সম্প্রতি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম ও পেশা ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে দাবিতে দেশের একাধিক মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদন দেখুন ভোরের কাগজ, মানবজমিন, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, সময় টিভি, বায়ান্ন ডট টিভি, ঢাকা মেইল, আমাদের সময় ডটকম, চ্যানেল২৪, ডেইলি ক্যাম্পাস।
গণমাধ্যমের ফেসবুক পেইজে প্রচারিত এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে ও এখানে।
গণমাধ্যমের ইউটিউবে প্রচারিত এমন প্রতিবেদন দেখুন চ্যানেল২৪ (আর্কাইভ), সময় টিভি (আর্কাইভ) ও বাংলাদেশ টাইমস(আর্কাইভ)।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবসাইটে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে।
প্রতিবেদনগুলোতে যা দাবি করা হচ্ছে
- ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম ভুল করা হয়েছে। শেখ বাদ দিয়ে শুধু লেখা হয়েছে লুৎফর রহমান।
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা শেখ লুৎফর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দিতে কেরানি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি ছিলেন আদালতের সেরেস্তাদার।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সম্প্রতি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম ও পেশা ভুলভাবে উপস্থাপন করার দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয় বরং পাঠ্যবইগুলোতে বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম ও পেশা সঠিকভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম ও পেশা সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাবার সঠিক নাম ও পেশা সম্পর্কে অনুসন্ধানে বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা অবলম্বনে রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি পড়ে দেখে রিউমর স্ক্যানার টিম।
বইটিতে দেখা যায়, উক্ত বইয়ের ৮ নাম্বার পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু তাঁর বাবার নাম লিখেছেন শেখ লুৎফর রহমান।
এছাড়া বইয়ের ৭ নাম্বার পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু তাঁর বাবার পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান দেওয়ানি আদালতে একটি চাকরি পেয়েছিলেন এবং পরে তিনি সেরেস্তাদার হয়েছিলেন।
অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও তিনি পেশায় একজন সেরেস্তাদার ছিলেন৷
পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম নিয়ে যা লেখা আছে
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৫ নং পৃষ্ঠায় ‘ছেলেবেলার মুজিব‘ শিরোনামে প্রকাশিত পাঠটি খুঁজে পাওয়া যায়।
পাঠটির দ্বিতীয় অংশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মগ্রহণ প্রসঙ্গে আলোচনায় দেখা যায় এই অংশে বলা হয়েছে, ‘এই গাঁয়ে ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। প্রথম সন্তান, তাই পরিবারে আনন্দের ঢেউ। নাম রাখা হয় মুজিবুর রহমান, বংশের উপাধি শেখ থাকবে নামের আগে।’
অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম থেকে শেখ বাদ দেওয়া হয়নি। অধিকিন্তু পাঠটিতে আরও দুইবার বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম ব্যবহার করা হলেও কোনোবারই নামের পূর্বে ‘শেখ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাঠটির প্রথমেই যে বঙ্গবন্ধুর বাবার নামের সঙ্গে ‘শেখ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়নি। যেহেতু পাঠটির প্রথমেই বঙ্গবন্ধুর বাবার নামের সঙ্গে ‘শেখ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তাই সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম থেকে শেখ বাদ দেওয়ার দাবিটি সঠিক নয়।
অপরদিকে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়েও বঙ্গবন্ধুর বাবার নামে ভুল করা হয়েছে।
তবে অনুসন্ধানে সপ্তম শ্রেণির বইটিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনার অংশে এমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি৷
বঙ্গবন্ধুর বাবার পেশা নিয়ে পাঠ্যবইয়ে যা আছে
ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৭ নং পৃষ্ঠায় ‘ছেলেবেলার মুজিব‘ শিরোনামে প্রকাশিত পাঠটির বঙ্গবন্ধুর বাবার পরিচয় নিয়ে আলোচ্য অংশে বলা হয়েছে, ‘বাবা লুৎফর রহমান এখানে সরকারি অফিসে কেরানি। বলা হয় সেরেস্তাদার – ফার্সি শব্দ। এককালে ফার্সি ছিল রাষ্ট্রভাষা – মানে সরকারের অফিস-আদালতের ভাষা।‘
একই পৃষ্ঠার শেষ অংশে আবারও বলা হয়েছে ‘অসুখের কারণে লেখাপড়ায় (বঙ্গবন্ধুকে) বেশ পিছিয়ে পড়তে হলো। ১৯৩৬ সালে আবার স্কুলে ফেরা। এবারে মাদারীপুর হাইস্কুলে, কারণ ততদিনে বাবা লুৎফর রহমান বদলি হয়ে গেছেন মাদারীপুরে। এখানেও তিনি সেরেস্তাদার অর্থাৎ আদালতের প্রধান কেরানি।‘
পাঠ্যবইয়ের এই দুইটি অংশ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বইটিতে ‘কেরানি’ শব্দটি ব্যবহার করা হলেও এটি মূলত ব্যবহার করা হয়েছে সেরেস্তাদার শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে এবং দুই জায়গাতেই কেরানির পাশাপাশি ‘সেরেস্তাদার’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু এই অঞ্চলে এককালে অফিস-আদালতের ভাষা ফার্সি ছিল তাই অফিস-আদালতের কেরানিকে সেরেস্তাদার বলে সম্বোধন করা হতো। অর্থাৎ কেরানি এবং সেরেস্তাদার দুটো আলাদা পেশা নয়, বরং এগুলো একই পেশার ভিন্ন ভিন্ন সম্বোধন।
বিপরীতে একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উক্ত বিষয়টিকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ‘একই পৃষ্ঠার দুই জায়গায় কেরানি শব্দটা লেখা হয়েছে।‘ কিন্তু পাঠ্যবইয়ে দুই জায়গাতেই কেরানির পাশাপাশি সেরেস্তাদার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং এক জায়গায় সেরেস্তাদার অর্থ যে আদালতের প্রধান কেরানি বলা হয়েছে, সে প্রসঙ্গটি প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়নি।
এছাড়া বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানেও সেরেস্তাদার শব্দের অর্থ ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী, প্রধান কেরানি উল্লেখ করা হয়েছে।
মূলত, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে নতুন বই প্রদান করে। কিন্তু গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধানে এই নতুন বইগুলোতে অনেক অসঙ্গতি ও ভুল ধরা পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মূলধারার বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয় যে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম ভুল করা হয়েছে ও বঙ্গবন্ধুর বাবার পেশাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন না করে কেরানি বলা হয়েছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধুর বাবার নামের ভুলের দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয় এবং ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে বঙ্গবন্ধুর বাবার নামের সঙ্গে ‘শেখ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া তাঁর বাবাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়েও ‘কেরানি’র পাশাপাশি সেরেস্তাদার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
সুতরাং, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম ভুল ও বঙ্গবন্ধুর বাবার পেশাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- NCTB Class Six Book: ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বই
- NCTB Class Seven Book: ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বই
- Daily Samakal: উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা
- Asamapta Atma Jibani by Sheikh Mujibur Rahman: Asamapta Atma Jibani by Sheikh Mujibur Rahman