ইঞ্জিন-নাবিক বিহীন নৌযানগুলো কি আসলেই রহস্যময়?

চলতি বছরের ১৫ জুলাই ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানাধীন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ঢালচরের নিকটবর্তী চরনিজাম এলাকায় ভেসে আসছে “আল কু্বতান” নামের একটি নৌযান। সেদিনই বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, এটি একটি ইঞ্জিন ও নাবিকবিহীন বিদেশী জাহাজ। 

সে সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

এছাড়া সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়াদ্বীপে ভেসে এসে আটকা পড়ে একই ধরনের একটি নৌযান। 

গণমাধ্যমের খবরে এই জাহাজটির বর্ণনায় বলা হয়, নাবিকবিহীন জাহাজটির ওপরের অংশ খোলা। এতে অনেক কন্টেইনার ও অন্য মালামাল রয়েছে। এই নৌযানটির সংবাদে চটকদার শিরোনাম দিয়ে কোনো কোনো গণমাধ্যম স্থানীয়দের বরাতে এটিকে ভূতুড়ে জাহাজ বা গুপ্তধনের জাহাজ বলেও প্রতিবেদন করেছে। 

এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে, এখানেএখানে। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন উপকূলে ভেসে আসা এসব নৌযানগুলো আসলে কি? কেন এসবে কোনো ইঞ্জিন বা নাবিক থাকে না? সেসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই এই প্রতিবেদন।

এই নৌযানগুলো আসলে কি?

রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে দেখা যায়, এই ধরনের নৌযানকে মূলত বার্জ বলে। বার্জের সংজ্ঞায় শীর্ষস্থানীয় অনলাইন মেরিটাইম শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ প্লাটফর্ম ‘Marine Insight‘ তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, প্রাথমিকভাবে মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত এক ধরনের নৌযান এটি। এগুলো কোনো স্বাধীন কোনো বোট বা জাহাজ নয় বরং এগুলো পানিতে ভাসমান এক জাতীয় নৌযান যা অন্য কোনো নৌযান নিয়ে বেধে বা টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।

এটি সমতল আকৃতির, দেখতে ঠিক একটি ভেলার মতো। এই আকৃতি দেওয়ার প্রধান কারণ হল, যাতে এসব নৌযানে বেশি করে পণ্য বহন করা যায়। বার্জ সাধারণত নদী, বড় বড় লেক বা খালে পন্য পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে এ ধরনের বার্জ সমুদ্রবন্দরগুলোয় বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বার্জ নিয়ে আরও বিস্তারিত অনুসন্ধানে ‘Archway Marine Lighting‘ নামের একটি ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, এটি এক ধরনের সামুদ্রিক নৌযান৷ যা মূলত মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। 

বার্জে কোনো মোটর বা ইঞ্জিন থাকে না। তাই এগুলো স্বাধীনভাবে চলাচলও করতে পারে না। তার পরিবর্তে এগুলোকে কোনো টাগবোট বা অন্য কোনো নৌযান দিয়ে টেনে নেওয়া হয়। 

তাহলে কি বার্জ আর জাহাজের মধ্যে পার্থক্য আছে?

Marine Insight বার্জ আর জাহাজের মধ্যে পার্থক্য বেশ কিছু পার্থক্য তুলে ধরেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে। যেমন,

  • জাহাজ সাধারণত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় রুটেই চলাচল করে। বিপরীতে বার্জ কেবল অভ্যন্তরীণ নৌপথেই চলাচল করে। বার্জ সাধারণত নদীপথে পন্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। তবে সমুদ্র পথেও কখনো কখনো বার্জ দেখা যায়।
  • পরিবহন: জাহাজ বহুমুখী কাজে ব্যবহার করা হয় অর্থাৎ জাহাজে একইসাথে মানুষ ও পন্য দুইটিই পরিবহন করা হয় যেখানে বার্জ কেবল পন্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়।
  • পাখা বা প্রোপেলার: জাহাজ সমূহ চালানোর জন্য নিজস্ব পাখা বা প্রোপেলার রয়েছে কিন্তু বিপরীতে বার্জকে টাগবোট নামের ছোট জাহাজ দিয়ে টেনে টেনে চালানো হয়।
  • চালানোর কৌশল: যেহেতু জাহাজ চালানোর নিজস্ব পাখা আছে, তাই জাহাজ পরিচালনা করা বার্জ থেকে সহজ। কারণ, বার্জকে টাগবোট নামের ছোট জাহাজ দিয়ে টেনে টেনে চালানোর কারণে দড়ি দিয়ে বাধাঁ একটি জাহাজকে একইসাথে আরেকটি জাহাজ দিয়ে পরিচালনা করা কঠিন।

এসমস্ত পার্থক্য থেকে বুঝা যায়, বার্জ হচ্ছে সমতল আকৃতির বৃহৎ আকৃতির নৌযান। যা সাধারণত পন্য পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। বিপরীতে জাহাজ বলতে বোঝায় যেকোনো ধরনের নৌযান,  যা একইসাথে পন্য ও মানুষ পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। 

বার্জের ইঞ্জিন থাকে?

Archway Marine Lighting‘ নামের ওয়েবসাইটটিতে বার্জ সম্পর্কে প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা যায়, বার্জে কোনো মোটর বা ইঞ্জিন থাকে না। এগুলোকে সাধারণত টাগবোট দিয়ে টেনে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। 

এই টাগবোটের সংজ্ঞায় ইংরেজি অভিধান ‘britannica.com‘ বলছে, টাগবোট হচ্ছে ছোট, শক্তিশালী এক ধরনের জাহাজ, যেগুলোকে  বন্দরে বা নদীতে অন্য জাহাজ টানা বা ঠেলায় ব্যবহার করা হয়।

সাধারণত যেসব জাহাজ নিজেরা চলাচল করতে পারে না যেমন নষ্ট হয়ে যাওয়া জাহাজ, তেল ট্যাংকার অথবা বার্জকে টেনে নিয়ে যেতে টাগবোট ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ বার্জের নিজস্ব ইঞ্জিন নেই।

বার্জ কি কাজে ব্যবহার করা হয়?

শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট ‘wonderpolis.com‘ বলছে, বেশিরভাগ বার্জ ভারী জিনিসপত্র বহন করে যা অন্য কোনো উপায়ে পরিবহন করা কঠিন। যেমন, কয়লা, বিভিন্ন শস্য, তেল, রাসায়নিক, পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ, বালি, পাথর, কাঠ, লোহা আকরিক এবং অন্যান্য খনিজ। 

সাধারণত বার্জে পণ্য পরিবহনের খরচ খুব কম হয়ে থাকে, বিশেষ করে যখন ট্রাক বা বিমানের তুলনায়। একটি সাধারণ বার্জ ১৫ শ টন পর্যন্ত মালামাল বহন করতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে এর পরিবহন ক্ষমতা আরও বেশিও হতে পারে

এছাড়া বার্জের ব্যবহার এতটাই জনপ্রিয় যে, মার্কিন জলপথে প্রায় ৩০ হাজার বার্জ চলাচল করে। যেগুলো প্রতি বছর প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের পণ্য পরিবহন করে, যা সমস্ত আমেরিকার পণ্য পরিবহনের প্রায় ১৫ শতাংশ। 

সম্প্রতি সেন্ট মার্টিনের ছেড়াদ্বীপে ভেসে আসা বার্জ নিয়ে কি জানা যাচ্ছে

ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘বিবিসি বাংলা’ গত ২৪ অক্টোবর “সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আটকে পড়া ‘ভূতুড়ে জাহাজ’ যেভাবে বাংলাদেশে এলো” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলছে, ভেসে আসা নৌযানটির গায়ে থাকা নাম্বার এম আর ৩৩২২ এর সূত্র ধরে জানা যায় এটি সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী একটি বার্জ। 

মেরিনা টোয়েজ প্রাইভেট লিমিটেডের মালিকানায় নিবন্ধনকৃত এ জাহাজটি ১১০.৬ মিটার দীর্ঘ এবং ৩০ মিটার চওড়া একটি মালবাহী বার্জ। ২০০৮ সালে তৈরি করা এই বার্জটি ১০ হাজার টন মালামাল বহনে সক্ষম। 

এছাড়া গত জুলাইয়েও ভোলার মনপুরার চরনিজামে ভেসে আসা আল কুবতান নিয়েও পরবর্তীতে জানা যায়, এটিও একটি একটি বার্জ ছিল। 

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে নৌযানগুলোকে রহস্যময়, ভূতুড়ে, নাবিকবিহীন, জনমানবশূন্য বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদন করা হয়েছে এগুলো মূলত এক ধরনের নৌযান, যাদেরকে বার্জ বলে। এগুলোতে মূলত ইঞ্জিন থাকে না বরং টাগবোট নামে আরেকটি নৌযান দিয়ে টেনে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এসব নৌযান মূলত ব্যবহার করা হয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে। তাই এসব ক্ষেত্রে বার্জে মানুষ বা নাবিকের উপস্থিতি না থাকাটাই স্বাভাবিক। 

সুতরাং, বার্জ হচ্ছে মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত এক ধরনের নৌযান। যেগুলো কোনো স্বাধীন কোনো বোট বা জাহাজ নয় বরং এগুলো পানিতে ভাসমান এক জাতীয় নৌযান যা অন্য কোনো নৌযান নিয়ে বেধে বা টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। সচরাচর এসব নৌযানে মানুষ থাকে না।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img