রাজশাহী এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর নয়

সম্প্রতি, রাজশাহীকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর দাবি করে গণমাধ্যম এবং ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে একটি তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে।

উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু ‘সংবাদ’ দেখুন একাত্তর টিভি (আর্কাইভ), যুগান্তর (আর্কাইভ)।

Screenshot source: Facebook 

একই দাবিতে কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

Screenshot source: Facebook 

একই দাবিতে প্রচারিত কিছু ইউটিউব ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

Screenshot source: YouTube

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজশাহী এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর নয় বরং কোনো প্রকার তথ্যসূত্র ছাড়াই গণমাধ্যমে উক্ত দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে। 

কী দাবি করছে একাত্তর টেলিভিশন?

সাম্প্রতিক সময়ে মূলধারার গণমাধ্যম একাত্তর টিভির একটি ভিডিও প্রতিবেদন থেকে ‘রাজশাহী এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর’ শীর্ষক তথ্যটি ছড়িয়ে পড়তে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।  

একাত্তর টিভির ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুক পেজে গত ১৯ মার্চ প্রকাশিত এ সংক্রান্ত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, শুরুর দিকে (১ম ছয় সেকেন্ডের মধ্যে) প্রতিবেদনটির বিষয়ে সংবাদ পাঠিকা বলেন, “রাজধানী ঢাকা যখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তখন রাজশাহী শহর মর্যাদা পাচ্ছে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে। দূষণ, যানজট জলজট আর মশার উপদ্রবহীন সবুজ নগরীতে পরিণত হয়েছে রাজশাহী। মেয়র জানালেন তার কিছু ভিন্নধর্মী উদ্যোগ ও নগরবাসীর সহযোগিতায় দেশের সেরা শহরে রূপ নিয়েছে রাজশাহী।”

বিস্তারিত প্রতিবেদনে প্রতিবেদক এবং রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের বক্তব্যে রাজশাহী এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর শীর্ষক কোনো তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

Screenshot source: YouTube

অর্থাৎ, প্রতিবেদনের শিরোনাম, থাম্বনেইল ও সংবাদ পাঠিকার বক্তব্যে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর রাজশাহী হিসেবে দাবি করা হলেও মূল প্রতিবেদনের কোথাও এ বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি।  

এছাড়া, জাতীয় দৈনিক যুগান্তর গত ২০ মার্চ এ সংক্রান্ত একটি ফেসবুক পোস্টে কোনো সূত্র ছাড়াই “এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর রাজশাহী” শীর্ষক তথ্য উল্লেখ করেছে। 

Screenshot source: Facebook

অনুসন্ধান এগিয়েছে যেভাবে

এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর এবং প্রাসঙ্গিক শব্দগুলো কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা প্রতিবেদন খুঁজে পায়নি। 

পরবর্তীতে একাত্তর টিভির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পরিচ্ছন্ন শহরের দাবিতে করা ভিডিওতে শহরটির আলোকোজ্জ্বল রাস্তার বর্ণনা এসেছে, যা পরিচ্ছন্নতার মানদণ্ড নয়।

ভিডিওতে বলা হয়, “নিজেদের সুখী দাবি করা এই শহরের মানুষরা জানালেন, এই শহর দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব। কোলাহলমুক্ত শহরটিতে ধোঁয়া নির্গতকারী কোনো যানবাহন নেই। যাতায়াতের মাধ্যম ব্যাটারি চালিত রিকশা।” 

ভিডিওতে দাবি করা হয়, শহরটির কোথাও আবর্জনা জমে না। দূষণ নেই। 

রাজশাহী যে একটি পরিচ্ছন্ন নগর হিসেবে পরিচিত তা নিয়ে বিগত কয়েক বছরে একাধিক প্রতিবেদন এসেছে গণমাধ্যমে। দেখুন জনকণ্ঠ, প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন

কিন্তু প্রতিবেদনগুলোতে শহরটিকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে দাবি করা হয়নি। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম The Guardian এর ২০১৬ সালের ১৭ জুন প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়, বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কণা দ্রুত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে আছে রাজশাহী শহর। 

জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উপাত্তের ভিত্তিতে করা এই প্রতিবেদনে এসেছে, “বিশ্বের যে ১০টি শহরে গত দুই বছরে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা কমেছে, এর মধ্যে রাজশাহীতে কমার হার সবচেয়ে বেশি। এর পরিমাণ ৬৭ শতাংশ। ইটভাটার চিমনির উচ্চতা বাড়িয়ে দেওয়া, বনায়ন, রাস্তার পাশের ফুটপাত কংক্রিট দিয়ে ঘিরে দেওয়া, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বহুল ব্যবহার, ডিজেলচালিত যানবাহন চলাচলে কড়াকড়ি” – এসবই রাজশাহীর বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

Screenshot source: The Guardian

লক্ষণীয় যে, এই প্রতিবেদনে যে উপাত্তের বিষয় এসেছে সেটি এশিয়া কেন্দ্রিক ছিল না, ছিল বৈশ্বিক ডাটার ভিত্তিতে করা রিপোর্ট। 

সাধারণত একটি শহরের বায়ু নিরাপদ কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া সাপেক্ষে একটি শহরকে দূষণমুক্ত বা পরিচ্ছন্ন বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে পিএম বা পার্টিকুলেট ম্যাটারের মাত্রাকে হিসেবের মধ্যে আনা হয়৷ পিএম বা পার্টিকুলেট ম্যাটার বলতে বোঝায়, বাতাসে ভেসে বেড়ানো কঠিন ও তরল পদার্থের মিশ্রণ, যা অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। এগুলো খুব সহজে নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদানের সমন্বয়ে পিএম তৈরি হতে পারে। পিএম ২.৫ এর ব্যাস ২.৫ মাইক্রণের কম হয় এবং পিএম ১০ এর ব্যাস ১০ মাইক্রণের মতো হয়ে থাকে।

Screenshot source: EPA

আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং বায়ুমান বিষয়ক মার্কিন সংস্থা Accu Weather এর দেওয়া সর্বশেষ (২১ মার্চ) তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীর বাতাসে ক্ষতিকর পিএম১০ কণার পরিমাণ ছিল ৬২ মাইক্রোগ্রাম/ঘন মিটার। 

তবে এরচেয়ে আরো কম পিএম১০ কণার পরিমাণ ছিল এশিয়ার একাধিক শহরে। যেমন, চীনের পানঝিহুয়া শহরের বাতাসে একই সময়ে একই কণার পরিমাণ ছিল ৭ মাইক্রোগ্রাম/ ঘনমিটার। 

অর্থাৎ, রাজশাহীর চেয়ে এশিয়ার অন্য শহরের বাতাসের মান ভালো।

বাংলাদেশে বায়ুমান পরিমাপ করার মূল কাজটি করে থাকে পরিবেশ অধিদপ্তর। দেশের ১১ টি জেলায় (ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুর, কুমিল্লা এবং নরসিংদী) স্থাপিত বায়ুমান পরিমাপ যন্ত্রে ‘ক্লিন এয়ার এন্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ নামের প্রজেক্টের আওতায় প্রতিদিনই এই বায়ুমান পরিমাপ করা হয়। যেহেতু নির্দিষ্ট কিছু জেলার বায়ুমান হিসেব করে থাকে পরিবেশ অধিদপ্তর, তাই দেশের সামগ্রিক বায়ুমান ফলাফল জানার সুযোগ নেই এই ব্যবস্থায়।  

সাধারণত ০ থেকে ৫০ এর মধ্যে এই মান থাকলে পরিবেশ অধিদপ্তর সেটিকে ভালো (Good) হিসেবে আখ্যায়িত করে। এভাবে পর্যায়ক্রমে মান বাড়লে যথাক্রমে Moderate (৫১-১০০), Caution (১০১-১৫০), Unhealthy (১৫১-২০০),  Very Unhealthy (২০১-৩০০) এবং Extreme Unhealthy (৩০১-৫০০) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ুমানের যে রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে সেটির ২১ মার্চের রিপোর্টে দেখা গেছে, রাজশাহীর এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের মান ১৭১, যাকে অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। এই তালিকায় সবচেয়ে কম এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (৮০) কুমিল্লার, যা অন্য শহরের তুলনায় সবচেয়ে ভালো অবস্থান নির্দেশ করছে। 

Screenshot source: DoE

অর্থাৎ, দেশের বায়ুমান পরিমাপেও রাজশাহীর অবস্থান সবার উপরে নেই। 

শুধু দূষিত বায়ু-ই নয়, একটি শহরের শব্দের মাত্রাও শহরটির দূষণ কমানো এবং শহরটিকে পরিচ্ছন্ন করে তোলার ক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে উঠে। এই দিক বিবেচনায় আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি রাজশাহীতে শব্দ দূষণের প্রভাব ঠিক কতটা। জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে এসেছে, বিশ্বের সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ শহরের তালিকায় চতুর্থ স্থানে (১০৩ ডেসিবেল) ছিল রাজশাহী।

সাধারণত, আবাসিক এলাকায় ঘরের বাইরে শব্দের মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল ও বাণিজ্যিক এলাকা ও ভারি ট্রাফিক অঞ্চলে শব্দের মাত্রা ৭০ ডেসিবেল হয়ে থাকে। 

তাছাড়া, Earth.org নামক একটি পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ২০২২ সালের আগস্টে বিশ্বের দশটি Greenest City এর তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশের কোনো শহর স্থান পায়নি। 

মূলত, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের দুই গণমাধ্যমে রাজশাহীকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর দাবি করা হলেও প্রতিবেদনগুলোতে এ বিষয়ে কোনো তথ্যসূত্র দেওয়া হয়নি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্বের পরিচ্ছন্ন শহর বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং উপাত্ত পর্যালোচনা করে সেসব তালিকা এবং উপাত্তে রাজশাহীর নাম উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ২০১৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাতাসে দূষিত কণা কমানোর ক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্বে সবচেয়ে ভালো করেছে, তবে উক্ত প্রতিবেদনে রাজশাহীকে এশিয়া কিংবা বিশ্বের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর বলা হয়নি। তাছাড়া, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী রাজশাহীর এয়ার কোয়ালিটি (১৭১) অস্বাস্থ্যকর, যার AQI মান বাংলাদেশেরই অন্য শহরের (কুমিল্লা ৮০) তুলনায় অনেক বেশি।

সুতরাং, রাজশাহীকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে গণমাধ্যমে যে দাবি করা হচ্ছে ; তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img