গত ১৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রেসিডেন্টের মধ্যকার বৈঠককে কেন্দ্র করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে বারণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন শীর্ষক একটি দাবি দেশের একাধিক গণমাধ্যম এবং পরবর্তীতে ফেসবুকে প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।

উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন সময় টিভি, ইনডিপেনডেন্ট টিভি, যুগান্তর, একাত্তর টিভি, মানবজমিন, নিউজ২৪ (ইউটিউব), দীপ্ত টিভি, কালবেলা, বাংলাভিশন, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, সাম্প্রতিক দেশকাল, বাংলা ইনসাইডার, সোনালী নিউজ, বহুমাত্রিক, বিবার্তা২৪, এই মুহূর্তে, ক্যাম্পাস টাইমস.প্রেস (ফেসবুক)।

একই দাবিতে গণমাধ্যমসহ ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
তাছাড়া, একই ঘটনায় ফেসবুকে প্রচারিত এক পোস্টে দাবি করা হয়েছে, চীনা প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে বারণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকের পোস্টটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করতে আহ্বান জানাননি বরং তাইওয়ানের আসছে জানুয়ারির নির্বাচনে চীনকে হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে দেশীয় একাধিক গণমাধ্যমে আলোচিত দাবিটির সূত্র হিসেবে বিবিসি’র নাম উল্লেখ করতে দেখা গেছে। এই সূত্রে আমরা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘BBC’ এর ওয়েবসাইটে আলোচিত বৈঠকটির বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন (১, ২, ৩) খুঁজে পেয়েছি, যেগুলো বিশ্লেষণ করে আলোচিত দাবিটি অর্থাৎ শি জিনপিংকে আসন্ন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে বারণ করেছেন বাইডেন শীর্ষক কোনো তথ্যের উল্লেখ পাইনি।
বিবিসি সেদিন বৈঠকের বিষয়ে লাইভ রিপোর্টিং করেছে। চার পাতার এই রিপোর্টিং এর প্রথম পাতায় বৈঠক শুরুর পূর্বে সংবাদমাধ্যমটির মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতিনিধি বারবারা প্লেট উসার (Barbara Plett Usher) এর বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে, “মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ, তাইওয়ান, ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং নির্বাচনে হস্তক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হবে।”
রিপোর্টিংয়ের দ্বিতীয় পাতায় নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো তথ্য না থাকলেও তৃতীয় পাতায় শেষের দিকে বিবিসির উত্তর আমেরিকা সম্পাদক সারা স্মিথের (Sarah Smith) “What Biden wants from today’s meeting with Xi” শিরোনামে একটি নিবন্ধে এ সংক্রান্ত আলোচনা দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। সারা তার নিবন্ধে বাইডেন বহুল প্রতীক্ষিত এই বৈঠক থেকে কী কী বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনার আশা করছেন সে বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি লিখেছেন, বৈঠকের এজেন্ডায় আগামী বছরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চীনের হস্তক্ষেপের চেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্কতার বিষয়টি থাকবে।

এরপর বৈঠক শুরু হয় এবং বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সামনে বক্তব্য দেন বাইডেন। বিবিসি একই পাতায় লিখেছে, বাইডেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নির্বাচনী হস্তক্ষেপের বিষয়ে বাইডেন বলেছেন যে তিনি শিকে বলেছিলেন যে তিনি “কোনও হস্তক্ষেপ করবেন না” আশা করেছিলেন।
কিন্তু কোন দেশ বা কী নির্বাচন সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি বিবিসি।

বিষয়টি নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার টিম হোয়াইট হাউজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাইডেনের সেদিনের সংবাদ সম্মেলনের পুরো বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে। বাইডেন তার বক্তব্য দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ দেন। তার বক্তব্যে নির্বাচন প্রসঙ্গ না এলেও এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তাইওয়ানের নির্বাচন নিয়ে আলোচনার উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐ সাংবাদিক বাইডেনের কাছে জানতে চান, “তাইওয়ানের বিষয়ে একটি প্রশ্ন। আপনি এবং আপনার প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আসন্ন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট শি এবং চীনকে সতর্ক করেছেন। আমি ভাবছি যে তারা যদি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে তাহলে এর পরিণতি কী হবে?”

নির্বাচন বিষয়ে এই অংশের আলোচনা ছাড়া সংবাদ সম্মেলনের বাকি অংশে নির্বাচন বিষয়ক কোনো আলোচনার বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
বাইডেনের সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও দেখুন এখানে।
রিউমর স্ক্যানার টিম যাচাই করে দেখেছে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতেও (১, ২, ৩) বাইডেন কর্তৃক তাইওয়ানের আসন্ন নির্বাচনে চীনের হস্তক্ষেপ না করার আহ্বানের বিষয়েই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাইডেনের কোনো বক্তব্য বা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য মেলেনি।

বাইডেন কর্তৃক তাইওয়ানের আসন্ন নির্বাচনে চীনের হস্তক্ষেপ না করার আহ্বানের বিষয়ে দেশীয় একাধিক গণমাধ্যমও (ডেইলি স্টার, চ্যানেল২৪, ঢাকা পোস্ট, পূর্ব পশ্চিম বিডি) সংবাদ প্রকাশ করেছে।
মূলত, গত ১৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সফররত চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে বৈঠকে বসেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বৈঠক শেষে শি জিনপিংকে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে বারণ করেছেন বাইডেন শীর্ষক একটি দাবি দেশের একাধিক গণমাধ্যম এবং পরবর্তীতে ফেসবুকে প্রচারিত হয়েছে। এছাড়া, একই ঘটনার বিষয়ে এমনও দাবি করা হয় যে, চীনা প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে বারণ করেছেন বাইডেন। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব দাবির কোনোটিই সঠিক নয়। জো বাইডেন চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করতে আহ্বান জানাননি। প্রকৃতপক্ষে, তাইওয়ানের আসন্ন জানুয়ারির নির্বাচনে চীনকে হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
উল্লেখ্য, চীনের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ান মূলত দক্ষিণ চীন সমূদ্রের একটি দ্বীপ। বিবিসির দেওয়া তথ্যমতে, চীন মনে করে তাইওয়ান তাদের দেশেরই অংশ। এটি চীন থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি প্রদেশ। যেটি ভবিষ্যতে কোন একদিন চীনের সঙ্গে বিলুপ্ত হবে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ১৩ জানুয়ারি তাইওয়ানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে একই বছরের (২০২৪) ০৫ নভেম্বর। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের তারিখ ২০২৪ সালেরই ৭ জানুয়ারি নির্ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন।
সুতরাং, তাইওয়ানের নির্বাচনে চীনকে হস্তক্ষেপ না করতে বাইডেনের আহ্বান জানানোর খবরকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে চীনকে হস্তক্ষেপ না করতে বাইডেনের আহ্বান জানানোর দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- BBC: US and China to resume high-level military communication
- NBC News: Highlights: Joe Biden and Xi Jinping talk military cooperation, climate and Taiwan
- White House: Remarks by President Biden in a Press Conference | Woodside, CA
- Rumor Scanner’s own investigation