মারিয়ানা ট্রেঞ্চ ও চাঁদে যাওয়া মানুষদের সংখ্যা নিয়ে যত বিভ্রান্তি

সম্প্রতি, “হাজার হাজার মানুষ গিয়েছেন এভারেস্টের চূড়ায়। 12 জন মানুষ গিয়েছেন চাঁদে কিন্তু কেবলমাত্র তিনজন মানুষ গিয়েছেন মহাসাগরের গভীরতম স্থান ট্রেন্স এ।শীর্ষক দাবি সম্বলিত একটি ডিজিটাল ব্যানার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে  ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। 

উক্ত ব্যানারে যা দাবি করা হচ্ছে 
  • হাজার হাজার মানুষ গিয়েছেন মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়।
  • ১২ জন মানুষ চাঁদে গিয়েছেন।
  •  কেবলমাত্র ৩ জন মানুষ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ (Mariana Trench) এ গিয়েছেন।
  • মাউন্ট এভারেস্টকে যদি তুলে এনে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ অঞ্চলে ডুবিয়ে দেওয়া হয় তারপরেও এভারেস্ট শীর্ষ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১৩৩ মিটার (৭০০০ ফিট) নিচে থাকবে।
Screenshot from Facebook 

সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

উল্লেখ্য যে, এই ধরনের দাবি সংবলিত বেশ কিছু পোস্ট পূর্ববর্তী সময়েও  বিভিন্ন ফেসবুক আইডি, পেইজ এবং গ্রুপ থেকে প্রচারিত দেখা গিয়েছে। 

Screenshot from Facebook

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পূর্ববর্তী পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডিজিটাল ব্যানারে প্রচারিত তথ্যগুলোর মধ্যে ১২ জন ব্যক্তির চাঁদে যাওয়ার তথ্যটি সঠিক নয় বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণাসংস্থা (NASA) এর রিপোর্ট অনুসারে, এখন পর্যন্ত ২৪ জন মহাকাশচারী চন্দ্রভ্রমন করেছেন।

তাছাড়া ‘কেবলমাত্র ৩ জন মানুষ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ (Mariana Trench) এ গিয়েছেন’ এই দাবিটি ২০১২ পর্যন্ত ভ্যালিড থাকলেও বর্তমানে এই তথ্য সঠিক নয়। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ জনেরও অধিক ব্যক্তি বিভিন্ন সময় মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ গিয়েছেন এবং প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশের গবেষকগণ নতুন করে যেহুতু সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য যাচ্ছেন তাই, পৃথিবীর গভীরতম স্থানে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পাবে।

তবে, ডিজিটাল ব্যানারে করা প্রথম এবং চতুর্থ দাবির সত্যতা খুঁজে পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

প্রথম দাবি যাচাই 

দাবি

হাজার হাজার মানুষ গিয়েছেন মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়।

ফ্যাক্ট

ডিজিটাল ব্যানারে প্রচারিত প্রথম দাবিটির সত্যতা খুঁজে পেয়েছে রিউমার স্ক্যানার টিম।

মাউন্ট এভারেস্ট শুধুমাত্র পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গই বরং এটি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় একটি ট্যুরিস্ট স্পট যেখানে প্রতিবছর প্রায় 35 হাজার পর্যটক এখানে ভ্রমনে আসেন। তাছাড়া ১৯৫৩ সালের মে মাসের ২৯ তারিখ এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে কর্তৃক যৌথভাবে বিশ্বে সর্বপ্রথম পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট পর্বত জয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার পর্বতারোহী কর্তৃক ১১ হাজারের অধিকবার ব্যক্তির মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে আরোহণের তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া, এই তালিকাটিতে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণ করা প্রায় ছয় হাজারের অধিকসংখ্যক ব্যক্তির বিস্তারিত তালিকা খুজে পাওয়া যায়। 

সুতরাং মাউন্ট এভারেস্ট পর্বতে হাজার হাজার মানুষ যাওয়ার তথ্যটি সত্য।

দ্বিতীয় দাবি যাচাই

দাবি

১২ জন মানুষ চাঁদে গিয়েছেন।

ফ্যাক্ট

রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত ১২ জন্য ব্যক্তির চাঁদে যাওয়ার তথ্যটি সঠিক নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা 

National Aeronautics and Space Administration (NASA) এর তথ্যমতে, ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত হওয়া Apollo এর বিভিন্ন মিশনে সর্বমোট ২৪ জন মহাকাশচারী চাঁদে ভ্রমন করেন। এই ২৪ জন মহাকাশচারীদের মধ্য থেকে তিনজন মহাকাশচারী দুইবার করে চাঁদে গিয়েছিলো। 

থেকে চাঁদে যাওয়া এই ২৪ জন মহাকাশচারীর মধ্য থেকে ১২ জন মহাকাশচারী তৎকালীন সময়ে চাঁদের মাটিতে হেঁটেছিল এবং বাকি ১২ জন ব্যক্তি নিজেদের মহাকাশযানেই অবস্থান করে। 

Screenshot from NASA

উল্লেখ্য যে ১৯৭২ সালের পর নাসা আর চাঁদে মানুষ পাঠায়নি এবং নাসা ব্যতীত অন্য কোনো মহাকাশ সংস্থা এখন পর্যন্ত চাঁদে মানুষ প্রেরণ করতে সক্ষম হয়নি

সুতরাং এখন পর্যন্ত কেবল ১২ জন মানুষ চাঁদে গিয়েছে শীর্ষক দাবিটি সত্য নয়। 

তৃতীয় দাবি যাচাই

দাবি

কেবলমাত্র ৩ জন মানুষ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ (Mariana Trench) এ গিয়েছেন।

ফ্যাক্ট

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায় কেবলমাত্র ৩ জন ব্যক্তির মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ যাওয়ার বিষয় টি সত্য নয়। বরং বর্তমান সময় পর্যন্ত মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ ভ্রমণ করা ব্যক্তিদের সংখ্যা অন্ততপক্ষে ২০ জনের অধিক।

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ হচ্ছে বিশ্বের গভীরতম সমুদ্র খাত যা প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে অবস্থিত। এর অবস্থান প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তে মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের ঠিক পূর্বে অবস্থিত। এই খাতের গভীরতম অংশটিকে বলা হয় চ্যালেঞ্জার ডিপ (Challenger Deep)। পানির অত্যধিক চাপ, নিম্ন তাপমাত্রা, অন্ধকারোচ্ছন্নতা সহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে খুব অল্প সংখ্যক মানুষই মারিয়ানা খাতে যেতে পেরেছে। 

১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, এখন পর্যন্ত জানাবিপৃথিবীর সবচাইতে গভীরতম  এই স্থানটিতে গিয়েছিলেন সুইস  প্রকৌশলী জাক পিকার ও মার্কিন নৌবাহিনীর লিউট্যান্যান্ট ডোনাল্ড ওয়াল্‌শ।

অতঃপর ২০১২ সালের মার্চ মাসে ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে Deepsea Challenger নামক যানের মাধ্যমে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ গিয়েছিলেন চলচিত্র নির্মাতা জেমস ক্যামেরুন। 

অর্থাৎ ২০১২ সাল পর্যন্ত মাত্র ৩ জন ব্যক্তি মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ গিয়েছিলেন।

কিন্তু, অতপর ২০১৯ সালে থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত Limiting Factor নামক deep-submergence vehicle এর মাধ্যমে আরো একাধিক মানুষের মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ যাওয়ার বিশ্বস্ত সূত্র ইন্টারনেটে খুজে পাওয়া যায়। 

গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ওয়েবসাইটের  এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২৬ জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ১৩ জন ব্যক্তি মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর চ্যালেঞ্জারস ডিপ নামক অঞ্চলে গিয়েছিলেন। তবে এই সময় পরবর্তীতে মারিয়ানা খাতে আর কতজন মানুষ গিয়েছিলো সেই ব্যাপারে ‘Guinness book of world record’ এর তরফ থেকে তেমন কিছু জানা না গেলেও বিভিন্ন সময়ে আরো বেশ কয়েকজন  ব্যক্তি কর্তৃক চ্যালেঞ্জার্স ডিপ এ যাওয়ার তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। 

২৬ জুন ২০২০ পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকজন ব্যক্তি কর্তৃক মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ যাওয়া সম্পর্কিত কিছু রিপোর্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। 

তাছাড়া চীনের একটি সরকারি ওয়েবসাইটের একটি প্রতিবেদনে প্রায় ২৭ জন  বিজ্ঞানীর চ্যালেঞ্জার্স ডিপ এ যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।

Screenshot from english.www.gov.cn

সুতরাং ২০২৩ সালে এসে “কেবলমাত্র তিনজন ব্যক্তি” মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ গিয়েছে এই ধরনের দাবি করলে সেটি ভিত্তিহীন দাবি হিসেবেই পরিগণিত হবে। 

এই আর্টিকেল লেখাকালীন সময় পর্যন্ত ঠিক কতজন ব্যক্তি মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ গিয়েছে সে ব্যাপারে সুবিন্যস্ত কোনো তালিকা ইন্টারনেটে খুজে না পাওয়া গেলেও গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড, চীনের সরকারি ওয়েবসাইট এবং আরো কিছু নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের আলোকে অন্ততপক্ষে ২০ জনের অধিক ব্যক্তির মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ যাওয়ার তথ্য খুঁজে পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম।

তবে এই ২০ জনের হিসাবটি কেবলই ন্যূনতম হিসাব। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে ঠিক কতজন মানুষ মারিয়ানা ট্রাঞ্চের চ্যালেঞ্জার ডিপ এ গিয়েছিল তার সুবিন্যস্ত কোনো তালিকা পাওয়া যায়নি। তাই  ঠিক কতজন সেখানে গিয়েছিলো সে ব্যাপারে আপাতত সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব না। 

তাছাড়া বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীগণ যেহুতু প্রতিনিয়তই যেহুতু মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ গবেষণার জন্য যাচ্ছে তাই তাই ভবিষ্যতে পৃথিবীর গভীরতম স্থানে মানুষ যাওয়ার সংখ্যা যে আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। 

চতুর্থ দাবি যাচাই

দাবি

মাউন্ট এভারেস্টকে যদি তুলে এনে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ অঞ্চলে ডুবিয়ে দেওয়া হয় তারপরেও এভারেস্ট শীর্ষ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১৩৩ মিটার (৭০০০ ফিট) নিচে থাকবে।

ফ্যাক্ট

রিউমার স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডিজিটাল ব্যানারে প্রচারিত তথ্যগুলোর মধ্যে এই দাবিটি সত্য। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের National Oceanic and Atmospheric Administration একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মারিয়ানা ট্রাঞ্চের গভীরতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১০,৯৩৫ মিটার (৩৫,৮৭৬ ফুট)। 

অন্যদিকে, বিবিসির এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা প্রায় ৮,৮৪৯ মিটার (২৯,০৩২ ফুট)। 

এখন তাত্ত্বিকভাবে যদি, মাউন্ট এভারেস্ট কে মারিয়ানা ট্রাঞ্চ অঞ্চলে ডুবিয়ে দেওয়া হয় তাহলেও এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় (১০৯৩৫-৮৮৪৯ )বা ২০৮৬ মিটার নিচে থাকবে যেই মানটি কে ডিজিটাল ব্যানারে থাকা মান (২১৩৩ মিটার) থেকে প্রায় ৪৭ মিটার বেশি। কিন্তু

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এবং মাউন্ট এভারেস্টের  এর পরম উচ্চতা (Absolute Height)  নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে, সে হিসেবে এই পার্থক্য খুব একটা বেশি না। 

সুতরাং ডিজিটাল ব্যানারে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর উচ্চতার ব্যাপারে ডিজিটাল ব্যানারে থাকা চতুর্থ দাবিটি সত্য। 

মূলত, এখন পর্যন্ত মোট ২৪ জন মানুষ চাঁদে গিয়েছেন এবং এদের মধ্য থেকে ১২ জন মানুষ চাঁদে হেঁটেছেন। তাই কেউ যদি মাত্র ১২ জন মানুষ চাঁদে গিয়েছেন এই দাবি করেন তাহলে সেটি সঠিক নয়। 

অপরপক্ষে, এখন পর্যন্ত কেবলমাত্র ৩ জন মানুষ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ গিয়েছেন এই দাবিটি ২০১২ সাল পর্যন্ত সঠিক ছিলো। ২০১২ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত আরো অনেক মানুষ মারিয়ানা ট্রেঞ্চে যাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও এই সংখ্যাটি বাড়ার সম্ভাবনা আছে। তাই ২০২৩ সালে এসে “কেবলমাত্র তিনজন ব্যক্তি” মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ গিয়েছে এই ধরনের দাবি করলে সেটি ভিত্তিহীন দাবি হিসেবেই পরিগণিত হবে।

সুতরাং রিউমর স্ক্যানার টিমের বিস্তর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডিজিটাল ব্যানারের মাধ্যমে প্রচারিত ভাইরাল ফেসবুক পোস্টটিতে করা ৪টি দাবির ২টি দাবি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img