বার্ড ফ্লু আতঙ্কে হাঁস-মুরগি না খাওয়ার পরামর্শের খবরটি বাংলাদেশের নয়

সম্প্রতি, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘The Bangladesh Moments’ এর ফেসবুক পেজ হতে “ছড়িয়ে পড়েছে ‘এইচ৫এন১’ ভাইরাস হাঁস মুরগি না খাওয়ার নির্দেশ”শীর্ষক তথ্যযুক্ত একটি ডিজিটাল ব্যানার প্রচার(আর্কাইভ) করা হয়।

Screenshot from Facebook

উক্ত ফেসবুক পোস্টটিতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি কোথাকার সে সম্পর্কে সরাসরি কোনোকিছু উল্লেখ না থাকার কারণে অনেকেই এই ঘটনাটিকে বাংলাদেশের মনে করছে। প্রচুর শেয়ার এবং রি-পোস্ট হওয়ার কারনে উক্ত পোস্টটি নিয়ে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক বিভ্রান্তি এবং উৎকণ্ঠা। 

এমনকি, প্রায় ৪ হাজারের উপরে শেয়ার হওয়া ভাইরাল এই পোস্টটির সত্যতা জানার জন্য প্রচুর মানুষ রিউমর স্ক্যানারের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ এবং পেইজে ফ্যাক্টচেক রিকোয়েস্ট পাঠায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত পোস্টটির ব্যাপারে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় রিউমর স্ক্যানার টিম। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন; এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বার্ড ফ্লু আতঙ্কে হাঁস-মুরগি না খাওয়ার নির্দেশনাটি বাংলাদেশের নয় বরং ভারতের আলোচিত এই ঘটনাকে ভারত উল্লেখ না করে বাংলাদেশে প্রচার করায় অনেকেই ঘটনাটিকে বাংলাদেশের ভেবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।  

গত ৬ই মার্চ অনলাইন সংবাদমাধ্যম Rising Bd এর ফেসবুক পেজ থেকে “এইচ৫এন১ ভাইরাস: মুরগি ‘আপাতত’ না খাওয়ার পরামর্শ বিস্তারিত কমেন্টে-” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়।

শিরোনাম এবং বিস্তারিত খবরের প্রথম অংশ

তবে মূল সংবাদটি পড়ার পর দেখা যায় যে, পুরো খবরটিই ভারতীয় গণমাধ্যম ‘ডেকান হেরাল্ড’ এবং ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ এর প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে।

পরবর্তীতে কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ভারতের কর্ণাটকের সংবাদমাধ্যম ডেকান হেরাল্ডে গত ৪ মার্চ ২০২৩ তারিখে ‘Jharkhand: After Bokaro, bird flu outbreak in Ranchi’ শীর্ষক শিরোনামে খবরটি খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত সপ্তাহে ঝাড়খণ্ডের বোকারো জেলায় বার্ড ফ্লু শনাক্তের জেরে প্রায় চার হাজার হাঁস-মুরগি মেরে ফেলা হয়। তাছাড়া রাজ্যের রাজধানী ‘রাচি’তেও এর সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।

ইউনিয়ন মিনিস্ট্রি অব ফিসারিজ, এনিম্যাল হাসবেন্ড্রি এবং ডেইরি কর্তৃক পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, ঝাড়খন্ডের সেই সংক্রমিত এলাকাগুলো থেকে সংগৃহিত নমুনা পরীক্ষার জন্য ভূপালে অবস্থিত ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অন হাই সিকিউরিটি এনিমেল ডিজিজে পাঠানো হয় এবং পরীক্ষিত নমুনাগুলোতে এইচ৫এন১ ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়।

RisingBD এর প্রতিবেদনের সূত্র ধরে, ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইন সংস্করণে গত ৫ মার্চ ২০২৩ তারিখে ‘Avoid poultry till avian influenza cases subside, warn health’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ২০২০ সাল থেকেই প্রতি বছর ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন স্থানে বার্ড ফ্লু সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে এবং যতবারই এ ধরনের খবর ছড়াচ্ছে ততবারই স্থানীয় লোকজন হাঁস, মুরগি ও ডিম খাওয়া কমিয়ে দেন। যদিও এই ভয়কে ‘ভিত্তিহীন’ বলা হচ্ছে তবে এমন সতর্কতার প্রশংসাও করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞরা।

এই ব্যাপারে রাজেন্দ্র ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস এর মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অশোক কুমার শর্মা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, এটি সত্য যে, ভাইরাসটির প্রায় প্রতিটি ধরনই তাপমাত্রা সংবেদনশীল ফলে আক্রান্ত মুরগি বা পাখি সঠিক উপায়ে রান্না করলে ভাইরাস মারা যায়। তবে অন্য উপায়ে সেটি সংক্রমিত পাখি থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। 

উল্লেখ্য, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ডেকান হেরাল্ড ছাড়াও আরো অনেক ভারতীয় গণমাধ্যমেই ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়। ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়া সংক্রান্ত খবর দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

তবে, বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কিংবা বাংলাদেশি কোনো গণমাধ্যম থেকে দেশে বার্ড ফ্লু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার কোনো খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

প্রকৃতপক্ষে, ভারতীয় গণমাধ্যম ডেকান হেরাল্ড এবং টাইমস অব ইন্ডিয়াকে ভিত্তি করেই “এইচ৫এন১ ভাইরাস: মুরগি ‘আপাতত’ না খাওয়ার পরামর্শ বিস্তারিত কমেন্টে-” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত বাংলাদেশি গণমাধ্যমের খবর ও ফেসবুকের পোস্টগুলোতে সরাসরি ভাইরাস সংক্রমিত স্থানের নাম উল্লেখ না থাকায় অনেকেই সেই ঘটনাটিকে বাংলাদেশের ঘটনা বলেই ধরে নেয় এবং এই বিভ্রান্তির প্রতিফলন সেই পোস্টের কমেন্ট সেকশনেই লক্ষ্য করা যায়। 

রাইজিং বিডির ফেসবুক পোস্টটির এমন কিছু কমেন্ট দেখুন – 

Screenshot collage: Rumor Scanner 

অনলাইন পোর্টাল The Bangladesh Moments এর ফেসবুক পেজেও একইভাবে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি কোথাকার সেই ব্যাপারে কিছু উল্লেখ না করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে।

Screenshot from Facebook

আর এই বিভ্রান্তির প্রতিফলন উক্ত পোস্টের কমেন্ট সেকশনেও লক্ষ্য করা যায়:

Screenshot collage: Rumor Scanner 

বাংলাদেশে কি এখন পর্যন্ত বার্ড ফ্লু মহামারীর কোনো তথ্য পাওয়া গেছে?

বিস্তর অনুসন্ধানে, রিউমর স্ক্যানার টিম এখন পর্যন্ত কোনো গণমাধ্যম কিংবা সরকারি দপ্তর থেকে বাংলাদেশে H5N1 ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার তথ্য খুঁজে পায়নি। 

এদিকে গত ০৭ মার্চ জাতীয় দৈনিক সমকাল পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশে এখনও সংক্রমণ ধরা না পড়লেও বার্ড ফ্লু প্রতিরোধ এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। পোলট্রি খামারিদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে নির্দেশনা দিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। সীমান্ত এলাকায় নেওয়া হয়েছে সতর্কতা।”

Screenshot source: Samakal

এ বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণী স্বাস্থ্য শাখার উপপরিচালক ডাঃ মোঃ নাজমুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “বাংলাদেশে এখনও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কোনো তথ্য নেই। আমরা যে সতর্কতাটা নিচ্ছি এখন, সেটা স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।” 

মূলত, ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে বার্ড ফ্লু মহামারী ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে সেখানকার কিছু বিশেষজ্ঞ কর্তৃক পোল্ট্রি না খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। এই খবরটিকে বেশ কিছু বাংলাদেশি গণমাধ্যমের শিরোনামে এবং ফেসবুকে ভারতের ঘটনা উল্লেখ না করায় অনেকেই ঘটনাটিকে বাংলাদেশের ভেবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।  

সুতরাং, ভারতের বার্ড ফ্লু মহামারীতে পোল্ট্রি (হাঁস-মুরগি) না খাওয়ার পরামর্শকে কোনো স্থানের নাম উল্লেখ ব্যতীত বাংলাদেশ প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img