সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ১২ টি দেশ বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ১২ টি দেশ বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং জাতীয় দৈনিক আজকের পত্রিকা’র খবরের সূত্রে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় কিছু দেশ কর্তৃক তাদের বাজারে থাকা সংশ্লিষ্ট পোশাক প্রত্যাহারের ঘটনাকে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। তাছাড়া, আজকের পত্রিকা চলতি বছর পোশাক প্রত্যাহারের দাবিতে তিনটি দেশের নাম উল্লেখ করেছে যারা এই তালিকাতেই নেই৷
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে এ সংক্রান্ত পোস্টগুলোতে একটি সংবাদকে সূত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। জাতীয় দৈনিক ‘আজকের পত্রিকা’র প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম ছিল, “১২ দেশে বাংলাদেশের পোশাক প্রত্যাহার।”
পত্রিকাটির প্রিন্ট সংস্করণে গত ০৫ নভেম্বর লিড নিউজ হিসেবে ছাপা (আর্কাইভ) হয় সংবাদটি৷
রিউমর স্ক্যানার টিম পুরো প্রতিবেদনটি পড়ে দেখেছে, যার সারমর্ম দাঁড়াচ্ছে, ‘স্বাস্থ্যঝুঁকির’ অজুহাতে চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশের বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি হওয়া নানা ব্র্যান্ডের পোশাক। সর্বশেষ কানাডা সরকার বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি হওয়া জর্জ ব্র্যান্ডের ২ লাখ ১৬ হাজারের বেশি পোশাক ক্রেতাদের কাছ থেকে ফেরত নিতে বলেছে বৈশ্বিক চেইনশপ ওয়ালমার্টকে।
গত ৩ অক্টোবর কানাডা সরকার সে দেশের সরকারি ওয়েবসাইটে এ ব্যাপারে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে যাওয়া জর্জ ব্র্যান্ডের এসব পোশাক ওয়ালমার্টে ফেরত দেওয়ার জন্য গ্রাহকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
ওয়ালমার্টে বিক্রির জন্য জর্জ ব্র্যান্ডের এই পোশাকগুলো তৈরি হয়েছে গাজীপুরের ইউনিক ডিজাইনার্স লিমিটেড নামের একটি কারখানায়।
পোশাকগুলোর ত্রুটি নিয়ে ইউনিক ডিজাইনার্স লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আজকের পত্রিকা। প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলছেন, ‘কানাডায় ওয়ালমার্টকে সরবরাহের জন্য সিঙ্গাপুরভিত্তিক বায়িং হাউস পিডিএস-ফারইস্ট লিমিটেড আমাদের কাছে যে মান ও গুণের পণ্য চেয়েছিল, আমরা তাদের সেই মানের পণ্য সরবরাহ করেছি। এখানে যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকে, সেটি পিডিএস থাকতে পারে, এখানে আমাদের কোনো দায় নেই।’
বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে অর্থনৈতিক ও আর্থসামাজিক নীতি সহায়তা প্রদান করা সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) তথ্যমতে, কানাডা ছাড়াও চলতি ২০২৩ সালে ১১টি দেশের বাজার থেকে বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি হওয়া পোশাক উঠিয়ে নিতে বাধ্য করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো।
ওইসিডির তথ্যের বরাত দিয়ে আজকের পত্রিকা লিখেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে, সেগুলোর মধ্যে আছে পোশাক পরার কারণে শ্বাসরোধ ও আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা, ঢিলেঢালা হওয়ার কারণে আগুনের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি, পোশাকে অতিমাত্রায় রাসায়নিক পদার্থ থাকা, আগুন প্রতিরোধী মান নিশ্চিত না হওয়া প্রভৃতি।
আজকের পত্রিকা’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে। যদিও ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদনটি ইতোমধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তাছাড়া, সেদিন একই সংবাদ প্রকাশ করেছে, এমন কিছু গণমাধ্যমের তালিকায় রয়েছে ইনকিলাব, জুম বাংলা, ঢাকা প্রকাশ।
আজকের পত্রিকা এবং এ সংক্রান্ত অন্য প্রতিবেদনগুলো কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রত্যাহারের বিষয়টি তুলে ধরলেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বন্ধ করা হয়েছে শীর্ষক কোনো তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি প্রতিবেদনগুলোতে।
রিউমর স্ক্যানার টিম পরবর্তীতে আজকের পত্রিকা’র প্রতিবেদনে উল্লিখিত এ সংক্রান্ত তথ্যগুলো যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
গত ৩ অক্টোবর কানাডা সরকার সে দেশের সরকারি ওয়েবসাইটে এ ব্যাপারে যে বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করেছিল তাতে আজকের পত্রিকা’র উল্লিখিত তথ্যগুলোই উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, এসব পোশাকের ব্যাপারে কানাডার স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, জর্জ ব্র্যান্ডের রাতে পরার পোশাকের জিপারের বর্ধিতাংশ ভেঙে যেতে পারে এবং পায়ের ও গলার গ্রিপ বারবার ধোয়ার ফলে চেপে যেতে পারে, যা ওই পোশাক পরা ব্যক্তির দম বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
তবে বিজ্ঞপ্তিতে এও উল্লেখ রয়েছে, গেল ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পোশাকগুলোর বিষয়ে গ্রাহক পর্যায় থেকে কোনো অভিযোগ পায়নি কোম্পানি। এই তথ্য অবশ্য আজকের পত্রিকা উল্লেখ করেনি।
বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান বলছেন, অভিযুক্ত পোশাকগুলো ২০২২ সালের প্রথম দিকে পাঠানো হয়েছিল। সে বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত পোশাকগুলো বিক্রি হয়েছে, যা কানাডা সরকারের বিজ্ঞপ্তিতেও উল্লেখ রয়েছে।
বিজিএমইএ’র বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা জানাচ্ছে, এই পোশাকগুলো দামও মিটিয়ে দিয়েছে ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো।
স্লিপারগুলো প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশের ইউনিক ডিজাইনার্স লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ফরিদ আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “ওয়ালমার্ট আমাদের অর্ডার দেয়া বন্ধ করেনি। আমাদের কারখানায় উৎপাদন চলছে। তবে এবার তারা আমাদের ভিন্ন রকম জিপার লাগাতে বলছে, আমরা সেটাই করছি।”
বিজিএমইএ বলছে, ক্রেতারা অর্ডার দেয়ার সময় পণ্যের যাবতীয় বিবরণ দিয়ে থাকে এবং সেই অনুযায়ী পণ্য বানানো হয়। এরপর নমুনা পাঠানো হলে সেটির অনুমোদনের পর মালামাল শিপমেন্ট করা হয়। স্যাম্পল অনুযায়ী পণ্য না পাঠানো হলে অর্ডারই বাতিল হয়ে যেতে পারে। ফলে এক্ষেত্রে বাংলাদেশি কারখানাগুলোর কোন দায় নেই।
তাদের দাবি, বাংলাদেশ থেকে যখন বিদেশে পণ্য যায়, তখন সেটি সব ধরনের মান উত্তীর্ণ হয়ে ক্রেতাদের চূড়ান্ত অনুমোদন শেষেই পাঠানো হয়।
অর্থাৎ, কানাডায় বাংলাদেশের তৈরি যেসব পোশাক প্রত্যাহার হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কারখানার কোনো দায় নেই। এসব পোশাকের বিষয়ে কোনো ক্রেতা অভিযোগও করেনি। উপরন্তু পোশাকের দামও মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের কারখানাকে৷
ওইসিডির ওয়েবসাইটে ফিল্টারিং সার্চের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত চলতি বছর ১০ টি দেশ থেকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটেছে। এই তালিকায় রয়েছে স্লোভাকিয়া, লিথুনিয়া (১, ২), অস্ট্রেলিয়া, বুলগেরিয়া, ইতালি (১, ২), অস্ট্রিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং সাইপ্রাস। এর বিপরীতে একই সূত্রের বরাতে আজকের পত্রিকা যে ১২ টি দেশের নাম উল্লেখ করেছে তারা হলো স্লোভাকিয়া, লিথুয়ানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, বুলগেরিয়া, ইতালি, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, সাইপ্রাস, কানাডা, পোল্যান্ড, স্লোভেনিয়া, এস্তোনিয়া। কিন্তু ওইসিডির তালিকায় কানাডা, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, স্লোভেনিয়া নেই যা আজকের পত্রিকা উল্লেখ করেছে। তবে কানাডার সরকারি ওয়েবসাইটে পোশাক প্রত্যাহার সংক্রান্ত তথ্য উপরেই উল্লেখ করেছি আমরা। এর বাইরে বাকি দেশগুলোর মধ্যে পোল্যান্ডের নাম ২০২১ সালের তালিকায় উল্লেখ পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, আজকের পত্রিকা চলতি বছর পোশাক প্রত্যাহারের দাবিতে তিনটি দেশের নাম উল্লেখ করেছে যারা এই তালিকাতেই নেই৷
তাছাড়া, ওইসিডির চলতি বছরের তালিকায় যে ১০ টি দেশের নাম উল্লেখ রয়েছে এদের ক্ষেত্রে কানাডার মতোই ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কারখানার কোনো দায় নেই। এসব পোশাকের বিষয়ে কোনো ক্রেতা অভিযোগও করেনি।
ওইসিডির তথ্য-উপাত্তের বরাতে আজকের পত্রিকা ২০২২ সালে এই রকম ঘটনা চারবার এবং ২০২১ সালে পাঁচবার ঘটার বিষয়ে উল্লেখ করেছে। ওইসিডির ওয়েবসাইট ঘেঁটে বিষয়টির সত্যতা মিলেছে।
এই ঘটনা যে একেবারেই নতুন বা বাংলাদেশের সাথেই ঘটছে এমনও নয়। উন্নত দেশগুলোতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নানা কারণে অনেক সময় বিভিন্ন পোশাক ও পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে থাকে। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পোশাক, প্রসাধনী পণ্য বাজার থেকে তুলে নেয়ার উদাহরণ হয়েছে। ওইসিডির ওয়েবসাইটে বিভিন্ন দেশের সাথে ঘটা এমন ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
মূলত, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ১২ টি দেশ বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে শীর্ষক একটি দাবি জাতীয় দৈনিক আজকের পত্রিকা’র বরাতে ইন্টারনেটে প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে দেখেছে, আজকের পত্রিকার এ সংক্রান্ত সংবাদ বা অন্য কোনো গণমাধ্যমে পোশাক রপ্তানি বন্ধ হওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ নেই। পণ্য প্রত্যাহার করার গ্লোবাল প্লাটফর্ম হিসেবে পরিচিত অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) জানাচ্ছে, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় চলতি বছর ১০ টি দেশ কর্তৃক তাদের বাজারে থাকা সংশ্লিষ্ট পোশাক প্রত্যাহার করেছে। এর বাইরে কানাডা সরকারও তাদের দেশে এমন ঘটনা ঘটার বিষয়ে জানিয়েছে। কিন্তু আজকের পত্রিকা চলতি বছর পোশাক প্রত্যাহারের দাবিতে এই তালিকার বাইরেও আরও তিনটি দেশের নাম উল্লেখ করেছে যারা এই তালিকাতেই নেই৷ তাছাড়া, এসব পোশাক রপ্তানি পরবর্তী সময়ে বাজার থেকে প্রত্যাহার হওয়ায় সংশ্লিষ্ট পোশাক কারখানার এ ঘটনার জন্য দায় নেই এবং কারখানাতে সংশ্লিষ্ট দেশের পোশাক তৈরির কার্যাদেশও বন্ধ হয়নি বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। এমনকি এসব পোশাকের বিষয়ে কোনো ক্রেতা অভিযোগও করেনি। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো কিছু পোশাকে’ স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকায় কেবল সেগুলোই বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সুতরাং, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকায় বাংলাদেশের রপ্তানি করা কিছু পোশাক কিছু দেশের বাজার থেকে প্রত্যাহারের ঘটনাকে ১২ টি দেশ বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে শীর্ষক দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Recalls and safety alerts: George Brand Sleepers recalled due to choking and ingestion hazards
- OECD: Recall Bangladesh
- BGMEA: Facebook Post
- BBC Bangla: কিছু দেশে তৈরি পোশাক প্রত্যাহারের বিষয়ে কী জানা যাচ্ছে
- Rumor Scanner’s own investigation