১৯১১ সালে ইতালিতে ট্রেন গায়েব হয়ে যাওয়ার সাথে টাইম ট্রাভেলের গল্প ফেঁদে গুজব

গেল বেশ কয়েক বছর ধরেই ইতালির একটি ট্রেন ঘিরে ইন্টারনেটে ব্যাপক আলোচনা হয়ে আসছে৷ ১৯১১ সালের ঘটনা দাবি করে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ সংক্রান্ত আলোচনায় বলা হচ্ছে, সে বছর (১৯১১) ইতালির জেনেটি নামে একটি রেল সংস্থা একটি ট্রেন চালু করে। উদ্বোধনের দিন সব যাত্রীকে বিনা টিকিটে ঘোরানোর ব্যবস্থা করেছিল সংস্থাটি। ছয়জন রেলকর্মী এবং ১০০ যাত্রী নিয়ে রওনা দিয়েছিল ট্রেনটি। কিন্তু গন্তব্যে আর পৌঁছায়নি। মাঝ পথে রহস্যজনকভাবে আস্ত ট্রেনটিই গায়েব হয়ে যায়! আজ পর্যন্ত যার কোনো খোঁজও মেলেনি। খোঁজ পাওয়া যায়নি যাত্রীদেরও। দাবি করা হচ্ছে, যাত্রাপথে একটি সুড়ঙ্গ পড়েছিল। ট্রেন সেই সুড়ঙ্গে প্রবেশ তো করেছিল কিন্তু আর বের হয়নি। পরবর্তীকালে ট্রেনের সন্ধানে সুড়ঙ্গের মধ্যে অনেকেই গেছেন। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি হওয়া ওই সুড়ঙ্গের ভেতর আর কোনো রাস্তাও ছিল না। ট্রেন দুর্ঘটনারও কোনো চিহ্ন মেলেনি। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে এমন দাবিও করা হচ্ছে যে, ট্রেনের মধ্যে থাকা ১০৬ জনের মধ্যে দু’জনের সন্ধান পাওয়া যায়। টানেলের বাইরে থেকে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়। তবে তারা কোনো তথ্যই দিতে পারেননি ট্রেনের বিষয়ে। অগোছালো কথা বলছিলেন তারা। বলা হয়ে থাকে, সুড়ঙ্গে প্রবেশের মুহূর্তে সাদা ধোঁয়া গ্রাস করেছিল ট্রেনটিকে। সেই সময় কোনোক্রমে দুজন ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেন। তার পর আর কিছু মনে ছিল না তাদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমা পড়ে সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খোঁজও থামিয়ে দিতে হয়। 

তবে এই রহস্যের এখানেই শেষ নয়। প্রতিবেদনগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, অনেক বছর পর মেক্সিকোর এক চিকিৎসক দাবি করেন, অনেক বছর আগে মেক্সিকোর একটি হাসপাতালে নাকি ওই ১০৪ যাত্রীকে ভর্তি করা হয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই অসংলগ্ন কথা বলছিলেন। প্রত্যেকেই কোনো একটি ট্রেনের উল্লেখ করেছিলেন। সেই ট্রেনে করেই নাকি তারা মেক্সিকো পৌঁছেছিলেন। এমনকি ইতালির বিভিন্ন প্রান্তে, জার্মানি, রোমানিয়া এবং রাশিয়াতেও নাকি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ ঠিক ওই রকমই একটি যাত্রীবোঝাই ট্রেন দেখতে পেয়েছেন বলে দাবি করতে শুরু করেছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা ট্রেনের যে বর্ণনা দিয়েছিলেন তা হুবহু ওই অদৃশ্য হওয়া ট্রেনটির মতো ছিল। সেই সময় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ট্রেনটি নাকি ট্রাইম ট্রাভেল করে ১৮৪০ (মতান্তরে ১৮৪৫) সালের মেক্সিকোয় পৌঁছে গিয়েছিল।

উক্ত দাবিতে সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন বিজয় টিভি (ফেসবুক), আরটিভি (ফেসবুক), মাই টিভি (ফেসবুক)৷ 

ট্রেন গায়েব

সাম্প্রতিক সময়ে উক্ত দাবিতে প্রচারিত ফেসবুকের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে টিকটকের কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

একই দাবিতে গণমাধ্যমের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে একই দাবিতে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন একাত্তর টিভি (২০২১), সময় টিভি (২০২১), ডিবিসি নিউজ (২০২১), যমুনা টিভি (২০২১), ইনকিলাব (২০২১), যুগান্তর (২০২১),  বাংলাদেশ প্রতিদিন (২০২১), ঢাকা টুডে (২০২১), ডেল্টা টাইমস (২০২১), নিউজ২৪ (২০২১), বিবার্তা১৪ (২০২১), একুশে টিভি (২০২১), ঢাকা টাইমস (২০২১), জাগোনিউজ২৪ (২০২১), ডেইলি বাংলাদেশ (২০২২)। 

একই দাবিতে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন নিউজ১৮

ফ্যাক্টচেক 

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯১১ সালে ইতালিতে ১০৬ জন নিয়ে কোনো ট্রেন গায়েব হয়ে যায়নি বরং সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে অস্তিত্বহীন একটি ট্রেন সংস্থার নামে কথিত এই ঘটনাটি প্রচার হয়ে আসছে৷  

কথিত এই রহস্যজনক ঘটনাটির বিষয়ে অনুসন্ধানে শুরুতে একাধিক কিওয়ার্ড সার্চ করে মূলধারার আন্তর্জাতিক কোনো নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমেই এ সংক্রান্ত ঘটনার সংবাদের অস্তিত্ব মেলেনি। অথচ কথিত এই ঘটনার উল্লিখিত সময়কালের (১৯১১) পরের বছরই (১৯১২) পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম  আলোচিত টাইটানিক জাহাজ দুর্ঘটনার খবর একাধিক সংবাদমাধ্যম (, ) ও নির্ভরযোগ্য সূত্রেই (, ) রয়েছে। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার বিষয়টি যেভাবে গণমাধ্যমে এসেছে ঠিক সেভাবে ইতালির কথিত ট্রেনটি গায়েবের বিষয়টিও আলোচনায় থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন কোনো ঘটনার উল্লেখই পাওয়া যায়নি ইতালি কিংবা আন্তর্জাতিক নির্ভরযোগ্য কোনো গণমাধ্যমেই। 

কথিত ঘটনাটি ‘ইতালির জেনেটি নামে একটি রেল সংস্থার ট্রেনের’ শীর্ষক দাবির প্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে এই নামে ইতালিতে কোনো ট্রেন সংস্থার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আমরা উইকিপিডিয়ার একটি পেজে ইতালিতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া রেল কোম্পানিগুলোর একটি তালিকা পেয়েছি যাতে জেনেটি নামে কোনো কোম্পানির নাম উল্লেখ নেই। রেল কোম্পানি না থাকলেও ইতালিতেই এই নামের সাথে জড়িয়ে অন্তত দুইটি কোম্পানির (, ) হদিস মিলেছে। একইসাথে ইতালির ট্রেন দুর্ঘটনার ইতিহাস ঘেঁটেও এই দুর্ঘটনার বিষয়ে কোনো তথ্য মেলেনি। 

অর্থাৎ, অস্তিত্বহীন একটি ট্রেন সংস্থার নামে কথিত ঘটনাটি প্রচার করা হচ্ছে। 

খেয়াল করে দেখুন, কথিত এই ঘটনায় যে ১০৬ জন যাত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিষয়ে বলা হচ্ছে সেখানে এদের কারো নামই উল্লেখ নেই। এমনকি যে দুইজন পরবর্তীতে উদ্ধার হয়েছিল বলে দাবি করা হচ্ছে, তাদের পরিচয়ও কোনো সূত্রে পাওয়া যায়নি। 

তাছাড়া, যে সুড়ঙ্গে ট্রেনটি হারিয়ে যাওয়ার দাবি করা হচ্ছে তা নিয়েও আছে ধোঁয়াশা৷ কারণ, গণমাধ্যমের এ সংক্রান্ত দাবি সম্বলিত প্রতিবেদনগুলোতে সুড়ঙ্গের যে ছবিগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্থানের সুড়ঙ্গ। দেখুন এখানে, এখানে

আমরা মেক্সিকোর কথিত সেই চিকিৎসকের বিষয়েও খোঁজ নিয়েছি যিনি দাবি করেছেন, অনেক বছর আগে মেক্সিকোর একটি হাসপাতালে ওই ১০৪ যাত্রীকে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু উক্ত চিকিৎসকের বিস্তারিত পরিচয় এ সংক্রান্ত দাবিগুলোতে উল্লেখ না থাকায় অনুসন্ধানে কোনো তথ্য মেলেনি। 

আবার কথিত এই ট্রেনটি ট্রাইম ট্রাভেল করে ১৮৪০ সালের মেক্সিকোয় পৌঁছে গিয়েছিল বলে যে দাবি এসেছে, তার বিষয়েও নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে তথ্য মেলেনি। ১৮৪০ এর দশকের মধ্যভাগে মেক্সিকোতে রেললাইন নির্মাণ শুরু নয় পরিসেবা চালু হয় হয়। সেসময় বা এরপর দেশটির ট্রেন পরিসেবায় টাইম ট্রাভেলের কোনো ঘটনার বিষয়ে জানা যায়নি। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাও বলছে, পৃথিবীতে টাইম ট্রাভেল করে অতীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্তত বৈজ্ঞানিকভাবে এটি প্রমাণের কোনো সুযোগ নেই এখনো। 

তাহলে ঘটনাটি রটলো কীভাবে এমন প্রশ্নে ই-বরঘি নামে ইতালিরই ভ্রমণ বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে কিছু তথ্যের সন্ধান মিলেছে। তারা দাবি করছে, জেনেটি ট্রেনের গল্পটি ইউক্রেনের লেখক নিকোলে চেরকাশিনের একটি কল্পকাহিনীর সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। মার্কিন ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান স্নোপসও ২০২২ সালে আলোচিত এই ঘটনাটি ভুয়া প্রমাণে একই ওয়েবসাইটের তথ্য ব্যবহার করেছে৷ 

স্নোপস বলছে, এই কল্পকাহিনী পরবর্তীতে ইন্টারনেটে সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়ে বাস্তব দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। 

মূলত, কয়েক বছর ধরেই ইতালির একটি ট্রেনের ঘটনা দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে,  ১৯১১ সালে ইতালির জেনেটি নামে একটি রেল সংস্থা একটি ট্রেন চালু করার পর সে বছর ছয়জন রেলকর্মী এবং ১০০ যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে ট্রেনটি। কিন্তু গন্তব্যে আর পৌঁছায়নি। যাত্রাপথে একটি সুড়ঙ্গ পড়েছিল। ট্রেন সেই সুড়ঙ্গে প্রবেশ তো করেছিল কিন্তু আর বের হয়নি। ট্রেনের মধ্যে থাকা ১০৬ জনের মধ্যে দু’জনের সন্ধান পাওয়া যায়। টানেলের বাইরে থেকে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়। তবে তারা কোনো তথ্যই দিতে পারেননি ট্রেনের বিষয়ে। দাবি করা হচ্ছে, অনেক বছর পর মেক্সিকোর এক চিকিৎসক বলেছেন, অনেক বছর আগে মেক্সিকোর একটি হাসপাতালে ওই ১০৪ যাত্রীকে ভর্তি করা হয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই অসংলগ্ন কথা বলছিলেন। প্রত্যেকেই কোনো একটি ট্রেনের উল্লেখ করেছিলেন। সেই ট্রেনে করেই নাকি তারা মেক্সিকো পৌঁছেছিলেন। ট্রেনটি নাকি ট্রাইম ট্রাভেল করে ১৮৪০ সালের মেক্সিকোয় পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে দেখেছে, কথিত এই ট্রেনটির গায়েব হওয়া ঘটনাটির বাস্তব কোনো প্রমাণ নেই। আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোনো খবর না পেয়ে ঘটনার নানা দিক অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, জেনেটি নামে কখনোই কোনো ট্রেন সংস্থা ছিল না ইতালিতে। তাছাড়া, ট্রেনে থাকা ১০৬ জন ভ্রমণকারীর পরিচয়ও কোথাও উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই, সেই চিকিৎসকের পরিচয়ও যিনি দুইজন যাত্রীর বিষয়ে বলেছেন দাবি করা হয়। নাসা বলছে, টাইম ট্রাভেল করে অতীতে ফেরার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। এক্ষেত্রে তাই কথিত এই ট্রেনটির ১৮৪০ সালের মেক্সিকোতে যাওয়াও সম্ভব নয়।

সুতরাং, ১৯১১ সালে ইতালিতে ১০৬ জন নিয়ে কথিত একটি ট্রেন গায়েব হয়ে যাওয়ার পর সেটি ট্রাইম ট্রাভেল করে ১৮৪০ সালের মেক্সিকোয় পৌঁছে গিয়েছিল শীর্ষক দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র 

আরও পড়ুন

spot_img