দীর্ঘদিন ধরে ‘মঙ্গল গ্রহে গিয়ে পৃথিবীতে আর ফিরে আসবে না যে মেয়েটি, তিনি হলেন #এলিজা_কার্সন, নাসার কনিষ্ঠতম সদস্য।’ শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে।
সম্প্রতি ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।
আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।
২০১৯ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে । আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে।
২০২০ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন একটি পোস্ট দেখুন এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে।
২০২১ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন একটি পোস্ট দেখুন এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে।
২০২২ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন একটি পোস্ট দেখুন এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে।
শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট 10 মিনিট স্কুলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদন দেখুন এখানে।
গণমাধ্যমের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদন দেখুন সময় টিভি।
যা দাবি করা হচ্ছে
- অ্যালিসা কার্সন নাসার কনিষ্ঠতম সদস্য। এই মেয়ের আগ্রহ, তৃষ্ণা আর ডেডিকেশন দেখে মাত্র ১১ বছর বয়সে নাসা তাকে মনোনীত করে নেয় এবং ঘোষণা করে যে -সমস্ত অবস্থা অনুকূল হলে সে হবে ২০৩৩ সালে মঙ্গলে যাওয়া পৃথিবীর প্রথম মানুষ।
- এখন তার বয়স ১৭। যেহেতু সে মঙ্গলে গেলে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম তাই নাসার কাছে সে কোন প্রকার যৌনতা, বিয়ে বা সন্তানধারণের নিষেধাজ্ঞাপত্রতে সাক্ষর করেছে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, অ্যালিসা কার্সনের মঙ্গল গ্রহে গিয়ে পৃথিবীতে আর ফিরে আসার দাবিতে প্রচারিত তথ্যগুলো সঠিক নয় বরং কোনো ধরনের তথ্যসূত্র ছাড়াই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে দীর্ঘদিন ধরে তথ্যগুলো ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে।
অ্যালিসা কার্সন সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে অ্যালিসা কার্সনের ওয়েবসাইট Nasa Blueberry তে তার নিজের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
ওয়েবসাইটটির প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, অ্যালিসা কার্সন মাত্র ৩ বছর বয়সেই তার বাবার কাছে মহাকাশচারী হওয়ার ইচ্ছার কথা জানায়৷ ঐ বয়সেই এলিসা তার বাবাকে বলেন, ‘মঙ্গলে যাওয়া মানুষদের একজন হতে চান তিনি।’
এই স্বপ্ন পূরণে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই অ্যালিসার কৃতিত্বের তালিকায় আছে ৩টি স্পেস শাটল উৎক্ষেপণ, ৭ বার স্পেস ক্যাম্পে অংশ নেওয়া, স্পেস একাডেমি ৩ বার, রোবোটিক্স একাডেমি একবার, অ্যাডভান্সড স্পেস একাডেমি থেকে কনিষ্ঠ স্নাতক, এবং একাধিক স্যালি রাইড ক্যাম্প অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা।
ওয়েবসাইটটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা তাকে নাসা টিভিতে মঙ্গল গ্রহের ভবিষ্যত মিশন নিয়ে আলোচনা করার জন্য ওয়াশিংটন ডিসিতে আয়োজিত এমইআর১০ নামে একটি প্যানেলে থাকতে আমন্ত্রণ জানায়।
এছাড়া অ্যালিসা কার্সন মঙ্গল অভিযানের বেসরকারি উদ্যোগ মার্স ওয়ানের প্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে মার্কিন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, মার্স ওয়ান ২০১৯ সালেই দেউলিয়া হয়ে যায়।
তবে, অ্যালিসা কার্সনের উক্ত ওয়েবসাইট থেকে নাসা কর্তৃক তাকে মাত্র ১১ বছর বয়সে মঙ্গল অভিযানের জন্য মনোনীত করা এবং ২০৩৩ সালে মঙ্গলে পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে তার মঙ্গলে যাওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অ্যালিসা কার্সনের সঙ্গে নাসার সম্পর্ক নিয়ে যা জানা যাচ্ছে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য অনুযায়ী, ‘অ্যালিসা কার্সন নাসার কনিষ্ঠতম সদস্য। নাসা তাকে মাত্র ১১ বছর বয়সে নাসা তাকে মনোনীত করে নেয় এবং ঘোষণা করে যে, সমস্ত অবস্থা অনুকূল হলে সে হবে ২০৩৩ সালে মঙ্গলে যাওয়া পৃথিবীর প্রথম মানুষ।’
তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, অ্যালিসা কার্সনের সঙ্গে নাসার আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্কই নেই।
এ প্রসঙ্গে আমেরিকা ভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Snopes এ ২০১৮ সালের ১৬ জুলাই ‘Is NASA Training a 17-Year-Old Girl to Be an Astronaut?‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে নাসার মুখপাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়, সেই সময়ে কার্সনকে নাসা কোনো প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না বা কোনো মিশনের জন্য প্রস্তুতও করছে না।
একই বিষয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের ৮ জুন ‘Fact Check-Alyssa Carson, 20, has not been selected for a Mars mission‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে নাসার মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, নাসার মঙ্গল অভিযান পরিকল্পনার সাথে কার্সনের সম্পর্ক নেই।
আমেরিকান ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Politifact ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই ‘NASA prepping 17-year-old Alyssa Carson to become first human on Mars‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে নাসার মুখপাত্র সেন পটারকে উদ্ধৃত করে জানায়, নাসার সঙ্গে কার্সনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই।
Politifact ছাড়াও আমেরিকান আরেকটি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান USA Today তে ২০২১ সালের ১২ জুলাই ‘Fact check: Claim about Alyssa Carson preparing to go to Mars is missing context‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে নাসার জনসংযোগ কর্মকর্তা ক্যাথারিন হামব্লেটনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, নাসা তার মূল লক্ষ্য এবং মহাকাশ অনুসন্ধানের বিষয়ে প্রচার করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলতে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। তবে তাদের সঙ্গে কার্সনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই।
পাশাপাশি অনুসন্ধানে সাম্প্রতিক সময়েও অ্যালিসা কার্সনের নাসাতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে ও তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক ও লিংকড-ইন বিশ্লেষণ করেও কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া অ্যালিসা কার্সনকে নাসার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি করা হলেও নাসার ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, নাসার সর্বকনিষ্ঠ মহাকাশচারীর নাম শেলী রাইড। তিনি ১৯৮৩ সালে ৩২ বছর ২৩ দিন বয়সে মহাকাশ অভিযানে যান।
পাশাপাশি অতীতে যে সকল প্রার্থী মহাকাশচারী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন তাদের বয়সসীমা ছিল ২৬ থেকে ৪৬ এর মধ্যে, গড় বয়স ছিল ৩৪ বছর।
বিপরীতে নাসার ওয়েবসাইট NASA TV তে ২০১৫ সালের ৬ জুলাই Mars Generation নামে একটি প্রতিবেদনে অ্যালিসা কার্সনের অর্জনের বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও সেখানে তাকে মঙ্গল অভিযানে মনোনয়নের ব্যাপারে কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। ২০১৫ সালে প্রতিবেদনটি যখন প্রকাশিত হয় তখন অ্যালিসা কার্সনের বয়স ছিল ১৪ বছর। অপরদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যমতে, নাসা তাকে ১১ বছর বয়সে মঙ্গল অভিযানের জন্য মনোনীত করেছে।
অ্যালিসা কার্সনের মঙ্গল অভিযান নিয়ে যা জানা যাচ্ছে
আমেরিকান বার্তা সংস্থা সিএনএনে ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল ‘NASA wants to land astronauts on Mars by 2033‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশটির মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ২০৩৩ সালের মধ্যে মঙ্গলে মহাকাশচারী প্রেরণে ইচ্ছুক।
তবে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, এই অভিযানের জন্য এখনো কোনো মহাকাশচারী বা নভোচারীকে নির্বাচন করা হয়নি।
পরবর্তীতে অ্যালিসা কার্সনকে নাসার এই অভিযানের জন্য মনোনীত করা সংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধানে নাসার মঙ্গল অভিযান সংক্রান্ত ওয়েবসাইট ঘেটেও এমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া অ্যালিসা কার্সনের বাবা বার্ট কার্সন তার মেয়ের মঙ্গল অভিযানের বিষয়ে ২০২১ সালে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “অ্যালিসার স্বপ্ন মঙ্গলে যাওয়া প্রথম মানুষদের একজন হওয়া৷ সে এভাবেই নিজেকে গড়ে তুলছে, যাতে সে এই অভিযানের জন্য নির্বাচিত হতে পারে।
পাশাপাশি সে বিশ্বের বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে৷ আমরা আসলে জানি না, আমাদের পরিকল্পনাটা কি হবে?”
অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত অ্যালিসা কার্সনের মঙ্গলে যাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য তার বাবা বার্ট কার্সনের কাছেও ছিল না।
এছাড়া অনুসন্ধানে মঙ্গলে অভিযানে যাওয়ার জন্য নাসার কাছে অ্যালিসা কার্সনের কোন প্রকার যৌনতা, বিয়ে বা সন্তানধারণের নিষেধাজ্ঞাপত্রতে স্বাক্ষরের দাবিতে প্রচারিত তথ্যটিরও কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
মূলত, যুক্তরাষ্ট্রের লুজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা অ্যালিসা কার্সন মাত্র তিন বছর বয়স থেকেই মহাকাশ নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় খুব অল্প বয়সেই মহাকাশ বিষয়ক একাধিক অর্জন নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে পুরে নেয়৷ ৩টি স্পেস শাটল উৎক্ষেপণ, ৭ বার স্পেস ক্যাম্পে অংশ নেওয়া, স্পেস একাডেমি ৩ বার, রোবোটিক্স একাডেমি একবার, অ্যাডভান্সড স্পেস একাডেমি থেকে কনিষ্ঠ স্নাতক, এবং একাধিক স্যালি রাইড ক্যাম্প অংশগ্রহণের অর্জন। তার এসব অর্জনের প্রেক্ষিতেই দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে যে, ‘অ্যালিসা কার্সন নাসার কনিষ্ঠতম সদস্য। নাসা তাকে মাত্র ১১ বছর বয়সে নাসা তাকে মনোনীত করে নেয় এবং ঘোষণা করে যে, সমস্ত অবস্থা অনুকূল হলে সে হবে ২০৩৩ সালে মঙ্গলে যাওয়া পৃথিবীর প্রথম মানুষ।’ তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, অ্যালিসা কার্সন নয়, নাসার সর্বকনিষ্ঠ মহাকাশচারী শেলী রাইড এবং ২০৩৩ সালে অ্যালিসা মঙ্গলে যাবেন এমন দাবিরও কোনো গ্রহণযোগ্য তথ্যপ্রমাণ নেই।
সুতরাং, অ্যালিসা কার্সনে মঙ্গল গ্রহে গিয়ে পৃথিবীতে আর ফিরে আসার দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Nasa Blueberry: https://nasablueberry.com/about/
- Mars Exploration: NASA and Smithsonian to Host 10-Year Anniversary Events for Mars Rovers
- NPR.ORG: Mars One Fizzles Into Bankruptcy After Promising A New Life In Space
- Snopes: Is NASA Training a 17-Year-Old Girl to Be an Astronaut?
- Reuters: Fact Check-Alyssa Carson, 20, has not been selected for a Mars mission
- Politifact: NASA prepping 17-year-old Alyssa Carson to become first human on Mars
- USA Today: Fact check: Claim about Alyssa Carson preparing to go to Mars is missing context
- NASA TV(1): Mars Generation
- NASA TV (2): NASA – Astronauts
- CNN: NASA wants to land astronauts on Mars by 2033