আ.লীগের কার্যক্রমের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা বাতিল হওয়ার দাবিটি ভুয়া

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে গত ১২ মে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি একটি কথিত সংবাদ প্রচার করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞাবতি | ভয়ংকর বিপদে ডক্টর ইউনু সম্পন্ন ভিডিওটি দেখতে থাক”। এছাড়া, ভিডিওর শুরুতে একটি সংবাদ ফুটেজে সংবাদ উপস্থাপিকাকে বলতে শোনা যায়, ‘রাজনীতি করতে কোনো বাধা নেই আ.লীগের। দলটির নিবন্ধন বাতিল করে নিষিদ্ধ করার রিট খারিজ করেছেন হাইকোর্ট’।

অর্থাৎ দাবি করা হয়েছে, আ.লীগের কার্যক্রমের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয়েছে।

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি আলোচিত দাবিতে প্রচারিত উপরোল্লিখিত পোস্টগুলো সম্মিলিতভাবে প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজারেরও অধিক বার দেখা হয়েছে এবং প্রায় ৮ হাজারেরও অধিক পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্টগুলোতে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

এরূপ দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এরূপ দাবিতে টিকটকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা এখনও বাতিল করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, ভিন্ন ভিন্ন পুরোনো ও অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার দৃশ্যকে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ভিডিওটির শুরুতে একটি সংবাদ ফুটেজের সংযুক্তি পাওয়া যায় যেখানে সংবাদ উপস্থাপিকাকে বলতে শোনা যায়, ‘রাজনীতি করতে কোনো বাধা নেই আ.লীগের। দলটির নিবন্ধন বাতিল করে নিষিদ্ধ করার রিট খারিজ করেছেন হাইকোর্ট’। ভিডিওটির প্রেক্ষাপটের বিষয়ে অনুসন্ধানে মূলধারার ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম এটিএন নিউজের ইউটিউব চ্যানেলে ২০২৪ সালের ০১ সেপ্টেম্বর ‘রাজনীতি করতে কোনো বাধা নেই আওয়ামী লীগের’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Comparison : Rumor Scanner

ভিডিওটির শুরুর সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির শুরুতে সংযুক্ত উক্ত দৃশ্যের তুলনা করলে হুবহু মিল পাওয়া যায়। ভিডিওটিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে দলটির নিবন্ধন বাতিল চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন সারডা সোসাইটির পক্ষে সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক আরিফুর রহমান মুরাদ ভূঁইয়া হাইকোর্টে রিট করেছিলেন যা খারিজ করে দেওয়া হয়। 

অপরদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে গত ১২ মে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থাৎ, সংযুক্ত উক্ত ভিডিও ফুটেজটি আ.লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপনের আগের ঘটনার দৃশ্য।

এছাড়াও, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত সংবাদ প্রতিবেদনে একটি স্লোগান-মিছিলের দৃশ্যেরও সংযুক্তি পাওয়া যায়। দৃশ্যটির বিষয়ে অনুসন্ধানে মূলধারার গণমাধ্যম ‘চ্যানেল২৪’ এর ইউটিউব চ্যানেলে ‘হঠাৎ আদালত প্রাঙ্গণে আওয়ামী পন্থী আইনজীবীদের স্লোগান-মিছিল’ শিরোনামে ২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবরে প্রকাশিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়।

Comparison : Rumor Scanner

উক্ত ভিডিওটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত সংবাদ প্রতিবেদনে প্রদর্শিত স্লোগান-মিছিলের দৃশ্যের তুলনা করলে দুই ভিডিওতে একই ব্যক্তির উপস্থিতি পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, ভিডিও দুইটি ভিন্ন কোণ থেকে ধারণ করা হয়েছে। তবে, উক্ত স্লোগান মিছিলের ভিডিওটিও আ.লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপনের আগের ঘটনার দৃশ্য।

এছাড়াও, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত সংবাদের ভিডিওটিতে আরেকটি সংবাদ ফুটেজের সংযুক্তি পাওয়া যায় যেখানে সংবাদ উপস্থাপককে বলতে শোনা যায়, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি লিখেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস’। ভিডিওটির প্রেক্ষাপটের বিষয়ে অনুসন্ধানে মূলধারার ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম ‘চ্যানেল২৪’ এর ইউটিউব চ্যানেলে ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জাতিসংঘ মহাসচিবের চিঠি’ শিরোনামে ২০২৪ সালের ২০ আগস্টে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন পাওয়া যায়। ভিডিওটির ৩ সেকেন্ড পরবর্তী সময়ে প্রদর্শিত দৃশ্যের সাথে আলোচিত দৃশ্যের মিল পাওয়া যায়।

Comparison : Rumor Scanner

তবে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওতে সংযুক্ত সংবাদ ফুটেজটির বাক্যের শুরুর অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পুরো লাইনটি ছিল, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি লিখেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস’। এছাড়াও, সংবাদ প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, “চিঠিটিতে জাতিসংঘ মহাসচিব অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় ড. ইউনূসকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে জাতিসংঘ। গেল ১৬ই আগস্ট (২০২৪) চিঠিটি পাঠানো হয়..”

অর্থাৎ, উক্ত ভিডিও ফুটেজটিও আ.লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপনের আগের ঘটনার  এবং আলোচিত দাবিটির ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক।

এছাড়াও, কথিত সংবাদ প্রতিবেদনটিতে ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নিয়ে যা বললো জাতিসংঘ’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ থাম্বনেলেরও সংযু্ক্তি পাওয়া যায়। এ বিষয়ে অনুসন্ধানে মূূলধারার গণমাধ্যম ‘এটিএন নিউজ’ এর ইউটিউব চ্যানেলে একই থাম্বনেল সম্বলিত সংবাদ প্রতিবেদন গত ১৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ হতে দেখা যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “ছাত্রজনতার তুমূল আন্দোলনের মুখে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা ঘটায়। আর এতে জড়িয়ে পড়ে পুলিশ, র‍্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সম্প্রতি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। যেখানে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, র্যাব বিলুপ্তির প্রসঙ্গটিও উঠে আসে।… এছাড়া, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করা, র্যাব বিলুপ্ত, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, এবং বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার, গণগ্রেফতার বন্ধ করাসহ বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘ..”।

উল্লেখ্য, উক্ত ভিডিওটিও আ.লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপনের আগের ঘটনার দৃশ্য। 

আ.লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে অনুসন্ধানে জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’ এর ওয়েবসাইটে গত ১৬ জুনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করে আইন সংশোধনে উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। আজ সোমবার (১৬ জুন) সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ৫৯তম মানবাধিকার পরিষদে উত্থাপিত বার্ষিক প্রতিবেদনে এ উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন তিনি।.. সম্প্রতি সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তি বা সত্তার (সংগঠন) যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিধান যুক্ত করে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। এই অধ্যাদেশের আলোকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনও সংশোধন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।”

এছাড়াও, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত সংবাদে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, সাংবাদিক মাসুদ কামালসহ আরো একাধিক ব্যক্তির নানা বক্তব্যের সংযুক্তি পাওয়া যায়। তবে কোথাও আওয়ামী লীগের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা বাতিল বা তুলে নেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

পাশাপাশি, প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলেও আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা বাতিল বা তুলে নেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত সংবাদে সংযুক্ত একটি ভিডিও এর আগে ‘রাজনীতি করতে আওয়ামী লীগের কোনো বাধা নেই’ শীর্ষক দাবিতে প্রচারিত হলে সেসময় এ বিষয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার।

সুতরাং, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে জারি করা নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয়েছে শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img