ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার পরিসংখ্যানগুলো কতটুকু সত্য?

সম্প্রতি “কেন ব্রাজিল করি??” শীর্ষক শিরোনামে কিছু তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে। 
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

তথ্যগুলোতে দাবি করা হচ্ছে:

১. ব্রাজিল বিশ্বকাপ খেলছে ২০ বার, আর আর্জেন্টিনা ১৬ বার।
২. ব্রাজিল ফাইনাল খেলছে ৭ বার, আর আর্জেন্টিনা খেলছে ৪ বার।
৩. ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতেছে ৫ বার, আর্জেন্টিনা ২ বার।
৪. ব্রাজিল যতবার ফাইনাল খেলেছে,  আর্জেন্টিনা ততবার সেমিফাইনালও খেলে নাই।
৫. ব্রাজিল একটানা দুইবার (৫৮,৬২) বিশ্বকাপ জিতেছে, একটানা তিনবার ফাইনাল খেলেছে (৯৪,৯৮,০২) 
৬. ব্রাজিলের পেলে আর রোমারিও’র ১ হাজারের বেশি  গোল করার কৃতিত্ব আছে। আর আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা ও মেসির গোল যোগ করলেও ১ হাজার হয় না।
৭. ব্রাজিলের রোনালদোর বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ১৫ গোল করার রেকর্ড আছে। আর আর্জেন্টিনার মেসি ও রোনালদোর গোল যোগ করলে হয় ৯ টা।
৮. ব্রাজিল গত ২৪ বছরে কাপ পেয়েছে ১৫ টা,আর্জেন্টিনা ১ টা পেয়েছে ২৮ বছর সাধনা করার পর।
৯. আর্জেন্টিনার ১১ গোল খাওয়ার রেকর্ড আছে।
১০. ২০১৮ সালে স্পেনের কাছে ও  ২০০৬ সালে বলিভিয়ার  কাছে ৬ গোল খেয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ, দুই দলের ফাইনালে খেলা, আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা ও মেসির গোল যোগ করলেও ১ হাজার না হওয়া, বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মেসি ও রোনালদোর মোট গোল সংখ্যা, ব্রাজিলের ২৪ বছরে  ১৫ টা কাপের বিপরীতে আর্জেন্টিনার ১ টি কাপ ও আর্জেন্টিনার ১১ গোল খাওয়ার রেকর্ডের তথ্যগুলো সঠিক নয় বরং তথ্যগুলোতে পরিসংখ্যানগত ভুল রয়েছে।

দাবি ১. ব্রাজিল বিশ্বকাপ খেলছে ২০ বার, আর আর্জেন্টিনা ১৬ বার।

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, চলতি বছর কাতারে চলমান বিশ্বকাপটি বিশ্ব ফুটবলের ২২ তম আসর।

১৯৩০ সালে শুরু হওয়া বিশ্ব ফুটবলের এই আসর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়নি। এর বাইরে ব্রাজিল বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরেই অংশগ্রহণ করেছে। অর্থাৎ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের অংশগ্রহণের সংখ্যাটি ২০ নয় বরং চলতি বিশ্বকাপ সহ ২২ বার।

অপরদিকে আর্জেন্টিনার ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, দক্ষিণ আমেরিকার এই দলটি ১৯৩৮, ১৯৫০, ১৯৫৪ ও ১৯৭০ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেনি।

এর মধ্যে ১৯৩৮, ১৯৫০, ১৯৫৪ সালে রাজনৈতিক ও বিশ্বকাপ আয়োজনের সত্ত্ব নিয়ে ঝামেলায় আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেনি। এছাড়া ১৯৭০ বিশ্বকাপে বাছাইপর্ব উৎরাতে না পারায় বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলতে পারেনি।

অর্থাৎ, এই চার বিশ্বকাপ বাদে চলতি বছরের বিশ্বকাপ সহ আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের সংখ্যা ১৮।

সুতরাং, ব্রাজিল বিশ্বকাপে ২০ বার ও  আর্জেন্টিনা ১৬ বার খেলার তথ্যটি মিথ্যা।

দাবি ২. ব্রাজিল ফাইনাল খেলেছে ৭ বার, আর্জেন্টিনা খেলেছে ৪ বার।

এই দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে দেখা যায়, ব্রাজিলের ৭ বার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার তথ্যটি সঠিক হলেও আর্জেন্টিনার ৪ বার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার তথ্যটি সঠিক নয়।

আর্জেন্টিনার ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, দলটি ১৯৩০, ১৯৭৮, ১৯৮৬, ১৯৯০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপ সহ মোট ৫ বার বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলেছে।

অর্থাৎ, আর্জেন্টিনার ৪ বার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার তথ্যটি সঠিক নয়।

দাবি ৩. ব্রাজিলের পেলে আর রোমারিও’র ১ হাজারের বেশি  গোল করার কৃতিত্ব আছে। বিপরীতে আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা ও মেসির গোল যোগ করলেও ১ হাজার হয় না।

দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে দেখা যায়, ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলেকে ফুটবলের সেরা গোলদাতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক। 

গিনেস ওয়ার্ল্ড বুকের এই স্বীকৃতি থেকে জানা যায়, ১৯৫৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের পহেলা অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালে ১ হাজার ৩৬৩ টি খেলায় ১ হাজার ২৭৯ টি গোল করেছেন। 

অপরদিকে ব্রাজিলের আরেক কিংবদন্তি ফুটবলার রোমারিও’র গোলসংখ্যা অনুসন্ধানে দেখা যায়, রোমারিও ২০০৭ সালের ২০ মে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে ভাস্কো দা গামা ক্লাবের বিপক্ষে ৪১ বছর বয়সে তার ১ হাজার তম গোলটি করেন।

যদিও তার এই অর্জনের বিপরীতে বিতর্ক রয়েছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম BBC News ও ফুটবল ভিত্তিক ওয়েবসাইট World Soccer এর ২০০৭ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা এটিকে স্বীকৃতি দেয় না৷ কারণ, ফিফা কেবল স্বীকৃত ম্যাচের গোলই বিবেচনা করে থাকে।

তবে পেলে ও রোমারিও’র এর এক হাজার গোলের বিপরীতে মেসি ও ম্যারাডোনার গোল সংখ্যা যোগ করলেও ১ হাজার হওয়ার দাবিটি সঠিক নয়।

খেলাধুলা ভিত্তিক ওয়েবসাইট ESPN এ ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর “Diego Maradona’s stats: You can’t measure genius in numbers, but here’s a try” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে গোল সংখ্যা ৩৪ টি৷

এছাড়া বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ম্যারাডোনার গোল সংখ্যা ৩১১ টি। ফলে জাতীয় দল ও ক্লাব মিলে ম্যারাডোনার মোট গোল সংখ্যা হয় ৩৪৫ টি।

অপরদিকে ডাটা ও পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট statista.com এর তথ্য মতে, জাতীয় দল ও ক্লাব ফুটবল মিলিয়ে ম্যারাডোনার মোট গোল সংখ্যা ৩৩৮ টি।

বিপরীতে লিওনেল মেসির গোল সংখ্যা অনুসন্ধানে ফুটবল ভিত্তিক ওয়েবসাইট Goal.com এর ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর “How many goals has Lionel Messi scored during his career? PSG star’s jaw-dropping stats in full” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিভিন্ন ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে মেসির মোট গোল সংখ্যা ৭৮৬ টি।

 এই গোল সংখ্যার সঙ্গে ম্যারাডোনার গোল সংখ্যা যোগ করলে তাদের দুইজনের গোল সংখ্যা ১ হাজারের বেশি পাওয়া যায়। ESPN এ প্রদত্ত ম্যারাডোনার গোল সংখ্যার  সঙ্গে মেসির গোল সংখ্যার যোগফল: ৭৮৬+৩৪৫=১১৩১ টি। statista.com এ প্রদত্ত ম্যারাডোনার গোল সংখ্যার  সঙ্গে মেসির গোল সংখ্যার যোগফল: ৭৮৬+৩৩৮=১১২৪ টি।

অর্থাৎ আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা ও মেসির গোল যোগ করলেও ১ হাজার হয় না দাবিটি মিথ্যা। 

দাবি ৪. ব্রাজিল গত ২৪ বছরে কাপ পেয়েছে ১৫ টা, আর্জেন্টিনা ১ টা পেয়েছে ২৮ বছর সাধনা করার পর

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এই দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে ২৪ বছর হিসেবে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়কাল ধরে নেওয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই সময়ে ব্রাজিল ফুটবল বিশ্বের তিনটি বড় আসর বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা ও কনফেডারেশনস কাপ মিলে মোট শিরোপা জিতেছে ৮ টি। এর মধ্যে আছে ২০০২ সালের বিশ্বকাপ, ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৭ ও ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা ও ২০০৫, ২০০৯ এবং ২০১৩ সালের কনফেডারেশনস কাপের শিরোপা। অপরদিকে এই সময়ে আর্জেন্টিনা এই সময়ের মধ্যে কেবল ২০২১ সালের কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতেছে।

অর্থাৎ, গত ২৪ বছরে ব্রাজিলের ১৫ টি কাপ জেতার দাবিটি সত্য নয়। 

দাবি ৫. ব্রাজিলের রোনালদোর বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ১৫ গোল করার রেকর্ড আছে। আর আর্জেন্টিনার মেসি ও রোনালদোর গোল যোগ করলে হয় ৯ টা।

এই দাবিটির সত্যতা অনুসন্ধানেও দেখা যায়, বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মেসি ও রোনালদোর গোল যোগ করলে তাদের গোল সংখ্যা ৯ এর বেশি হয়।

Goal.com এর ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল “How has Cristiano Ronaldo performed in World Cups?” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৪ টি বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে পর্তুগীজ তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো মোট ৭ টি গোল করেছেন।

অপরদিকে একই ওয়েবসাইটে ১৬ নভেম্বর “How many goals has Lionel Messi scored for Argentina? Albiceleste star’s full World Cup, Copa America and international friendly record” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,

মেসি ২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৪ টি বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে ১৯ ম্যাচে ৬ টি গোল করেছেন। 

এই হিসেবে মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মোট গোল সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ টি৷ 

এছাড়া বিশ্ব অলিম্পিকের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা Olympics.com এর ওয়েবসাইটে চলতি বছরের ৮ সেপ্টেম্বর “FIFA World Cup top scorers: Miroslav Klose leads illustrious men’s list ahead of greats like Pele, Diego Maradona” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় ২৪ ম্যাচে ১৬ গোল দিয়ে শীর্ষে রয়েছেন জার্মানির মীরাস্লাভ ক্লোজা। তার পরেই ১৯ ম্যাচে ১৫ গোল নিয়ে এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন ব্রাজিলের রোনালদো। 

অর্থাৎ, ব্রাজিলের রোনালদোর বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ১৫ গোল করার রেকর্ড এবং আর্জেন্টিনার মেসি ও রোনালদোর গোল যোগ করলে ৯ না হওয়ার দাবিটি সঠিক নয়। 

দাবি ৬. আর্জেন্টিনার ১১ গোল খাওয়ার রেকর্ড আছে

এই দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে দেখা যায়, আর্জেন্টিনার জালে ১১ গোল জড়ানোর রেকর্ডটি মূলত দেশটির নারী ফুটবল দলের। ২০০৭ নারী বিশ্বকাপে দেশটির নারী ফুটবল দল জার্মানি নারী ফুলবল দলের কাছে ১১-০ গোলে হারে। অর্থাৎ ১১ গোল খাওয়ার রেকর্ডটি আর্জেন্টিনার পুরুষ ফুটবল দলের নয়।

অপরদিকে আর্জেন্টিনার পুরুষ ফুটবল দলের সর্বোচ্চ ব্যবধানে হারের রেকর্ড অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশটির পুরুষ ফুটবল দল ১৯৫৮ ফুটবল বিশ্বকাপে তৎকালীন চেকশ্লোভাকিয়ার কাছে  ৬-১ গোল ব্যবধানে হারে।

এছাড়া, ২০১৮ সালে একই ব্যবধানে প্রীতি ম্যাচে স্পেনের কাছে ও ২০১০ সালে দক্ষিন আমেরিকা বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বলিভিয়ার কাছে হেরেছিল আর্জেন্টিনা পুরুষ দল।

অর্থাৎ, আর্জেন্টিনার ১১ গোল খাওয়ার রেকর্ডের দাবিটি বিভ্রান্তিকর।

মূলত, কাতারে চলমান ফুটবল বিশ্বকাপকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকরা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল দল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার কিছু কিছু পরিসংখ্যান কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই প্রচার করছে৷ এসব পরিসংখ্যানের মধ্যে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ, দুই দলের ফাইনালে খেলা, আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা ও মেসির গোল যোগ করলেও ১ হাজার না হওয়া, বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মেসি ও রোনালদোর মোট গোল সংখ্যা, ব্রাজিলের ২৪ বছরে  ১৫ টা কাপের বিপরীতে আর্জেন্টিনার ১ টি কাপ ও আর্জেন্টিনার ১১ গোল খাওয়ার রেকর্ডের তথ্যগুলো সঠিক নয়।

সুতরাং, “কেন ব্রাজিল করি??” শীর্ষক শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত পরিসংখ্যানটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img