সম্প্রতি ‘বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আসামি আশিকুল ইসলাম বিটু ক্লাসে যোগ দেওয়ায় বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ’ শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।

গণমাধ্যমে প্রচারিত এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন ইউএনবি (ইংরেজি), ইউএনবি (বাংলা), ভয়েজ অব আমেরিকা, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, নিউ এইজ, সমকাল, দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, আজকের পত্রিকা, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ঢাকা ট্রিবিউন, যায়যায়দিন, কালবেলা, নয়া দিগন্ত, দৈনিক আমাদের সময়, পূর্ব পশ্চিম বিডি, বাংলাদেশ টাইমস, দৈনিক শিক্ষা।

একই বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনামে আশিকুল ইসলাম বিটুকে আবরার হত্যার ‘আসামি’ উল্লেখ করেছে দেশ টিভি ও ডেইলি ম্যাসেঞ্জার।

গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ), পোস্ট (আর্কাইভ)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) বিটুকে খুনের মামলার আসামী উল্লেখ করে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়। বিজ্ঞপ্তিটি দেখুন:

এই বিজ্ঞপ্তিটি বিএনপির মিডিয়া সেলের ভ্যারিফায়েড ফেসবুক পেজে ‘বুয়েটে খুনের মামলার আসামি যাওয়াটা নিন্দনীয়’ শীর্ষক শিরোনামে প্রচারও করা হয়। এ সম্পর্কিত পোস্টটি দেখুন এখানে।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় আবরারের বাবার দায়েরকৃত মামলা এবং মামলার চার্জশিটে আশিকুল ইসলাম বিটুর নাম নেই। প্রকৃতপক্ষে আশিকুল ইসলাম বিটুকে আবরার ফাহাদ হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছিল। তবে বিটুর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত বুয়েট কর্তৃপক্ষের বহিষ্কারাদেশ স্থগিত করেন।
আবরার ফাহাদ হত্যায় তার বাবার দায়েরকৃত মামলায় বিটুর নাম নেই
কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর ‘আবরার হত্যার ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে মামলা’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে রাজধানীর চকবাজার থানায় তার বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।
তবে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখিত এই ১৯ আসামির বিস্তারিত নাম, পরিচয় বিশ্লেষণ করে আশিকুল ইসলাম বিটুর নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৯ আসামির বিস্তারিত পরিচয় দেখুন এখানে।
এছাড়া এই ১৯ জনকে সেই সময় বুয়েট থেকে সাময়িক বহিষ্কারও করা হয়।
পুলিশের চার্জশিটেও নেই বিটুর নাম
অনুসন্ধানের এ পর্যায়ে রিউমর স্ক্যানার টিম আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে পাওয়া পুলিশের দাখিলকৃত চার্জশিটটিতে উল্লেখিত আসামিদের নাম যাচাই করে দেখে।
এ নিয়ে জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর ‘আবরার হত্যা মামলার চার্জশিট, ছাত্রলীগের নেতাসহ আসামি ২৫’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে শিবির সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ২৫ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এই ২৫ জনের নাম যাচাই করেও সেখানে আশিকুল ইসলাম বিটুর নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।

একইভাবে সংবাদ ভিত্তিক টিভি চ্যানেল ডিবিসি নিউজের ওয়েবসাইটে একইদিনে ‘বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা মামলার চার্জশিট আদালতে, জড়িত ২৫’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে একই ব্যক্তিদের নাম খুঁজে পাওয়া যায়।

এই চার্জশিট নিয়ে অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন আবরার হত্যা মামলার চার্জশিট গৃহীত (বার্তা২৪)।
বিটুর বহিষ্কারের বিষয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষ যা জানায়
রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানের এ পর্যায়ে আশিকুল ইসলাম বিটুকে কেন বুয়েট থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এ নিয়ে অনুসন্ধান করে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের মাধ্যমে বুয়েটের বোর্ড অব রেসিডেন্ট অ্যান্ড ডিসিপ্লিনের সদস্য সচিব ও ছাত্র কল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান খান কর্তৃক স্বাক্ষরিত ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বরে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় ২৬ জনকে বুয়েট থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৫ জন পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র অনুযায়ী অভিযুক্ত। যাদের নাম ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বুয়েটের ২৬ শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কার (সময়ের আলো), বুয়েটের ২৬ শিক্ষার্থী আজীবন বহিষ্কার (বাংলা ট্রিবিউন) সূত্রেও নিশ্চিত হওয়া যায় যে, আশিকুল ইসলাম বিটুর নাম পুলিশের অভিযোগপত্রে ছিল না।

বর্তমানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিটুর বিষয়ে যা বলছে
সম্প্রতি আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী আশিকুল ইসলাম (বিটু) ক্লাসে ফিরেন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে গত ০৯ আগস্ট ক্লাস বর্জন ও মানববন্ধন করেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা আবরার ফাহাদ হত্যার তদন্তে অসহযোগিতা এবং র্যাগিংয়ের ঘটনায় বুয়েটের আজীবন বহিষ্কৃত ছাত্র আশিকুল ইসলাম বিটুর ক্লাসে ফেরার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। এরকম একজনের সঙ্গে ক্লাস এবং ক্যাম্পাস শেয়ার করতে আমরা কোনোভাবেই রাজি নই।’

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, আবরারের বাবার মামলা ও পুলিশের দাখিলকৃত চার্জশিটে আশিকুল ইসলাম বিটুর নাম নেই। তবে বুয়েট কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে তাকে চার্জশিটভুক্ত ২৫ আসামির সাথে বহিষ্কার করে। যদিও বুয়েট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো কিছু জানায়নি বহিষ্কার আদেশে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালেও আশিকুল ইসলাম বিটু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাসে অংশ নিলে এর প্রতিবাদে বুয়েট ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা।
সেসময়ও বিটুকে আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় আসামি হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে একাধিক গণমাধ্যম। এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন রাইজিং বিডি, বাংলাদেশ জার্নাল, বাংলা ট্রিবিউন, ডেইলি ক্যাম্পাস, বাংলা নিউজ২৪।

আবরার হত্যা মামলায় বিটুকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি উল্লেখ করে গণমাধ্যমে ভুল প্রতিবেদন
২০২১ সালে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ে আশিকুল ইসলাম বিটুকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি উল্লেখ করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন ঢাকা প্রকাশ।

আবরার হত্যার ঘটনায় আশিকুল ইসলাম বিটুকে আটক ও রিমান্ডে নেওয়ার ভুল দাবি গণমাধ্যমে
বিটুর বিষয়ে অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে ২০১৯ সালের কতিপয় গণমাধ্যমের এমন কিছু প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায় যেগুলোতে দাবি করা হয়, আবরার হত্যার ঘটনায় আশিকুল ইসলাম বিটুকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। সে সময়ে প্রকাশিত এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন নিউজ২৪, মানবজমিন, বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা ট্রিবিউন, যমুনা টিভি, একুশে টিভি, যুগান্তর, বণিক বার্তা, ইত্তেফাক, আরটিভি, রাইজিং বিডি, সময়ের আলো, বিডি মর্নিং, ডেইলি জাগরণ, বিবার্তা, সাম্প্রতিক দেশকাল, প্রতিদিনের সংবাদ।
তবে দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে দেখা যায়, সে সময় আবরার ফাহাদ হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে যাদেরকে আটক ও রিমান্ডে নেওয়া হয় সেখানে আশিকুল ইসলাম বিটুর নাম নেই। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন আবরার হত্যা: ১০ আসামি পাঁচদিনের রিমান্ডে।

পাশপাশি আশিকুল ইসলাম বিটুর পরিবারও রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেন যে, সে সময়ে বিটুকে আটক ও রিমান্ডে নেওয়া হয়নি।
আশিকুল ইসলাম বিটুর পরিবার যা বলছে
সার্বিক বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম আশিকুল ইসলাম বিটুর ভাই ওয়াসিউল ইসলাম ডিটুর সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, ২০১৯ সালে বেশ কিছু মিডিয়ায় তার ভাইয়ের আটক ও রিমান্ডের বিষয়ে খবর প্রচার করা হলেও সে সময়ে এমন কিছু ঘটেনি। বরং সে সময় তার ভাই পাবনাতে পরিবারের সাথেই অবস্থান করছিলেন।
মূলত, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যায় অভিযুক্ত হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী বহিষ্কারাদেশের বিরুদ্ধে আশিকুল ইসলাম বিটুর করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বুয়েট কর্তৃপক্ষের বহিষ্কারাদেশ স্থগিত করেন। সেই স্থগিতাদেশ নিয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল তাকে ক্লাসে ফেরার অনুমতি দেয়। সে বছরের ২২ মে তিনি অনলাইন ক্লাসে অংশ নিলে শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় তিনি আর ক্লাসে আসেননি। তবে সম্প্রতি তিনি পুনরায় ক্লাসে আসলে বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও নতুন করে প্রতিবাদে নামে। এরই প্রেক্ষিতে দেশীয় গণমাধ্যমে আশিকুল ইসলাম বিটুকে আবরার হত্যা মামলার আসামি হিসেবে উল্লেখ করে সংবাদ প্রচার করা হয়। তবে নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, আবরারের বাবার মামলা ও পুলিশের দাখিলকৃত চার্জশিটে আসামি হিসেবে আশিকুল ইসলাম বিটুর নাম নেই।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর ভোরে বুয়েটের শেরে বাংলা হল থেকে ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী ৬ অক্টোবর রাতে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে বলে সেসময় অভিযোগ ওঠে। আবরার ফাহাদের বাবা এই ঘটনায় একটি হত্যা মামলা করেন। এই হত্যা মামলাতেই ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এক ২০২১ সালে ২০ আসামির মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তারপরই আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স আসে হাইকোর্টে, অন্যদিকে খালাস চেয়ে আপিল করেন আসামিরা। তবে এখনো এই বিষয়ে আপিলের শুনানি শুরু হয়নি।
সুতরাং, আশিকুল ইসলাম বিটুকে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আসামি দাবি করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Bangla Tribune: আবরার হত্যার ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে মামলা
- Rising BD: আবরার হত্যাঃ ১৯ ছাত্র সাময়িক বহিষ্কার
- Ittefaq: আবরার হত্যা মামলার চার্জশিট, ছাত্রলীগের নেতাসহ আসামি ২৫
- DBC News: বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা মামলার চার্জশিট আদালতে, জড়িত ২৫
- Barta24: আবরার হত্যা মামলার চার্জশিট গৃহীত
- Somoyer Alo: বুয়েটের ২৬ শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কার
- Bangla Tribune: বুয়েটের ২৬ শিক্ষার্থী আজীবন বহিষ্কার
- Desh Rupantor: আবরার হত্যায় বহিষ্কৃতের ফেরার প্রতিবাদে ক্লাস বর্জন