়, “বুয়েং কান প্রদেশের বুয়েং খং লং জেলার নাকা গুহায় পাথরের গঠন দেখতে বিশাল সাপের দেহ মনে হলেও  ভূতাত্ত্বিকভাবে, একে সানক্র্যাক বলা হয়।

মূলত দিনের বেলা তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় এবং রাতের বেলায় তাপমাত্রা তুলনামূল কম থাকে। আর তাপমাত্রার এই দ্রুত পরিবর্তনের কারণে, শিলাটি ক্রমাগত প্রসারিত এবং সংকুচিত হতে থাকে যতক্ষণ না এই শিলাগুলো ভেঙে বহুভূজ আকৃতি ধারণ করে। 

Screenshot Source: MGR Online (Translated)

পরবর্তীতে জলের স্রোত এবং বৃষ্টির পানির দ্বারা মূল শিলাস্তরটি আনুভূমিক এবং উলম্ভ বরাবর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে উপরের দিকে সমান্তরাল বালিশের স্তুপের মতো দেখতে গঠন তৈরী করে। 

সাধারণত কেউ তার একন্ত ব্যাক্তিগত বিশ্বাস এবং দৃষ্টিকোণ থেকে সান-ক্র‍্যাকের মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া শিলাগুলোকে সাপের আঁশ কিংবা সাপের মাথা হিসেবে কল্পনা করে সেটি কেবলমাত্র একটি কাকতালীয় ব্যাপার। Chulalongkorn University এর বিজ্ঞান অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ‘Jessada Denduangboribhand’ এর মূল ফেসবুক পোস্টটি দেখুন এখানে

এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচাইতে বড় সাপের জীবাশ্ম কোনটি? 

‘Natural History Museum’ এর তথ্যমতে বর্তমান সময়ে জীবিত সাপের প্রজাতিগুলোর মধ্যে দৈহিক উচ্চতার দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচাইতে বড় আকৃতির সাপ হচ্ছে Reticulated Python যা সচরাচর ৬.২৫ মিটার লম্বা হয়। এবং এই প্রজাতির সবচাইতে বড় সাপটি পাওয়া গিয়েছিলো ১৯১২ সালে এবং এটির উচ্চতা ছিলো রেকর্ড ১০ মিটার। 

Screenshot Source: Natural History Museum

তাছাড়া একই ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বর্তমান সময়ে ওজনের দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী সাপ হচ্ছে সবুজ অ্যানাকন্ডা। এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচাইতে ভারী সাপটির ওজন ছিলো ২২৭ কেজি এবং এই সবুজ এনাকন্ডাটি ছিলো ৮.৪৩ মিটার লম্বা এবং ১.১১ মিটার চওড়া। 

Screenshot Source: Natural History Museum

তবে এগুলো ছিলো বর্তমান সময়ে বিদ্যমান জীবিত প্রজাতিগুলোর রেকর্ড। যদি বর্তমানকালে বিদ্যমান সাপের প্রজাতিগুলো ছাড়াও প্রাগৈতিহাসিক কালের প্রজাতি (যেগুলো বর্তমানে বিলুপ্ত) হিসেব করা হয় তাহলে এখন পর্যন্ত পাওয়া পৃথিবীর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় আকারের সাপটি হচ্ছে টাইটানো বোয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা National Science Foundation এর তথ্যমতে, এই সাপের যে জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছিলো সেটির উচ্চতা ছিলো ১৩ মিটার (৪২.৭ ফুট) এবং ধারণা করা হয় যে সাপটি ওজনে ছিলো ১১৪০ কেজি (২৫০০ পাউন্ড)।

Screenshot Source: National Science Foundation
নাকা গুহার ব্যাপারে প্রচলিত লোককথা

থাইল্যান্ডের ভ্রমণ বিষয়ক ওয়েবসাইট Thai Guider কর্তৃক  “Naka Cave Thailand Guide: Myths, Truths & Visit Details” শিরোনামে প্রকাশিত আর্টিকেলে বলা হয়, থাইল্যান্ডের মধ্যে সবচেয়ে কম পরিদর্শন করা এলাকাগুলির মধ্যে একটি এই দেশের উত্তর-পূর্বাংশ। এই অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক পর্যটকদের মধ্যে সর্বজনীনভাবে জনপ্রিয় না হলেও এটি প্রচুর ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যগতভাবে আঁশীর্বাদপূর্ণ। বিশেষ করে এই স্থানের সবচাইতে অসামান্য সাংস্কৃতিক প্রতীক হল “ফ্রায়নাক” বা “নাগা।”

উক্ত আর্টিকেলে আরো বলা হয় যে, নাগা’র লোককথা এতটাই শক্তিশালী যে থাইল্যান্ডের সংস্কৃতির একটা বিশাল অংশ এই লোককথার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। নাকা” বা “নাগা” হল থাইল্যান্ড, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশ এবং ভারতের পৌরাণিক সাপের পবিত্র নাম।

থাইল্যান্ডে অবস্থিত নাকা গুহা এবং অন্যান্য সর্প গুহাগুলির সম্পর্কে ৭ টি পৌরাণিক কাহিনী বা লোককাহিনী (একটি ঐতিহ্যগত গল্প যা ধর্মের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত) প্রচলিত রয়েছে। তবে এই লোককাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে নাগার পৌরাণিক কাহিনী যেখানে একটি সাপ অভিশপ্ত হয়ে পাথরে পরিণত হওয়ার বর্ণণা পাওয়া যায়। 

‘পু আউ লু’ এর পৌরাণিক কাহিনী বা অনুসারে, বিশ্বাস করা হয় যে এটি সাপ এবং মানুষের মধ্যে অসম্ভব প্রেমের সূচনা হয়েছিল এবং মানুষ এবং সাপের মধ্যে সৃষ্ট এই ভালোভাসার কারণে ‘ফ্রা লু রাচা’ শাসিত রত্ন নাখোন শহর ধ্বংসের কারণ হয়েছিল।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, বহুকাল আগে ফ্রা লু রাচা (Phra Lue Racha) নামের একজন রাজা ছিলো। এই রাজার নাতির নাম ছিলো প্রিন্স  ফাহ্ রুং (Fah Rung) যে পানির নিচের শহরের রাজা ফ্রায়া নাগা রাচা (Phraya Naga Racha) এর কন্যা রাজকুমারী নক্রিন্থরানিকে (Nakrinthranee) বিয়ে করেছিলেন। পরবর্তীতে বিয়ের পর রাজকুমারী নক্রিন্থরানি একটি মানব রূপে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। কিন্তু তারা কোনো সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি।

পরে রাজকুমারী নক্রিন্তরানি অসুস্থ হয়ে পড়েন, যার ফলে তার শরীর আবার সর্পকন্যার মতো হয়ে যায়। যদিও তারা দুজনে একসাথে থাকতেন কিন্তু কোন সন্তান জন্ম দিতে না পারায় রাজা ফ্রা লুয়ে রাচা (Phra Lue Racha) এবং তার শহর রত্ন নাখোনের লোকেরা অসন্তুষ্ট হয়ে সর্প রাজকন্যা নক্রিন্থরানিকে পানির নিচের শহরে পাঠিয়ে দেয়। এতে করে সাপের রাজা ফ্রায়া নাগারত (Phraya Naga Racha) অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে রত্ন নাখোন শহর ধ্বংস করে দিল। পরবর্তীতে মানব রাজা ফ্রা লু রাচা (Phraya Naga Racha) ধরা পড়েছিল এবং পাথরের সাপ হিসেবে অভিশপ্ত হয়েছিল (গুহার প্রবেশ মুখে) ফু লঙ্কা বা মেকং নদীকে রক্ষা করার জন্য।

Screenshot Source: Thai Guider

মূলত, থাইল্যান্ডের ফু লাংকা ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত ‘নাকা গুহা’ এবং লাওসের উদমসাই অঞ্চলে অবস্থিত অনেকটা সাপের মাথা ও শরীরের মতো দেখতে ভিন্ন ভিন্ন পাথরখন্ডের ছবিকে একত্রিত করে বিশ্বের সবচাইতে বড় সাপের ফসিল দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। যদিও সেখানকার স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে, একটি বিশাল আকারের সাপ অভিশাপের কারণে পাথর হয়ে গিয়েছে, তবে সেটি কেবলমাত্র মিথ এবং এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে এই পাথর খন্ডগুলো কোনো সাপের জীবাশ্ম নয় বরং বিভিন্ন প্রকৃতিক কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এরা সাপের আঁশের মতো আকৃতি লাভ করেছে।

সুতরাং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুটি ভিন্ন দেশের পাথর খন্ডের ছবিকে একত্রিত করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাপের জীবাশ্ম দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img