সম্প্রতি ‘ঢাকার পর এবার চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাংলাদেশ সরকার হিন্দুদের নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ শুরু করেছে। সরকার অবৈধ নির্মাণের নামে হিন্দু নিবন্ধিত জমি ও বাড়ি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে’ শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টুইটারে প্রচার করা হচ্ছে।
টুইটারে প্রচারিত এমন একটি টুইট দেখুন এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাংলাদেশ সরকার হিন্দুদের নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি বাঁশখালীর নয় বরং উক্ত ভিডিওটি কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর তীরে অবৈধভাবে নির্মিত স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানের সময়ের। এছাড়া বাঁকখালীতে উচ্ছেদকৃত অবৈধভাবে দখলদারদের মধ্যে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাই বেশি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওটি যে স্থানের
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটার ও ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিওটিতে থাকা Kohelia TV এর লোগোর সূত্রে ফেসবুকে কক্সবাজার ভিত্তিক পেইজ Kohelia TV তে গত পহেলা মার্চ ‘বাঁকখালীতে উচ্ছেদ : খোলা আকাশের নিচে ছিল অনেকে‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।

ভিডিওটির শিরোনাম থেকে জানা যায়, এটি বাঁকখালীতে উচ্ছেদের একটি ঘটনা।

পরবর্তী অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাঁকখালী বাংলাদেশের বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৯ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ ৯৫ মিটার। পাহাড়ি অঞ্চলের কারণে এর গতিপথ সর্পিল। কক্সবাজার এই নদীর তীরে অবস্থিত।
অর্থাৎ টুইটার ও ফেসবুকে উচ্ছেদের ঘটনাটি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ঘটনা বলে দাবি করা হলেও প্রকৃতপক্ষে ঘটনাটি কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর।
বাঁকখালী থেকে কি কেবল হিন্দুদের উচ্ছেদ করা হয়েছে?
বাঁকখালী থেকে হিন্দুদের উচ্ছেদ করার ঘটনা দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে দেখা যায়, সেখানে অবৈধভাবে নদী এলাকায় বসতি স্থাপনকারী কয়েকজন সাংবাদিকদের কাছে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। এদের মধ্যে দুইজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীকেও দেখা যায়।

কিন্তু তারা তাদের বক্তব্যে ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য তাদেরকে উক্ত জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে এমন কোনো অভিযোগ করেননি বরং তারা তাদেরকে জায়গা থেকে উচ্ছেদের জন্য সময় না দেওয়ার ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। পাশাপাশি ভিডিওটিতে কয়েকজন পুরুষও দেখা গেলেও তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। একইসাথে ভিডিওটিতে উচ্ছেদকৃত এলাকায় পুলিশ কর্তৃক কয়েকজন বোরকা পরিহিত নারীকেও সরিয়ে দিতে দেখা যায়।

তবে টুইটার ও ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উচ্ছেদের এই ঘটনার পুরো ভিডিওটি না দিয়ে কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীদের অংশটুকু দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুরো ভিডিও না দিয়ে কিছু অংশ দিয়ে সেটি আবার ব্লার বা ঝাপসা করে প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া পুরো ভিডিওটি বিশ্লেষণ করেও কোথাও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কাউকে উচ্ছেদ করা হয়েছে এমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বিপরীতে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোতে গত ১ মার্চ ‘অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বাঁকখালী নদীর ৩০০ একর জায়গা দখলমুক্ত‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীতে দ্বিতীয় দিনের অভিযানে ৪০টির বেশি পাকা বাড়িসহ ১৪৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয়। পাশাপাশি প্রতিবেদনটি থেকে সামসুন্নাহার নামে একজন গৃহবধূর বক্তব্যও পাওয়া যায়। সেখানে তিনি বলেন, ‘তিনি চার বছর আগে শহরের পেশকার পাড়ার জনৈক মোবারকের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকায় প্যারাবনের চার শতক জমি কেনেন নোটারির মাধ্যমে। সেখানে ছয় মাস আগে তিন লাখ টাকা খরচ করে তৈরি করেন টিনের পাকা বাড়ি। দেড় মাস ধরে সন্তান নিয়ে ওই বাড়িতে থাকছেন। আজ বাড়িটি ভেঙে দেওয়া হলো।’

বাঁকখালী নদী দখলের সাথে কারা জড়িত?
রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে দেখা যায়, এই নদী দখলের সাথে জড়িতদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া যায় তাদের অধিকাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। জাতীয় দৈনিক ডেইলি স্টারের ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘অবাধে চলছে বাকখালী দখল, আইনি জটিলতার কথা বলছে প্রশাসন‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তর, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও বিআইডব্লিউটিএ এর পৃথক প্রতিবেদনে বাঁকখালী নদী দখলে জড়িত ১৩১ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে নতুন নির্মিত সেতুকে ঘিরে দখলে জড়িত রয়েছেন আরও ৫০ জনের মতো, যাদের মধ্যে ২৩ জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলাও করেছে।

এই তালিকায় কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পাশাপাশি ইংরেজি দৈনিক দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বাঁকখালী নদী দখলে কক্সবাজার পৌরসভাও‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সেসময় তাদের ওয়েবসাইটে এই নদী দখলের অভিযোগে ১০৯ জন দখলদারের পরিচিতি দিয়েছে। এর মাঝে কক্সবাজার পৌরসভাকেও দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ১৫৭ প্রভাবশালীসহ ৪২০ জন দখলদারকে চিহ্নিত করেছে। এদের মধ্যে রয়েছে ঠিকাদার সিআইপি আতিকুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আবদুল খালেক চেয়ারম্যান, জামায়াত নেতা জাহাঙ্গীর কাশেম, আবদুল্লাহ খান, শামশুল হুদা, শহর মুল্লুক, ফরিদুল আলমসহ ১৫৭ প্রভাবশালীর নাম।

এছাড়া ২০২২ সালের ১৪ জুন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘বাঁকখালী নদী রক্ষায় পদক্ষেপ না নেওয়ায় ১৫ কর্মকর্তা-জনপ্রতিনিধিকে নোটিশ‘ শীর্ষক শিরোনামের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী রক্ষায় হাইকোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও প্যারাবন কেটে নদী দখল, কক্সবাজার পৌরসভার সমস্ত আবর্জনা নদীতে ফেলে দূষণ অব্যাহত রাখা এবং পূর্বের দখলদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ৫ সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকসহ ১৫ সরকারি কর্মকর্তা ও এক জনপ্রতিনিধিকে আদালত অবমাননার নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বাঁকখালী নদী থেকে উচ্ছেদের সঙ্গে ধর্মীয় কোনো বিষয় জড়িত নেই। বরং নদীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করতেই উল্লেখিত উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিল।
মূলত, উচ্চ আদালতের নির্দেশে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার পৌরসভা, বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান চালায়। এ উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের ধারণকৃত ভিডিও থেকে দুইজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীর বক্তব্য কেটে নিয়ে ও ভিডিওটি ব্লার বা ঝাপসা করে টুইটার ও ফেসবুকে প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে যে, চট্টগ্রামের বাশখালীতে বাংলাদেশ সরকার হিন্দুদের নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ শুরু করেছে। সরকার অবৈধ নির্মাণের নামে হিন্দু নিবন্ধিত জমি ও বাড়ি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, উল্লেখিত ঘটনাটি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর নয় বরং কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর এবং এ ঘটনার সঙ্গে ধর্মীয় কোনো বিষয়ও জড়িত নয়। প্রকৃতপক্ষে নদী দখলমুক্ত করতে এই অভিযান চালানো হয় এবং হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে নদীতে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করা সকলকেই উচ্ছেদ করা হয়েছে।
সুতরাং, নদী দখলমুক্ত করতে কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর তীরে চালানো প্রশাসনের উচ্ছেদ অভিযানের একটি ভিডিওকে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাংলাদেশ সরকার হিন্দুদের নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Kohelia TV: বাঁকখালীতে উচ্ছেদ : খোলা আকাশের নিচে ছিল অনেকে
- Onushilon.org: বাঁকখালী নদী
- Daily Prothom Alo: অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বাঁকখালী নদীর ৩০০ একর জায়গা দখলমুক্ত
- Daily Star: অবাধে চলছে বাকখালী দখল, আইনি জটিলতার কথা বলছে প্রশাসন
- The Business Standard: বাঁকখালী নদী দখলে কক্সবাজার পৌরসভাও
- Dhaka Times: বাঁকখালী নদী রক্ষায় পদক্ষেপ না নেওয়ায় ১৫ কর্মকর্তা-জনপ্রতিনিধিকে নোটিশ